২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশীরা ভাত পেয়েছে, অধিকার পেয়েছে কি?

-

তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ২৫ মার্চ ১৯৬৯ তারিখে সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা ছাড়ার পর বাংলাদেশের প্রখ্যাত নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ভোট হয়ে গেল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাশিয়ার কূটনৈতিক ও ভারতের সামরিক সহায়তায় বিজয় অর্জনের পথে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। স্বাধীন দেশের এক বীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ বুভুক্ষু দেশবাসীর পক্ষে ক্ষোভে দুঃখে ক্রোধে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় গর্জে উঠলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’। কী নিদারুণ কষ্টের এ উচ্চারণ। এই ভাত পেতে বাঙালির ৪৮টি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। তবে আজো দেশে বহু নিরন্ন লোক ভিক্ষা করে খায়। মোটা দাগে বলতে গেলে বাঙালি ভাত তো পেল; কিন্তু বাস্তবে অবস্থা কী দাঁড়াল? সেটাই তলিয়ে দেখা যাক।
প্রশ্ন জাগতে পারে, ১৯৬৯-এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল, কিন্তু আজকের এত অন্যায় অনাচার অবিচার বৈষম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে তেমন গর্জে উঠছে না কেন? এর একটি সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে, তখন মানুষের পেটে ভাত ছিল না। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘হাংগ্রি ম্যান ইজ দি অ্যাংগ্রি ম্যান’। এখন পেটে ভাত আছে। এখন মানুষ বড়লোক হতে পারছে, তখন হতে পারত না। তাছাড়া বাঙালিরা তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে এক হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এই উত্তর অবশ্য চূড়ান্ত নয়। সে সময়ে করাচিতে আমার পৌনে তিন বছরের অবস্থানের কারণে বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে নাও পেরে থাকতে পারি। তবে এটা ঠিক, পশ্চিম পাকিস্তানেও তখন গণ-আন্দোলনের জোয়ার বয়ে গেছে, যা প্রত্যক্ষ করেছি। নিজে এতদিনে আমার চেতনায় কিছুটা ‘পাক ধরেছে’ মনে হয়, যে কারণে এ বিষয়ে আমার ভিন্ন কিছু ব্যাখ্যা আছে।
মানবজীবনে শান্তির জন্য পেটে ভাত থাকাটা একটা জরুরি ফ্যাক্টর। খালি পেটে পণ্ডিতরাও কিছু বলতে বা লিখতে পারেন না। সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে সাধারণ বাঙালির পেটে ভাত পড়েনি। ভাত খাওয়ার জন্য আন্দোলন করে সাধারণ মানুষ বন্দুকের গুলি খেয়ে মরতেও প্রস্তুত এবং অনেকে মরেছে। এ সব কথা ইতিহাসে লেখা আছে। কিন্তু ভাত খেতে পারা বা বড়লোক হওয়ার আকাক্সক্ষা পূরণ হওয়াটাই মানবজীবনের শেষ কথা নয়। যদি তা না হতো তবে মানবসভ্যতা এতদূর অগ্রসর হতো না। বিফল প্রচেষ্টায় অন্তত আটজনের মৃত্যুর পর ২৯ মে ১৯৫৩ তারিখে হিলারি ও তেনজিং-এর দুঃসাহসিক এভারেস্ট বিজয়ও অর্জিত হতো না কিংবা দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শিকাগোর হে মার্কেটে ০৪ মে ১৮৮৬ সালে শ্রমজীবী মানুষ রাজপথে রক্তও দিত না। তারা কেউ অভুক্ত ছিলেন না। এসব সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে, মানুষের অজানাকে জানার আকাক্সক্ষা আর মানবাধিকারের প্রশ্নটি চিরন্তন। মানবজীবনে মানবাধিকার ভোগ করার বিষয়টা ভাতের মতোই একটি মৌলিক চাহিদা।
মানুষের মৌলিক আবিষ্কারের খাতায় তিনটি নাম উল্লেখ আছে, যার একটি ‘ব্যালট’ এবং অপর দুটি ‘আগুন’ ও ‘চাকা’।
আমার আলোচ্য বিষয়টি হলো ‘ব্যালট’। এই ‘ব্যালট’-এর মাধ্যমে মানুষ নির্বাচন করে থাকে, কারা তাদের যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণ করে শাসন করার ক্ষমতা লাভ করবেন। মানুষের এ অধিকারটি সব দেশের সংবিধানেই উল্লেখ করা আছে এবং যুক্তরাজ্যের মতো যেখানে লিখিত সংবিধান নেই, সেখানেও এ প্রথা অনুসৃত হয়ে থাকে। আমাদের দেশের সংবিধানেও জনগণকে সে অধিকার দেয়া আছে। ‘ব্যালট’-এর মাধ্যমে দেয়া এ ক্ষমতার যদি কোনো শাসক অপব্যবহার করে, তার বিরুদ্ধে পেটভরে খাওয়া মানুষও বিদ্রোহ করে এবং সে শাসককে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। নিকট অতীতে, বিশ্বের আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে ২৭ জুন ২০০৭ সালে তা করতে হয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জুনিয়র ও টনি ব্লেয়ার উভয়েই ইরাক যুদ্ধে জড়িত ছিলেন। তবু বুশ ব্লেয়ারকে যুক্তরাজ্যে ক্ষমতায় রাখার জন্য কিংবা ব্লেয়ার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে ব্রিটিশ জনগণের ওপর চাপ প্রয়োগের কথা চিন্তাও করেননি। মাও সে তুং বলেন, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’; সেখানে ‘ব্যালট’-এর ভূমিকা গৌণ। যুক্তরাজ্য সে ধাঁচের দেশ নয়।
আমাদের দেশে এখন কী হচ্ছে? শাসক নির্বাচনে ‘ব্যালট’-এর রেওয়াজটা আছে বটে তবে এর সাথে পেশিশক্তি কাজ করছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা হলে আমাদের স্মরণ করতে হবে মাও সে তুং-এর আরেকটি উক্তি, যা হলো ‘মাছের পচন ধরে মাথায়, জাতির পচন ধরে নেতায়’। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিকব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের পর ১৯৯১ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রশ্নবোধক নির্বাচনে বিএনপি আবার বিজয়ী হয়েছিল। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী প্রথা প্রবর্তনের দাবিতে গণচাপের মুখে সে প্রথা প্রবর্তন করে শিগগিরই পুনঃনির্বাচন দিয়ে বিএনপি ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে এবং আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে। এর ফলে দেখা গেল, নির্দলীয় সরকারের অধীনে পরপর কোনো দলই দু’বার ক্ষমতায় আসে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ২০০৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের ট্রেন্ড অনুসারে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কথা ছিল। কিন্তু তারা গোল বাধালেন রেওয়াজ অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানকে নিয়ে। লগি-বৈঠা নিয়ে আন্দোলন করে রাজপথে রক্ত ঝরানো হলো। ফলে এমন এক সরকার ক্ষমতায় এলো যাকে আওয়ামী লীগ তাদের আন্দোলনের ফসল বলে ঘোষণা দিলো। সেনাসমর্থিত এই সরকার ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে; এরপর আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেশান্তরিত হলো। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান বাতিল করে দিলো; দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল আরো দু’টি নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করা যায়। আওয়ামী লীগ তা কার্যকর করেনি। ফলে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দু’টি জাতীয় নির্বাচনই ক্ষমতাসীন দলীয় অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন হলো। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি এবং ২০১৮ সালে অংশগ্রহণ করেছে। এই দু’টি নির্বাচনই এমন জগাখিচুড়ি মার্কা ও ভোট কারচুপিপূর্ণ হলো যে, প্রথমটিতে জনগণের ভোট দেয়ার প্রয়োজন হলো না এবং দ্বিতীয়টিতে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে কৌশলে বঞ্চিত করে আওয়ামী লীগ দু’বারই পরপর ক্ষমতায় এলো। ক্ষমতাসীন মহল কর্তৃক জনগণ উচ্ছিষ্ট হলো এবং তাদের কিছুই করার রইল না। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান আমলের শেষ জাতীয় নির্বাচনটি যদি অমন হতো তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে কি পারত।
জনগণ কি বাংলাদেশের শেষ দুটো নির্বাচন মেনে নিয়েছেন? নাকি তাদের মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে? বাস্তবে তা মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে প্রশাসনের লোকদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে এবং জনগণকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর জোর দেখিয়ে; আর আছে একটি বড় দেশের সমর্থন। ইতোমধ্যে সে দেশকে বাংলাদেশের কিছু পাওয়া ব্যতিরেকেই অঢেল সুবিধা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। দেশটির সমর্থন ছিল না বলে বিএনপিকে ১৯৯৬ সালে পিছু হটতে হয়েছে। বিএনপির আদর্শগত কারণেও তা হতে পারে। এরূপ আদর্শগত নৈতিক দৃঢ় অবস্থান আওয়ামী লীগের বেলায় দেখা যায় না। যদি তা থাকত তবে জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ বেপরোয়া আচরণ কিছুতেই করতে পারত না। একই ধরনের আচরণের জন্য ১৯৭৭ সালে ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছিল। নানা ত্র“টিবিচ্যুতি সত্ত্বেও সে দেশে এখনো জনগণের রায় দেয়ার সুযোগ আছে, যেটা বাংলাদেশ থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে।
জনসমর্থনহীন কোনো সরকার দেশ পরিচালনার ব্যাপারে গণসহযোগিতা পায়। না বর্তমান সরকার তা পাচ্ছে না? আজ ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনগণ চলছে ‘ফ্রি স্টাইলে’। যে যেমন পারছে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অনৈতিক কাজে লিপ্ত। যে সরকার নিজে নিয়মকানুন মেনে ক্ষমতায় আসে না, জনগণকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার নৈতিক অধিকার তার থাকে না। বর্তমান সরকারেরও তা নেই বলে দেশে খুন-খারাবি, ব্যভিচার-অনৈতিক কার্যকলাপ ব্যাপকভাবে চলছে। তবে এ সরকার রাজনৈতিক প্রতিশোধ গ্রহণ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে সিদ্ধহস্ত। এই কাজে তাদের জুড়ি নেই; ক্ষমতায় আসার এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের সব ক’টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ‘উন্নয়ন’ যা তা প্রধানত আই ওয়াশ।
ক্ষমতাসীনদের এসব অপকর্মের প্রতিবাদে জনগণ ১৯৬৯-এর মতো গর্জে উঠছে না কেন? সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পেটে ভাত আছে বলে? ধনী হওয়ার সুযোগ আছে বলে? আসলে তা নয়। তার প্রধান কারণ দেশে আইনের শাসন নেই। আইনের অপব্যাখ্যায় ক্ষমতাসীন দল দিনকে রাত ও রাতকে দিন করে ফেলতে পারে। দেশের জনগণ আইয়ুব খানকে ভয় পায়নি, ইয়াহিয়া খানকে ভয় পায়নি; তারা নীতিবিবর্জিত ক্ষমতাবানদের ভয় পায়। কে কখন খুন হয়ে যায়, কখন গুম হয়ে যায়, কখন তুলে নিয়ে যায় কাকে ঠিক নেই। এসব কারণে প্রতিবাদী জনগণ রাস্তায় দাঁড়াতে সাহস পায় না। সন্ত্রাস দমনের নামে দেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। পেটে ভাত-ভরা পশ্চিমা বিশ্বে সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদে লাখ লাখ লোক রাস্তায় নেমে এসে সরকারের পতন ঘটাতে পারলেও আধপেট খাওয়া, বাংলাদেশের জনগণ তা করতে পারছে না। হাভাতে বাঙালি ভাত পেয়েছে, এটা প্রকৃত কারণ নয়; আসল কথা হলোÑ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জনগণের মানবিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। হ
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার


আরো সংবাদ



premium cement