২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আধুনিক রাষ্ট্র ও রুশোর ‘প্রকৃতি রাজ্য’

-

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ্বাসেও নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সভ্যতাকে অধিকতর সুশৃঙ্খল ও পরিশীলিত করতেই মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ঘটে। বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতি; এমনকি সাহিত্যেও এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। সে ধারাবাহিকতায় আধুনিক রাষ্ট্রের পথচলা। উদ্দেশ্যÑ গণমানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সভ্যতাকে গতিশীল ও পরিশীলিত রূপ দেয়া। অধ্যাপক গ্যাটেলের ভাষায়, ÔPolitical thought represents a high type of intellectual achievement.Õ
সময়ের প্রয়োজনেই রাষ্ট্রচিন্তায় গতিশীলতা এসেছে। গ্রিক রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধাবস্থাসহ নানা প্রতিকূলতা এবং বৈরী পরিস্থিতি অবসানের জন্য প্লেটো তার বিখ্যাত ‘The Republic’ গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি এদিক দিয়ে তারই গুরু মহাজ্ঞানী দার্শনিক সক্রেটিসের মূলনীতি ‘Virtue of Knowledge’ এবং ‘যা আদর্শ তাই বাস্তব ’ প্রভৃতি নীতি দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছেন। প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছেন তার মূল উদ্দেশ্য হলোÑ সুন্দর, সাবলীল বা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন। আসলে গণমানুষের কল্যাণ ও মানুষের অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করতেই রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তি। আর নাগরিকরা রাষ্ট্রের সে কল্যাণ ও সেবা প্রাপ্তির জন্য রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রকে কর দেয়।
রাষ্ট্রকে কল্পনা করতে হয়। সরকার কিন্তু রাষ্ট্রের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য (concrete) রূপ। রাষ্ট্রের ইচ্ছা সরকারের মাধ্যমেই প্রকাশিত ও কার্যকর হয়। ‘হাল’ ব্যতীত যেমন নাবিকের পক্ষে জাহাজ চালানো সম্ভব হয় না, তেমনিভাবে সরকার না থাকলে জনজীবন বিশৃঙ্খল হয়ে যায় এবং সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজই তাদের দিয়ে সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রও সফল ও সার্থক হয়ে ওঠে না।
রাষ্ট্র ও সরকার একে অপরের শুধু পরিপূরকই নয়, বরং অবিচ্ছেদ্য। রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্র ধরেই মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। তবে জাতি হিসেবে আমরা পশ্চাদমুখী হয়ে পড়েছি। সব ক্ষেত্রেই যেন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। জাতীয় সম্পদ রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও সে দায়িত্ব পালনেও আমরা সফলতা দেখাতে পারিনি। দেশে শুধু সম্পদের অপচয় ও লুটপাটই হচ্ছে না, বরং বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ (জিএফআই) বলছে, গত এক বছরে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে। এমনকি দুর্নীতির ধারণা সূচকে এটি এখন বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলেও সংস্থাটি উল্লেখ করেছে। গত অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে সহজে ব্যবসা করার সূচক অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রীয় সাফল্যের এসব সূচকে আমাদের অবস্থা আশাবাদী হওয়ার মতো নয়, বরং উদ্বেগজনক।
অপরাপর জাতিরাষ্ট্র যখন উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে অগ্রসর হচ্ছে, তখন আমাদের পদক্ষেপ ভূতের মতোই বলতে হবে। কথায় আছে ভূতের পা নাকি পেছনে। তাই তাদের সামনে চলার কোনো সুযোগ নেই। আমরা বোধ হয় একেবারে দিব্যি দিয়ে বসেছি যে, কোনোভাবেই আমাদের সামনে চলা যাবে না, বরং পশ্চাদমুখিতার নিগড়েই আবদ্ধ থাকতে হবে। আর এটা জাতীয় জীবনের জীবনীশক্তিকে দুর্বল করে ফেলছে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলোÑ ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর নাগরিকের জানমালের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান। সুশাসন নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। আর রাষ্ট্রের করণীয় বাস্তবায়নের দায়িত্বটা পুরোপুরি সরকারের। দেশের মানুষ রাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত ক্ষমতাবানদের সদিচ্ছার অভাব ও উপর্যুপরি ব্যর্থতার কারণে। মূলত মহলবিশেষের আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের কারণেই আমরা অবনতির শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে রাষ্ট্র নামক সংঘের সূচনা হয়েছিল, সে লক্ষ্য থেকে আমাদের অবস্থান অনেক দূরে বলেই মনে হচ্ছে। ফলে জনগণ রাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হলেও এর প্রয়োগটা প্রশ্নবিদ্ধই বলতে হবে। ফলে গণদুর্ভোগ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে; অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সুশাসনের অনুপস্থিতি ও আইনের দুর্বলতার কারণে জনজীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ জন্য স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার কম দায়ী নয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৮ সালে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এবং তাদের হেফাজতে ৪৬৬ জন মানুষ মারা গেছে। গত বছর বিভিন্ন দলের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও অন্যান্য দলের এবং নিজেদের মধ্যে কোন্দলের জেরে ৭০১টি রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের ঘটনায় ৬৭ জন নিহত এবং সাত হাজার ২৮৭ জন আহত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ২০১৮ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩২ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার ৬৩ জন। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে সাতজন। নির্বাচনের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের এক গৃহবধূকে দল বেঁধে ধর্ষণের বিষয়টিও এসেছে প্রতিবেদনে।
২০১৮ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতি ‘চরম উদ্বেগজনক’ ছিল বলে দাবি করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এ ছাড়া নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে। গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে গুম হন ৩৪ জন। পরবর্তী সময়ে তাদের ১৯ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন মামলায় আটক আছেন। এ ছাড়া ঘটেছে বেআইনি আটক ও গণগ্রেফতারসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর মতো ঘটনা।
আসক আরো বলেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৭০টি সহিংসতার ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯ জন, বিএনপির চারজন, একজন আনসার সদস্য, ১০ জন সাধারণ মানুষ। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন। আর ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭২৪। যা আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা, সফল রাষ্ট্র ও সুশাসনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মনে হচ্ছে, এক শ্রেণীর লোক নির্যাতক এবং আরেক শ্রেণীর লোক নির্যাতিত হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে। এসব অতীতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে এবং আগামী দিনেও হবে কমবেশি। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে রাখতেই রাষ্ট্রের তৎপরতা ও আইনের শাসন প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র অপরাধের প্রতিবিধান করতে তেমন সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি। যাদের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না বলে অভিযোগও বেশ জোরালো। সম্প্রতি মাদরাসা অধ্যক্ষ কর্তৃক ছাত্রী রাফির যৌন নিগ্রহ ও তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা সেদিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে বারবার ঘটছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা, উদাসীনতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব আর বিচারহীনহার প্রবণতার কারণেই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তনু ও সাগর-রুনিসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। এ ধরনের অপরাধীদের শাস্তির তেমন একটা নজির দেখা যায় না। তাই এসব অপরাধী ও সমাজবিরোধীরা এখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য।
সংবিধানের প্রস্তাবনা বা ভূমিকায় (Preamble) বলা হয়েছেÑ ‘...আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রে অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কোনো বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না’। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য যৎসামান্যই বলতে হবে। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণই আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার মূল উদ্দেশ্য। রুশোর মতে অতীতে ‘প্রকৃতি রাজ্য’ ছিল পৃথিবীতে স্বর্গের মতো। মানুষ ছিল সুখী, আনন্দবিহ্বল এবং পরিপূর্ণ। মানুষের জীবন ছিল সৎ, স্বাভাবিক ও সুন্দর। প্রাকৃতিক অবস্থায় কোনো কৃত্রিমতা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ছাপ ছিল না; ছিল শুধু সুখ ও সম্প্রীতি। মানুষ সুখী, সহজ, সরল এবং সততার জীবনে অভ্যস্ত ছিল।
দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবং দেশে সুশাসন ও আইনের শাসনের দুর্বলতায় মানুষ বোধ হয় সেই রুশোর ‘প্রকৃতি রাজ্যে’র কথাই বারবার স্মরণ করছে। যে সভ্যতা, রাষ্ট্র ও সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করতে পারছে না, সে সভ্যতাকে অসার ও অপ্রয়োজনীয় মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অপরাধ ও অপরাধীদের প্রতিবিধান করতে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছে না; ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন’ এর আমাদের অর্জন যৎসামান্যই। হ
smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতে দ্বিতীয় পর্বে ৮৮ আসনে ভোট খালেদা জিয়ার সাথে মির্জা ফখরুলের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা আটক জীবন্ত মানুষকে গণকবর আগ্রাসন ও যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃষ্টির জন্য সারা দেশে ইসতিস্কার নামাজ আদায় আরো ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট তাপপ্রবাহ মে পর্যন্ত গড়াবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকার ভূমিকা চায় যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ গ্যাসের ছাড়পত্র ছাড়া নতুন শিল্পে ঋণ বিতরণ করা যাবে না

সকল