২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণতন্ত্র : ক্ষমতার অভিলাষ ও এর নিয়ন্ত্রণ

-

গণতন্ত্র নিয়ে বহু মাতামাতি, দেশে দেশে বহু এত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, যুগে যুগে বহু জীবন বিসর্জনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ গণতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট কোনো আকার, গঠন বা সংজ্ঞা নেই। মানুষের চিন্তাধারা ও ব্যক্তিপর্যায়ের ধ্যান-ধারণা যেমন অসম, বহুরূপী ও বিচিত্র, তেমনি গণতন্ত্রের আকার, গঠন ও তত্ত্ব অনেকটা তাই। যেমন পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংসদ বা পার্লামেন্ট আছে। সংসদের কর্তব্য এক হলেও গঠন ও ক্রিয়াকলাপ সমরূপ নয়। সংসদ হতে পারে এক কক্ষবিশিষ্ট, যেমন বাংলাদেশ। অথবা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, যেমন পাকিস্তান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। রাষ্ট্রের গঠনও তেমনি হতে পারে ইউনিটারি বা অখণ্ড। আবার রাষ্ট্র হতে পারে একক রাজনৈতিক দলবিশিষ্ট, দ্বিদলীয় বা বহুদলীয়। রাষ্ট্র, সংসদ বা সরকারের আকার, গঠন, প্রকৃতি যাই হোক; গণতন্ত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জনগণের ক্ষমতায়ন ও শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশীদারিত্ব।
অন্য দিকে আবার যে নির্বাচনী ব্যবস্থায় দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান কিংবা সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন তার মধ্যেও অনেক পার্থক্য আছে। প্রার্থীর বিজয় যেমন সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ (একক) ভোটে হতে পারে, যেমন বাংলাদেশ। তেমনি প্রার্থীর বিজয় সুনিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা ৫০ শতাংশের ওপর ভোট পাওয়ার ভিত্তিতে হতে পারে, যেমন ফ্রান্স ও মালদ্বীপ। সুনিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভিত্তিক নির্বাচন হলে প্রথম দফা নির্বাচনে কোনো প্রার্থী যদি ৫০ শতাংশ থেকে কম ভোট পায়, তাহলে প্রথম দফায় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রথম ও দ্বিতীয় প্রার্থীর মধ্যে পুনরায় নির্বাচন হতে হবে। আবার কোনো কোনো দেশে নির্বাচিত হতে হলে নির্দিষ্ট হারে ভোট পেতে হবে, যেমন নিকারাগুয়ায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে মোট ভোটদাতার ন্যূনতম ৩৯ শতাংশ ভোট পেতে হবে। তা ছাড়া, দলভিত্তিক ভোট পাওয়ার আনুপাতিক হারেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারে। এমনকি, প্রত্যক্ষ ও দলভিত্তিক ভোটের সমন্বয়ে সংশোধিত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতেও হতে পারে। যেমনÑ অর্ধেক সদস্য সরাসরি ভোটে, বাকি অর্ধেক দলভিত্তিক ভোটের আনুপাতিক হারে। ওপরের দৃষ্টান্ত ছাড়াও আরো অনেক মিশ্রপদ্ধতির ব্যবস্থা দেশে দেশে দেখা যায়। নির্বাচনের ধরন যা-ই হোক, কারণ ও উদ্দেশ্য একটাই। সেটা হলো শাসনব্যবস্থায় জনগণের যথার্থ প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা বিধান করা।
দেশে দেশে নির্বাচনের ধরন আলাদা হলেও যেকোনো শাসনব্যবস্থায় সরকারে তিনটি অঙ্গ অবশ্যই থাকে। নির্বাহী বিভাগ, সংসদ বা আইন প্রণয়ন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। সরকারের এ তিনটি অঙ্গ বা শাখা সব সময় পরস্পর থেকে স্পষ্টত ভিন্ন ও আলাদা হতে হবে। অবশ্যই প্রতি অঙ্গ একে অপর থেকে স্বাধীন হতে হবে। এক শাখা অন্য শাখার ওপর সংবিধানে বর্ণিত উপায়ে নজরদারি করার ক্ষমতা পাবে। তবে কোনোভাবেই খবরদারি করার ক্ষমতা থাকবে না। এই উপায়কে ক্ষমতার পৃথকায়ন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ ব্যবস্থায় দেশে দেশে রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধানের ক্ষমতা এবং কর্তব্যের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সংসদ বা পার্লামেন্টের কর্তব্য ও দায়িত্ব মোটামুটি একই। সংসদের কর্তব্য হলো জনগণের অধিকার, আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে বিদ্যমান আইনের সংশোধন ও প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা। তবে বাংলাদেশের সংসদের মতো কেবল চোখ-কান বন্ধ করে আইন পাস করা নয়। সংসদ চলাকালে অনেক সময় দেখা যায় বেশির ভাগ আসন শূন্য। তখন মনে হয় যেন কোরাম ছাড়াই আইন পাস হয়ে যাচ্ছে। যদিও সব দেশে সংসদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আইন প্রণয়ন করা, তবে বাংলাদেশে সংসদ আইন প্রণয়ন করে এ কথা বলা যাবে না। বলা যায় বরং বাংলাদেশের সংসদে কেবল উপস্থাপিত আইন পাস করে।
একই সাথে বিচার বিভাগকে যতই স্বাধীন বলে ঢাকঢোল পেটানো হোক, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মনে করে, বর্তমানে বাংলাদেশে বিচার বিভাগ কোনো আঙ্গিকেই স্বাধীনভাবে কাজ করছে না। বিচারের মৌলিক তত্ত্ব, যেমনÑ বিচারকদের স্বাধীনতা এবং দ্রুতগতিতে ও কম খরচে ন্যায়বিচার পাওয়া সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। এ তত্ত্বানুযায়ী ‘উপদিষ্ট রায় বা বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করার সমতুল্য’, তেমনিভাবে এ-ও বলা যায়, ‘ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিচার না চাওয়াই ভালো।’ এ দুটো বাক্যই বাংলাদেশে বর্তমানে পুরোপুরি প্রযোজ্য। অনেকেই মনে করেন, পুরোপুরি সত্যি। এর কারণ হলো, এক দিকে উদ্দিষ্ট রায়, অন্য দিকে বিলম্বিত বিচার, এসব মিলে বাংলাদেশে বর্তমানে ন্যায়বিচার পাওয়া একেবারেই দুষ্কর। অতএব, এক দিকে অনির্বাচিত ও অকার্যকর সংসদ এবং বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থার ঘাটতি, এ দুয়ের সম্মিলিত প্রভাবে জনগণের নাভিশ্বাস এখন চরমে পৌঁছেছে। অন্য দিকে নির্বাহী বিভাগের স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয়করণ ইত্যাদি সব মিলে প্রজাতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গণতন্ত্রের কোনো সুসংজ্ঞায়িত বা সুসঙ্গতিপূর্ণ তত্ত্ব এখনো কোথাও নেই। অতএব, গণতন্ত্রের আকার ও গঠন নিয়ে যা-ই অনুমান করা হোক, তা হবে বহুমুখী, বহুরূপী, বিচিত্র ও বহুমাত্রিক। অনেক সময় অসন্তোষজনকও হতে পারে। এতদসত্ত্বেও গণতন্ত্রের বহু প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত প্রচলিত সংজ্ঞা আছে। তবে সেগুলোকে বড়জোর বলা যেতে পারে কেবল অনুমিত ধারণা, মতবাদ অথবা ক্রিয়াপদ্ধতি। সম্ভবত এর কারণ, বিপুল সংখ্যায় সামাজিক অনেক তত্ত্ব ও মতবাদ, স্থানীয় নানা ঐতিহ্য, অনেক রীতিনীতি ও প্রথা, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য অনেক আচরণ, বিধিবিধান, ধর্মীয় রীতিনীতি, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গোড়ায় রাজনৈতিক নেতাদের মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি। বহু দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী-গোত্র একে অপরের সাথে যেসব রাজনৈতিক চুক্তি বা সন্ধিতে আবদ্ধ সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে বা একত্রে মিলিয়ে-মিশিয়ে এক এক রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতি নিজেদের প্রয়োজনমাফিক বিশেষ ধরনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা রচনা করেছে।
এ কারণে যেকোনো দেশ যখন সমাজকে গণতান্ত্রিক করার পদক্ষেপ নেয়, তার সর্বাধিক পূর্বশর্ত থাকে বিদ্যমান সামাজিক পরিবেশ, নাগরিকদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা ও শর্তাবলি। সেই দেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য, শিক্ষার স্তর, অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান স্তর, সর্বজনীন শিক্ষার প্রসার, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জনগণের নৈতিক মান ও মূল্যবোধ, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সমাজের সব বর্ণ-ধর্মের মানুষের রীতিনীতি-প্রথা-বিধানকে একত্রে বিচার-বিবেচনায় এনে সংবিধান তৈরি করা হয়। তারপর সাধারণ নিয়মেই সংবিধানসম্মতভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করা হয়। অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠীর চারিত্র্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটে সেই কাঠামোতে। তবে নতুন কাঠামো বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খেতে হবে। উল্লেখ্য, নতুন কাঠামো ঐতিহ্যিকভাবেই পুরনো কাঠামোর গতি পথনির্ভর।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, তত্ত্ব, মতবাদ, বৈচিত্র্য, মূল্যবোধ, মান, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য যাই হোক; তার জন্য কিছু ন্যূনতম শর্ত আছে। যেমনÑ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা বিধান, তর্ক-বিতর্ক ও আপসরফা, আইনের শাসন, আইনের সমপ্রয়োগ, রাজনৈতিক সম-অধিকার, ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্ত প্রণয়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশীদারিত্ব এবং শাসনপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের ওপর সংবিধানসম্মতভাবে সাধারণ নাগরিকদের উচ্চস্তরের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার সুযোগ।
বহুমুখী, বহুরূপী ও বহুমাত্রিক গণতন্ত্রকে বোঝার জন্য আব্রাহাম লিঙ্কন গণতন্ত্রের যে বিমূর্ত সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটি দিয়েই আলোচনার সূত্রপাত করা সবচেয়ে উত্তম। তিনি বলেছেন, ‘জনগণের শাসন, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য।’ এ মতবাদের প্রথম সমস্যা দেখা দেয় যেখানে তিনি বলেছেন, ‘জনগণের দ্বারা (By the People)।’ এই জনগণ, যারা শাসন করবে, যেসব জনগণ দ্বারা আমরা শাসিত হবো, তারা কারা? তারা কিভাবে শাসন করার জন্য ক্ষমতার অধিকারী হবেন? তার পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কী হবে? ‘জনগণের শাসনের’ পদ্ধতি কী হবে? পদ্ধতি যা-ই হোক, কিভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে? রাজা-বাদশাহ-আমির, একনায়ক, সার্বভৌম শাসক; সবাই শাসন করে জনগণের নামে, জনগণের জন্য। তাহলে কি সব শাসনব্যবস্থাকেই ‘জনগণের সরকার’ বলে মেনে নিতে হবে? এই তত্ত্বের মৌলিক বিষয় হলোÑ যারা জনগণের নামে শাসন করে, ‘তারা কারা ও সেই শাসনের পদ্ধতি কী হবে?’ এই মৌলিক বিষয়টির যথার্থ সারমর্ম হলোÑ ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশীদারিত্ব।’ এ প্রক্রিয়াই সম্ভবত গণতন্ত্র, গণতন্ত্রায়ন এবং ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও দর্শনের মধ্যে সব সময় বিবাদ, বৈষম্য ও উত্তেজনা, এমনকি সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে।
যেসব মতভেদ ও আদর্শিক সমস্যা এই উত্তেজনার জন্ম দেয়, তা মানব সমাজে নতুন কিছু নয়। এ উত্তেজনার পদচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় দর্শনের জনক প্লেটোর (আনু. ৪২৭-৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) অভিব্যক্তির মাঝে। তিনি স্পষ্টত গণতন্ত্র নামক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় রাজা-দার্শনিককে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কেবল দার্শনিকেরই থাকে সেই দক্ষতা, যা প্রয়োগ করে তিনি বিজ্ঞ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সঠিক উত্তর খুঁজে বের করতে পারেন এবং কণ্টকিত নানা সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে পারেন।

ক্ষমতাপ্রাপ্তদের অভিলাষ ও তার নিয়ন্ত্রণ
সামাজিক মতবাদের নৈতিকতায় শাসকগোষ্ঠী যতই দীক্ষিত বা পরিশীলিত হোক, যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন বা যাদের হাতে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তাদেরকে যদি যথেষ্ট মানের শক্তিশালী প্রতিবিধায়ক ভারসাম্য ব্যবস্থার আওতায় রেখে তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে কোনোভাবেই ক্ষমতার অন্যায় ও অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। মানুষের প্রকৃতিপ্রদত্ত স্বভাব-চরিত্র প্রসঙ্গে থমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘মানুষের প্রকৃতিপ্রদত্ত স্বভাব-চরিত্র হলো কামনা-বাসনা ও অভিলাষের এক বাদ্যযন্ত্র। তারা সুযোগ পেলেই এই অভিলাষ সম্পূর্ণরূপে পরিতুষ্ট করার লক্ষ্যে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে ও সদাসর্বদা প্ররোচনায় লিপ্ত থাকে।’ এ ধরনের একটি অভিলাষ হলোÑ ক্ষমতাপ্রাপ্তি ও প্রাপ্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্য মানুষের ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করা। যদিও ক্ষমতা সরাসরি কোনো তুষ্টিদায়ক বস্তু নয়, তবে এই ক্ষমতার এক বিরাট বাদ্যযান্ত্রিক মূল্য আছে। ক্ষমতা নানা ধরন ও বিভিন্ন প্রকারের সন্তুষ্টি মেটানো বা পূরণের মূল উৎস হিসেবে কাজ করে। অতএব, ক্ষমতা এক দিকে সন্তুষ্টি বা অভিলাষের মূল উৎস হিসেবে কাজ করে এবং অন্য দিকে ক্ষমতাপ্রাপ্তদের অভিলাষের পরিতৃপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করে। অথবা কথাটা ঘুরিয়ে বলা যায়, আত্মতুষ্টির নিশ্চয়তা বিধানের বিষয়টি, অনেক দিক থেকেই ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল।
রাজ্য (State) পর্যায়ে চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির সময় প্রতিনিধি সম্মেলনে লেনোইর (১৮২২-১৯০০) মানুষের প্রকৃতিপ্রদত্ত স্বভাবধর্মের বৈশিষ্ট্যকে এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘আমরা মানুষের অধিকার রক্ষণের লক্ষ্য অর্জনে মানবপ্রকৃতির লাম্পট্য, অনৈতিকতা, অপকর্ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অভিলাষ পরিতৃপ্তির বিষয়টি বিবেচনায় আনতে বাধ্য। কেননা, মানুষের এই বৈশিষ্ট্যই তাকে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তার হৃদয়ের মর্মস্থলে সজোরে ধাক্কা দেয় ও অভিলাষ পূরণের বড় উদ্দীপক হিসেবে প্রলুব্ধ করে। সাধারণ মানুষ ক্ষমতাসীনদের ওপর যে অগাধ আস্থা ন্যস্ত করে, সে আস্থাই হলো এই প্রলোভন, যা প্রলুব্ধতার প্রধান কারণ।’ একই সম্মেলনে মানুষের স্বভাবধর্মের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করতে গিয়ে ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০) বলেছিলেন, ‘মানুষের নানা আবেগ-অনুভূতির মধ্যে দু’টি বিষয়ের প্রতি তার প্রবল অনুরাগ থাকে। এর একটি হলো, উচ্চাকাক্সক্ষা বা উচ্চাভিলাষ। আরেকটি হলো অর্থলিপ্সা বা ধনলোভ।’ অর্থাৎ মানুষের চরিত্রের স্বাভাবিক (প্রকৃতিপ্রদত্ত) বৈশিষ্ট্য হলোÑ অতিরিক্ত ক্ষমতা ও ধনলিপ্সা।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এফ এ হায়েকের (১৮৯৯-১৯৯২) মতে : ‘নাগরিকেরা সাধারণত অদূরদর্শী ও ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন। নিজের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রায়ই থাকে না। পরিতাপজনকভাবেই তারা শৃঙ্খলাহীন। আর সব সময় ক্ষণস্থায়ী আনন্দ উপভোগ, ভোগবিলাস, সুযোগ-সুবিধা ও অভিলাষ পূরণে তারা সর্বজনবিদিত রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে থাকেন।’
অ্যারিস্টটল থেকে হবস, লেনেটর লকি, হায়েক মোট কথা সেই সনাতন যুগ থেকে আধুনিক যুগের প্রায় সব ধ্রুপদী দার্শনিক, মানুষের ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের লিপ্সা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সবাই প্রায় একই ধারণা পোষণ করেছেন, প্রকৃতিপ্রদত্ত বৈশিষ্ট্যানুযায়ী সব মানুষ অর্থবিত্ত চাইবে। কারণ, অর্থবিত্তকে সব মানুষ ভালোবাসে। অতএব, বিষয়টি অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। অর্থবিত্ত ন্যায়সঙ্গত উপায়ে ও আইনগতভাবে অর্জন করলে আপত্তি নেই। তবে অর্থ-ধনলিপ্সার এই সমস্যা প্রকট সঙ্কটের আকার ধারণ করে, যখন ক্ষমতার অধিকারীরা (যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বা ক্ষমতাসীন) প্রাপ্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্য মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায় ও তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে এবং প্রাপ্ত ক্ষমতাকে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা, ভোগবিলাস ও ধনলিপ্সা পূরণে ব্যবহার করে। আগেই বলা হয়েছে, ক্ষমতার লাগাম ধরে রাখতে না পারলে চিরাচরিত (প্রকৃতিপ্রদত্ত) বৈশিষ্ট্যানুযায়ী মানুষ (ক্ষমতাপ্রাপ্তরা) সদাসর্বদা তাদের ক্ষমতা আরো বাড়াতে এবং অর্থলিপ্সা ও অভিলাষ পূরণে স্বল্পমেয়াদের জন্য প্রাপ্ত ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। এ জন্যই সমাজের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রায়নের জন্য এক দিকে নাগকিরদের সম-অধিকার ও সার্বভৌমত্বকে যেমন সীমিত রাখা বাঞ্ছনীয়, তেমনি যারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত তাদের ক্ষমতাকে বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত রাখা আরো বেশি বাঞ্ছনীয়। দুঃখের বিষয়, বর্তমান বাংলাদেশে শাসকদের ওপর ক্ষমতা ব্যবহারে একেবারেই কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সংবিধানে বর্ণিত কোনো ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রতিবিধায়কগুলো একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি ছাড়া নাগরিকদের সম-অধিকার দূরে থাক, তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও তারা আজ বঞ্চিত। দেশের ভবিষ্যৎ আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অতীব জরুরি। হ
লেখক : সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই

 


আরো সংবাদ



premium cement
‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

সকল