২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করাই শ্রেয়

-

১৯৬০ সালের ১১ মের কথা। অট্টো অ্যাডলফ আইকম্যান (১৯০৬-১৯৬২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনের দায়ে এদিন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কর্তৃক আর্জেন্টিনা থেকে গ্রেফতার হন। পরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আইকম্যানের বিচারকাজ শুরু হয় এবং তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলেন। এর জের ধরে সে সময়ের ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের সাথে প্রখ্যাত ইহুদি দার্শনিক মার্টিন বুভার সাাৎ কামনা করলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার সাথে দেখা করেন। বুভার প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, তোমরা আইকম্যানকে হত্যা করো না। তাকে মা করে দাও, যেন বিশ্ববাসী জানতে পারে ইহুদিরা মা করতে জানে। বেন গুরিয়ন বুভারের অনুরোধ রাখেননি। আইকম্যানকে ১৯৬২ সালের ১ জুন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দার্শনিকের মানবতাবোধ ও উদারতার পরামর্শ রাজনীতির নিষ্ঠুর বিবেচনার কাছে পরাজিত হলো। রাজনীতিতে নিষ্ঠুরতার কথা সর্বজনবিদিত। আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করি। ভারতের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন কবীর যখন রাজনীতিতে যোগ দিলেন, তখন তার এক বন্ধু আপে করে বলেছিলেন যে, হুমায়ুন কবীর সাহিত্যের নান্দনিক জগৎ ছেড়ে রাজনীতির নিষ্ঠুর জগতে প্রবেশ করলেন। অবশ্য তাকে হত্যার মতো নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হতে হয়নি। রাজনীতি যদিও সৃষ্টির সেরা জীব মানুষই করে থাকে, তবু এ জগৎ আসলেই বড় নির্মম। এ জগৎকে মানবিক করা রাজনীতিকদের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। মানবিকতার স্বার্থে এ চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবেলা করতেই হবে। তা না হলে পৃথিবী একদিন মনুষ্য বাসের অযোগ্য হতে পারে।
আইকম্যানের কথা তুললাম এ কারণে যে, রাজনীতিতে অতীত চর্চা একটি মারাত্মক রোগ। এক জীবনে মানুষের অনেক বিবর্তন ঘটে। যেমন জনশ্র“তি এরূপ যে, হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া এককালে কুখ্যাত ডাকাত ছিলেন। কিন্তু জীবনের একপর্যায়ে এসে তিনি মৃত নারী ধর্ষণের মতো একটি জঘন্য অপরাধে জড়িত অপরাধীকে হত্যা করে আউলিয়ারূপে আবির্ভূত হলেন। এই একটি ভালো কাজ তাকে মানবসমাজের এক অত্যুচ্চ আসনে আসীন করল। আইকম্যানকে মা করে দিলে এবং তিনি বেঁচে থাকলে এই পরিবর্তিত বিশ্বে তিনি কী হতেন, তা আমরা জানি না। হয়তো তিনি ইসরাইলের মহানুভবতার কারণে এ রাষ্ট্রের বন্ধু হতেন। সুতরাং অতীত ক্রিয়াকলাপকে আঁকড়ে ধরে কাউকে বর্তমানে বিচার করা সমীচীন বলে মনে হয় না। মানব চরিত্রের বিবর্তনের দিকটাও একান্ত বিচার্য। আমরা দেখছি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বর্তমানে এসব মানবিক বিষয় বিবেচনায় আনা হয় না। আমরা যদি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ধরি তবে আমরা কী দেখি? প্রথম জীবনে ব্রিটিশ ভারতে তিনি পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছেন। পরবর্তী জীবনে তিনি লড়াই করেছেন গণতন্ত্রের জন্য। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে তিন বছর পরই একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করলেন। মরহুম জিয়াউর রহমানের কথাও বলা যায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। পরবর্তী জীবনে সমরনায়ক হওয়া সত্ত্বেও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করলেন। দুইজনের জীবনেই কালের যাত্রায় বিবর্তন ঘটেছে। এটাই মানব জীবন। এক পর্যায়ে রাজনীতির নিষ্ঠুর খেলায় উভয়েই আততায়ীর বুলেটের আঘাতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হলেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি অতীত চর্চানির্ভর। অতীতের প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে। এ দু’টি দলের েেত্র এটা বহুলাংশেই সত্য। দুই দলেরই অতীত কমবেশি কেদাক্ত। এমনো মনে হয় অতীত বিচার করলে তাদের কেউ রাষ্ট্রীয় মতায় আসার পুরোপুরি উপযুক্ত নয়। কিন্তু জনগণ এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় বলে মনে হয় না। যেহেতু অদ্যাবধি মতায় আসার মতো দেশে আর কোনো দল নেই, যারা দেশের সরকারের হাল ধরতে পারে, তাই এ দুই দলই ঘুরেফিরে মতায় আসে। জনগণের কাছে তাদের জনপ্রিয়তাও প্রশ্নাতীত। তাই কাকে ঠেলে কে মতায় আসবে এ প্রতিযোগিতাও তীব্র এবং ত্রে বিশেষে কুৎসিত। যেহেতু প্রধান দু’টি দল প্রবল, তাই তাদের মধ্যে মতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা যাই বলি না কেন তা হিংসাত্মক রূপ ধারণ করেছে। যে দলই মতায় থাকে সে দলই অপরের মতায় আসার পথ ছলে-বলে-কলে-কৌশলে রুদ্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে। ত্রেবিশেষে সহিংসতার আশ্রয়ও গ্রহণ করে। এতে বিদেশীদের লাভ। এরা ডিভাইড অ্যান্ড গেইন পলিসিটা কাজে লাগাতে পারে। প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে দেশে যে বিভেদ সৃষ্টি হলো তাতে আধিপত্যকামী বহিঃশক্তির লাভ হয়েছে; সে দেশ এ দেশের রাজনীতিতে ‘ডিভাইড অ্যান্ড গেইন পলিসিটা’ কাজে লাগাতে পেরেছে। তবে সত্য হলো, আওয়ামী লীগের দূরদর্শী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্তদের বাদে অন্যসব স্বাধীনতাবিরোধীর জন্য সাধারণ মা ঘোষণা করেছিলেন। তবু আওয়ামী লীগ মুজিব-উত্তর যুগে মতায় এসে নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেমিক ও নির্দোষ সদস্য সংবলিত কোনো কোনো দলকে বিলুপ্ত করার উদ্যোগ নিতে গিয়ে প্রমাণ করল, বাংলাদেশীরা মা করতে জানে না। তবে আজকের বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতির চাপে পরামর্শ দেয়ার মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় মার্টিন বুভারের মতো দার্শনিক ব্যক্তিত্বও নেই।
ব্যাপারটা এখানেই যদি শেষ হতো তবু একটা কথা ছিল। জামায়াতের সাথে সংযোগ রাখায় বিএনপির মতো একটি জনপ্রিয় দলকেও মাশুল দিতে হচ্ছে। তবে সত্য এই যে দেশে এমনো আন্দোলন হয়েছে যাতে বিএনপিকে বাদ দিয়ে ওই দল আওয়ামী লীগের সাথে শামিল হয়েছিল, এমনকি বিএনপির বিরুদ্ধেও। তখন এ দল দেশপ্রেমিক হিসেবে গণ্য হয়েছে, অর্থাৎ এ দল আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে ‘দেশপ্রেমিক’ কিন্তু বিএনপির সাথে থাকলে ‘যুদ্ধাপরাধী’ বিশেষ একটি মহল আওয়ামী লীগকে নানাভাবে ব্যবহার করে। লোকজন বলে, পড়শি দেশে তাদের খুঁটি এবং মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামী লীগ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল বলে তারা আওয়ামী লীগ মতায় এলে বেশ কিছু সুবিধা নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। আমার কথা হচ্ছেÑ যারা অতিরিক্ত অধিকারসচেতন, তারা সমান অধিকারের চেয়েও বেশি কিছু চায়। সেটা তাদের যে দল বা ব্যক্তি দিতে প্রস্তুত নয়, তাদের সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করতে কুণ্ঠাবোধ করা হয় না। এ দিকে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বাংলাদেশী মুসলিম সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার পথে। স্মর্তব্য, বর্ণবৈষম্যের কারণে ব্রিটিশ আমলে অনেকেই খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও মুসলমান হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা নয়, কারণ মুসলমানদের সাম্যের সুনির্দিষ্ট জীবন বিধান আছে; তা তাদের মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। পার্থক্যটা এখানেই। সে যাই হোক, যে কারোর প্রাপ্যটা শরিয়ত মোতাবেক মুসলমানেরা দিতে কুণ্ঠিত নয়।
পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে গৌণ করে দিচ্ছে। একটা সময়ে যখন মুসলিম সমাজে কুরআন হাদিসের চর্চা ছিল, ঘরে ঘরে ছিল কুরআন তেলাওয়াত ও নামাজের প্রচলন। তখন মানুষের মধ্যে অর্থলিপ্সা এত প্রবল ছিল না। দয়া মায়া মা ইত্যাদি মানবিক গুণগুলো সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এগুলো আমাদের জীবনকালেই দেখেছি। অথচ সমাজে আজ ইহুদি শাইলকের তত্ত্বই প্রাধান্য বিস্তার করছে। তাই আজ আমরা তাদেরও দণ্ড দিতে পিছপা হই না যারা এ দেশের মানুষের একদিন উপকার করেছিল। বাস্তবতা হলো, সব দেশেই ইতিহাসটা বিজয়ীদের হাতে লেখা হয়। যে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের ও ভারতকে খুশি করার জন্য অনেক কিছু করেছে, এ দলের সদস্যদের অনেকে তাদের সম্পত্তি দখল করেছে। তাই বলছি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের অতীত খুঁজতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুবে। বিচার বিবেচনার প্রোপটও বদলে যাবে। তাই প্রতিশোধ ও হিংসার পথে না হাঁটাই ভালো।হ

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিা ক্যাডার


আরো সংবাদ



premium cement