২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ও রাসিক নির্বাচন

-

আসন্ন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বলতে গেলে, আইনজীবীদের জন্য রয়েছে ‘সুখবর’। কারণ, দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন এলএলবি ডিগ্রিধারী। একজনের আইন পেশার সনদ থাকা সত্ত্বেও আদালতে খুব বেশি দিন যাননি। অপরজন এলএলবি ডিগ্রি থাকলেও আইন পেশার সনদ পাননি। অন্যজন হলেনÑ অ্যাডভোকেট মুরাদ আহমদ। তাকে অনেকবার রাজশাহী বারে দেখেছি। বেশ বিনয়ী, ভদ্র, সদালাপী হলেও কথাবার্তায় তার দলের নেতা জুনায়েদ সাকীর মতো এতটা বাকপটু নন। প্রথম দিকে তার মনোনয়ন বাতিল হলেও পরে আপিল করে মনোনয়ন ফেরত পেয়েছেন। আমিও চাই, তাকে ঘিরে রাজশাহী মহানগরে একটা তৃতীয় ধারা সৃষ্টি হোক।
৩০ জুলাইয়ের পর জানা যাবে, কে হবেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র বা নতুন কর্ণধার। আমাদের দেশে ভোট মানেই এক ধরনের অঘোষিত উৎসব। কিন্তু এ দেশে সেই গণতান্ত্রিক উৎসবের অপমৃত্যু ঘটেছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর। এ ‘গণবিধ্বংসী’ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আরো কর্তৃত্ববাদের পথে দ্রুত হেঁটে যায়। এই অপযাত্রাকে রুখে দেয়ার মতো কোনো কার্যকর আন্দোলন বিরোধী দল বিএনপি ও এর জোটভুক্ত দলগুলো গড়ে তুলতে পারেনি। মোটামুটি বলা যায়, এ ব্যর্থ আন্দোলনের জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে প্রধানত রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকেই। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এক অদ্ভুত হাস্যকর মামলায় এখন জেলে রয়েছেন। অনেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, এ মামলার বিচারিক আদালতের রায় ও উচ্চতর আদালতের ভবিষ্যৎ রায় আইনের ছাত্রদের জন্য অন্য রকম শিক্ষণীয় হতে পারে। যেভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (ঢাকা ল রিপোর্ট ১৫-পৃ. ৫৪৯- হাইকোর্ট ডিভিশন।) দুর্নীতির আপিল মামলার বিচারপতি মোহাম্মদ আসির (আইনজীবী ড. মোহাম্মদ জহির এবং রাষ্ট্রদূত, সাবেক তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ জমিরের পিতা) রায় দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে নি¤œ আদালতের বিচারক আবদুল মওদুদ দুই বছরের জেল-জরিমানার আদেশ দিলেও; বিচারক বাদে সেই সময় সবাই জানতেন, তিনি ছিলেন নির্দোষ। এই রায় শুনে মুজিব বলেছিলেন, ‘এভাবে মন্ত্রীদের জেল দিলে ভবিষ্যতে কেউ মন্ত্রী হতে চাইবেন না।’ তাই আমাদের বিশ্বাস, আপিলে বেগম খালেদা জিয়া খালাস পাওয়ার কথা।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার অনেক আগেই আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। শহরের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যক্তিরা জানতেন, লিটনই হচ্ছেন সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী। গতবারের নির্বাচনের পরাজয়ের পর তিনি নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো সুধরে নিচ্ছিলেন। গণসংযোগের মাত্রা আগের তুলনায় বাড়িয়ে দিলেন। আগের নির্বাচনে খায়রুজ্জামানের পরাজয় ছিল তার রাজনৈতিক জীবনে একধরনের বজ্রাঘাত। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ পরাজয়ের কারণগুলো একাধিকবার বিশ্লেষণ করেছেন। কোনো কোনো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিজের দলের নেতাকর্মীরাই তাকে ভোট দেননি। আবার কেউ কেউ হেফাজতে ইসলামের ওপর তৎকালীন সরকারের অন্যায় আক্রমণকে এ জন্য দায়ী করেছেন। এটুকু বলা যায় যে, ওই নির্বাচনের পর জাতীয় নির্বাচন খানিকটা নিরপেক্ষভাবে হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হতো। লিটন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৫ (২০০৮-২০১৩) বছর মেয়াদে মেয়র থাকাকালে অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে বলে তার দলের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয়। কিন্তু সেই উন্নয়নের গতি পরে বজায় থাকেনি। গতবারের মতো এবারও কথিত উন্নয়ন ম্যানিফেস্টকে আশ্রয় করে নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার পদ্ধতি বেছে নেয়া হয়েছে। বিগত মেয়র বুলবুল যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছেন একনজরে সেগুলোর দিকে চোখ ফেরানো যাক : ক. তিনি নির্বাচিত হলে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান করবেন। খ. বাড়ি বাড়ি গ্যাস দেয়ার ব্যবস্থার প্রকল্প চালু করবেন, যা এখন বন্ধ রয়েছে। গ. শহরের এলাকায় ৫০টির মতো গার্মেন্টস কারখানা চালু করবেন।
মাস তিনেক আগে রাজশাহী মহানগরীতে আনাচে-কানাচে এ প্রচারের পোস্টার, ব্যানার ও বিলবোর্ড ছড়িয়ে যায়। তবে পদত্যাগী মেয়রের শুভেচ্ছাবাণীর বিলবোর্ড পর্যন্ত রাতের অন্ধকারে কে বা কারা সরিয়ে ফেলেছে। এর প্রতিবাদে তাকে রাস্তায় নামতে হয়। কোনো রকম বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ক্রমান্বয়ে শিকার হলেন সরকারের হিংসাত্মক মামলা-হামলায়। ৬০ মাসের মধ্যে ২২ মাস থেকেছেন ক্ষমতার বাইরে। পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ হত্যা মামলায় থাকলেন সাত মাস জেলে। ওই মামলাসহ এখনো তার বিরুদ্ধে বারোটি মামলা চালু রয়েছে। বেশ কিছু দিন আগে একটি মামলায় খালাস পেয়েছেন।
এ ২২ মাসে রাজশাহী সিটি করপোরেশনে চলছে অপশাসনের নানা কর্মকাণ্ড। কাউন্সিলর নিযামুল আজিম প্যানেল মেয়র না হওয়া সত্ত্বেও বেআইনি সিদ্ধান্তে হয়ে গেলেন ‘ভারপ্রাপ্ত মেয়র’। আসল প্যানেল মেয়রকে ভয় দেখিয়ে পদত্যাগ করানো হলো। আলাপ-আলোচনা ব্যতিরেকে অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিলেন হোল্ডিং ট্যাক্স। প্রতিবাদে উত্তাল হলো মহানগরবাসী। লিটন বাদে আওয়ামী লীগের একাংশ ভারপ্রাপ্ত মেয়রের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে বাধ্য হন। বলাবাহুল্য, ২২ মাস পরে বুলবুল সমস্যাকীর্ণ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দায়িত্বভার নিয়ে বিপদে পড়ে গেলেন। সিটি করপোরেশনের এখন প্রায় ৫০০ স্থায়ী কর্মচারী ও দুই হাজার অস্থায়ী কর্মচারী। তাদের বিশাল ব্যয়ভার বহন করার জন্য সরকারি অনুদান মাঝে মধ্যে বন্ধ ছিল। কোনো কোনো সময় কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন। শেষাবধি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল সুনিপুণভাবে সমস্যা মিটিয়েছেন। এ পর্যন্ত ৪২০ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চালু করেছেন।
এবার রাজশাহী মহানগরীর বাসিন্দারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন বিরোধী দলের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে। এ অবস্থার মধ্যে আগামী ৩০ জুলাই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। কিন্তু শহরবাসীর বেশির ভাগ অন্য জায়গায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছেন। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, গাজীপুরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর বিএনপি হয়তো রাসিক নির্বাচন বর্জন করবে। পরে দলীয় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। নেতারা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু গাজীপুরের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন কার্যত সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে উপহার দেয়া হয়েছে প্রহসনের নির্বাচন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, পুলিশ বাহিনী এখন নির্বাচন পরিচালনা করছে। তার মধ্যে পুলিশ সুপারের ভূমিকাই থাকছে প্রধান। তবে অনেক মহানগরবাসী ভাবতে শুরু করেছেন, গাজীপুরের পরে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভোট জালিয়াতির ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত হবে কি না। এটা প্রতিহত করার বিষয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা সজাগ হচ্ছেন বলে মনে হয় না। সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু ও সদ্য পদত্যাগী মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেছেন, তারা জীবন দিয়ে হলেও ভোটডাকাতি প্রতিহত করবেন। এ প্রতিজ্ঞা কতখানি রক্ষা করা যাবে তা বলা মুশকিল। রাজশাহীর অসংখ্য বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। তারাও আশঙ্কা করছেন, যেকোনো মুহূর্তে নতুন মামলা দিয়ে তাদের আবার গ্রেফতারের মুখোমুখি করা হবে। এমনকি মাদকবিরোধী অভিযানকে ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না সরকার। গুমের ঘটনাও ঘটতে পারে। ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে থাকতে থাকতে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন প্রায় উত্তাপহীন। অনেককে বলতে শুনেছি, এখনকার পুলিশ-র‌্যাবরা সরাসরি গুলি করতে খুব পটু। এ রকম ভয়াবহ দুঃশাসনের অবস্থা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কখনো দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আগের তুলনায় বেশ বেপরোয়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনের নেতা তরিকুল ইসলামকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর ঘটনা প্রমাণ করছেÑ জয়ের জন্য ‘যা দরকার তাই করা হবে’। আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী বলছেন, লিটনের বিজয়ের বিষয়ে তারা শতভাগ নিশ্চিত। কারণ, তাকে ভোট দিলে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। গতবারের মতো রাজশাহীবাসী এবার সেই মহাভুল করবে না। ভুলের মাশুল তারা পেয়েছে। তাদের প্রার্থীকে ভোট না দিলে উন্নয়ন হবে না, এ টোপ অনেক ভোটার হয়তো গিলে ফেলেছেন। এ দিকে, সর্বত্রই সাজ সাজ রব। রাজশাহী মহানগরবাসী বলছেনÑ এত পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনের আগে তারা কখনো দেখেননি। বিএনপির নেতারা ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনারের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, তাদের পোস্টার লাগানোর কোনো জায়গা নেই। পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করার অভিযানও শুরু করেছে বলে অভিযোগ করেছে। তবে বরাবরের মতো আওয়ামী লীগ নেতারা তা অস্বীকার করে বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা তাদের জানা নেই। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন একেবারেই নীরব এবং এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। নীরবতাই যেন নির্বাচন কমিশনের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আশঙ্কার আরেক কারণ দেখা দিয়েছে; তা হলোÑ খাইরুজ্জামান লিটনের হুঁশিয়ারি। তিনি বলেছেন, ‘মিথ্যা প্রচার চালালে তার দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে।’ (প্রথম আলো, বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন, ২০১৮) নির্বাচনে মিথ্যা প্রচার বলতে কী বুঝাবে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। সত্যিই যদি মিথ্যা প্রচার কেউ করে তা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আওয়ামী লীগ নিজ হাতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ‘দাঁতভাঙা’র কাজ নিতে পারে না। আমরা লিটনকে ভদ্র বলেই জানি। তিনি কেন এ ধরনের মন্তব্য করছেন তা বোধগম্য হচ্ছে না। উন্নয়নের দশকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিল রাজশাহীবাসী, তবে এ নেতৃত্বে সে দিন কোনো ভোটডাকাতির নায়ক ছিল না। হ
লেখক : কবি ও সাহিত্য সমালোচক, আইনজীবী, রাজশাহী


আরো সংবাদ



premium cement