২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হ্যামার থেরাপি ও শিক্ষকের অভিজ্ঞান

-

আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করলেও সঙ্কট ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে পশুশক্তির ওপর মনুষ্যত্বের যে প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার কথা, তা কিন্তু কাক্সিক্ষত পরিসরে হচ্ছে না। স্খলনের গতি ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না। বিশেষ করে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে এই অবনমন রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। সুতরাং আমরা এই অধোগতির ধারায় সব কিছু হারিয়ে এখন প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছি। চাকচিক্য ও জৌলুশ বেড়েছে, কিন্তু তা একেবারেই অন্তঃসারশূন্য। আর সেটিই আমাদের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের, হতাশার ও দুর্ভাগ্যের।
মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মনে করা হয়। তাই এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবির যথার্থতা প্রমাণের জন্য মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলোও শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া দরকার। ক্ষেত্রবিশেষে আমরা পশুত্বেরও নি¤œপর্যায়ে নেমে গেছি। এর জ্বলন্ত প্রমাণ হলো সর্বসাম্প্রতিক সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ। মানুষের ওপর মানুষের নির্মমতা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে না। রাজপথে মানুষকে নির্মমভাবে পেটানো ও কুকুরের ব্যর্থ প্রতিবাদের একটি ভিডিও ফুটেজ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মানবতার এর চেয়ে বড় অপমান আর কী-ই বা হতে পারে?
আইনের শাসনের পরিবর্তে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার অভিনব সংস্কৃতি চালু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য এবং সব সমস্যা সমাধানে হ্যামার থেরাপির যথাযথ প্রয়োগ শুরু হয়েছে। গণতন্ত্রের পরিবর্তে এখন হাতুড়িতন্ত্র, লাঠিতন্ত্র ও পিটুনিতন্ত্র সেই স্থান দখল করে নিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের মানবীয় মূল্যবোধ পশুত্বেরও নি¤œপর্যায়ে নেমে গেছে। তাই তো ‘বড়ই বিচিত্র ও নির্মম আমাদের এই মাতৃভূমি’ এমন খেদোক্তি এখন সচেতন মানুষের মুখে মুখে। এ ক্ষেত্রে যাদের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা, তারাই নির্লিপ্ত ও উদাসীন। তাই দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়ছে না।
আমাদের দেশ সাংবিধানিকভাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ হলেও আমরা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চায় বৈশি^ক মানদণ্ডে অনেক পিছিয়ে পড়েছি। আর এই অধোগতি এতই প্রবল, এখনই তার লাগাম টেনে ধরা না গেলে অদূরভবিষ্যতে আমাদের জাতি যে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে তা নিশ্চিত। এটিই আমাদের জাতীয় জীবনের প্রধান সমস্যা। গণতন্ত্রের পরিবর্তে সেখানে স্থান করে নিয়েছে ব্যক্তিতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র ও পেশিশক্তি নির্ভর অপরাজনীতি। অতীতে গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতির অভিযাত্রা শুরু হলেও আমাদের দেশের রাজনীতি এখন এক শ্রেণীর মানুষের উচ্চাভিলাষ ও আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ার হয়ে গেছে।
মূলত নেতিবাচক ও আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতিই আমাদের জাতীয় জীবনের মহাসর্বনাশ করেছে। রাজনীতিতে মানবিক মূল্যবোধ বরাবরই উপেক্ষিত ও অবহেলিত। একবিংশ শতাব্দীতে এসে অপরাপর জাতিরাষ্ট্র যখন গণতান্ত্রিক পরিসরে এগিয়ে চলছে, তখন আমাদের এই মানসিকতা ভাবনার বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রে অন্যতম প্রধান উপাদান হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। আমাদের দেশের গণতন্ত্র গলাবাজিতে সীমাবদ্ধ। আর এই গলাবাজির প্রতিধ্বনিও দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করছে।
আমাদের দেশের সংবিধানে সব নাগরিকের জন্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং রাজপথে কর্মসূচি পালন তথা সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের অধিকার স্বীকৃত। সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদে নাগরিকদের এসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিক্ষুব্ধ হওয়া যেমন প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার, তেমনিভাবে তার প্রতিবিধান চেয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনও অসাংবিধানিক নয়। নাগরিকের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের। যেহেতু সরকার রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে, তাই দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। কিন্তু আমরা এ দেশে দেখছি ভিন্ন চিত্র। রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না বা দিচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রই যে জননিরাপত্তায় বিঘœ সৃষ্টি করছে, এ কথার অনুকূলে প্রমাণাদিও বেশ স্পষ্ট। রাষ্ট্র একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হলেও স্বার্থদুষ্ট রাজনীতিকদের কারণে রাষ্ট্র তার মানবিক বৈশিষ্ট্য ও গণতান্ত্রিক চরিত্র প্রায় হারাতে বসেছে।
সরকারি চাকরিতে কোটাবিধি সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্রদের চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের কথা কারো অজানা নয়। তাদের দাবি কতখানি যৌক্তিক, সে দিকে না গিয়েও বলা যায়, এই আন্দোলন করার অধিকার তাদের আছে। অবশ্যই সরকার প্রথম দিকে এই দাবি নিয়ে বেশ প্রশংসা পেলেও সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। বাস্তবে যা দেখা যাচ্ছে তাতে সরকার যে ভূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, এতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ, জনশ্রুতি আছে, ভূতের নাকি পেছনে পা। তাই এই দানব প্রজাতি কখনো সামনের দিকে চলতে পারে না। সব সময়ই এদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে দেখা যায়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে সরকার সেই উল্টো রথেই যাত্রা শুরু করেছে। তারা ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে এখন পৃষ্ঠ প্রদর্শনের কসরত করছে বলেই মনে হচ্ছে। সরকার প্রকারান্তরে আগের অবস্থান থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে। এমন কিছু আচরণ করছে, যাতে এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, সরকার কোটাবিধি সংস্কার বা বাতিল কোনোটাতেই আন্তরিক নয়, বরং তারা কালক্ষেপণের পথই বেছে নিয়েছে। তারা যেকোনো মূল্যে শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক দাবিকে পাশ কাটাতে চাচ্ছে। আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারি ছত্রছায়ায় হামলা ও মামলার বিষয় সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
শিক্ষার্থীরা বোধহয় সরকারের এই মনোভাব ভালোভাবেই বুঝে ফেলেছিল। তাই তারা দাবি আদায়ে নতুন করে কর্মসূচি গ্রহণের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু সরকার তাদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকেও স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। তাই যা পরিণতি হওয়ার তাই হয়েছে, বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠত নেই, সরকারই সে কথার প্রমাণ দিয়েছে। কারণ, তারা ছাত্রদের ন্যায্য দাবির আন্দোলন দমাতেও সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছেন। আন্দোলনকারীরা যখন সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল, তখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন এসব ছাত্রের ওপর প্রকাশ্যেই হামলা চালিয়েছে। ঘটনা শুধু ঢাকায় ঘটেনি, বরং এই ছাত্রসংগঠনের হামলা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি তাদের কর্মীরা রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকারীদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়েছে। মানুষের ওপর মানুষের হাতুড়ির ব্যবহার অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি। এমন নির্দয় ও নিন্দনীয় কাজ করাও তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করতে দেখা যায়নি, বরং গণমাধ্যমে এই হামলার যথার্থতা প্রমাণের জন্য নির্লজ্জভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করা হয়েছে।
কোটা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ক্ষমতার মদদপুষ্ট ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর অন্তত ১৩ বার হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে, যাতে কমপক্ষে ৭০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বা পুলিশ প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, বরং তারা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোটা আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা এখন প্রায় সবাই জেলে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা দিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছে, এগুলোর প্রায় সবই মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবেই মনে করছে জনগণ। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসন এখন তাদের বিরুদ্ধেই খড়গহস্ত। অথচ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে এসব বিষয়ে রহস্যজনকভাবে নীরব। তাদের একই কথা, এসব ঘটনায় কেউ মামলা দায়ের করেনি। কেউ মামলা না করলেও পুলিশের মামলা করার এখতিয়ার আছেÑ এ কথা তারা সচেতনভাবে চেপে যাচ্ছেন।
কোটা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার যে অবস্থান গ্রহণ করেছে, গণতান্ত্রিক ও সভ্যসমাজে এমনটি কিছুতেই কাক্সিক্ষত নয়। সরকার কোটা আন্দোলন দমাতে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চরম ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এখন ক্যাম্পাসে যেতে ভয় পায়। কখন আবার কার ওপর হামলা শুরু হয়Ñ এই ভয়ে তারা এখন তটস্থ। কর্তৃপক্ষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই আশ^স্ত করতে পারছে না। ঢাবি প্রশাসন ক্যাম্পাসে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার পরিবর্তে নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। এমনকি খোদ ভিসি কোটা আন্দোলনের কর্মকাণ্ডকে জঙ্গিবাদী আচরণ হিসেবে আখ্যা দিয়ে লোক হাসিয়েছেন। তারা এর মাধ্যমে তিনি নিজের পদমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের প্রতি অমর্যাদাই প্রদর্শন করেছেন। তিনি দাবি করে বসলেন, কোটা আন্দোলনকারীদের আচরণ জঙ্গিবাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। কিন্তু তিনি একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক হিসেবে এ কথা বললেন না যে, কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর বাঁশের লাঠি, ধারালো ছুরি ও হাতুড়ি দিয়ে হামলা চালিয়ে একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর পা ভেঙে দেয়া কিসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মেধাবী শিক্ষার্থী মরিয়ম মান্নান ফারাহ ছাত্রলীগ কর্তৃক ও পুলিশের হেফাজতে নাজেহাল হওয়া এবং নির্মমতাকে তিনি কিভাবে দেখেন, এ বিষয়েও তার কোনো বক্তব্য নেই কেন? হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হলো না, অথচ বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি থেকে এ বিষয়ে আজো বক্তব্য আমরা পেলাম না। ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানমাফিক, ১১ জন হামলাকারীর মধ্যে ১০ জনই সরকারি দলের নেতাকর্মী। ভিসি এ বিষয়ে নীরব থাকা দুঃখজনক?
গণতন্ত্রের পরিবর্তে হাতুড়িতন্ত্র চালু হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা না করে এখন ‘হ্যামার থেরাপি’র মাধ্যমে সব কিছুর দফারফা করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছাত্রদের জঙ্গি বানাচ্ছেন কার স্বার্থে? তিনি আসলে কার প্রতিনিধিত্ব করছেন? তোপের মুখে তিনি বলেছেন, তিনি শিক্ষার্থীদের জঙ্গি বলেননি, বরং তাদের কাজকে জঙ্গিবাদের সাথে তুলনা করেছেন। গণমাধ্যম নাকি তার বক্তব্যকে ‘যথাযথভাবে প্রকাশ করেনি’। কিন্তু এই বক্তব্য এক শ্রেণীর রাজনীতিকদের বক্তব্যের সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ। কারণ, তারা বেফাঁস মন্তব্য করে বেকায়দা দেখে গণমাধ্যমের ওপর দোষ চাপিয়ে বসেন।হ
smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement