২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মালয়েশিয়ার ‘বার্লিন ওয়ালের’ চূড়ান্ত পতন

-

মালয়েশিয়ার জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি গত সপ্তাহে বারিসান ন্যাসিওনেলের (ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা বিএন) ৬১ বছরের ক্ষমতার শক্ত ভিতকে উপড়ে ফেলেছে। বিএনকে পরাজিত করে জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধন করেছে। ইতিহাসের শুরুতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, আমাদের নিজেদের বার্লিন ওয়াল যেন চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়েছে। ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের দেশ কেবল একটি প্রভাবশালী দল দিয়েই পরিচালিত হয়ে আসছে। বিএন ধারাবাহিকভাবে (পরপর) ১৩টি সাধারণ নির্বাচনে ‘জয়লাভ’ করেছে।
গত তিন দশকে বিশেষভাবে, মালয়েশিয়ার মানবাধিকার রেকর্ড অধিকতর খারাপের দিকে গেছে। ওই সময় মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা ব্যাপক দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন। মালয়েশিয়া অত্যন্ত দুর্নীতিবাজ দেশগুলোর মধ্যে স্থান লাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক পরিণত হয়েছেন ১-এমডিবি দুর্নীতি কেলেঙ্কারির মধ্যমণিতে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই কেলেঙ্কারিকে মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট ‘ইতিহাসের বৃহত্তম চৌর্যবৃত্তির ঘটনা বলে বর্ণনা করেছে।
আমার বাবাকে (সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম) ১৯৯৮ সালে তার সংস্কারবাদী ও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের জন্য বরখাস্ত করা হয়। এরপর তাকে বানোয়াট অভিযোগে চরম মিথ্যা ও ত্রুটিপূর্ণ বিচারের মাধ্যমে কারারুদ্ধ করা হয়। একবার নয়, দুইবার এবং রাজনৈতিকবন্দী হিসেবে তার জীবনের মূল্যবান ১১টি বছর তাকে কারাগারে কাটাতে হলো। মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করার পর তিনি জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারের দাবিতে গণ-আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে তখন মালয়েশিয়ার লাখ লাখ মানুষ দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিল।
আমার বাবাকে আমাদের বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক দিন ধরে আমরা তার খোঁজ পাইনি। পুলিশের তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল যেদিন তাকে গ্রেফতার করা হয়, সে দিনই শারীরিকভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এসব ঘটনা যখন ঘটে তখন আমার বয়স ১৮ বছর। সে সময় আমি এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কয়েকজন- যে স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে গোটা জাতিকে জিম্মি করে ফেলেছে- তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সংস্কার আন্দোলনে যোগদান করেছি। যাই হোক না কেন, এ দাঙ্গাহাঙ্গামাপূর্ণ অবস্থার সত্যিকারের শিকার হয়েছে মালয়েশিয়ার জনগণ। বেকারত্ব এবং জীবনযাপনের ব্যয়ভার বৃদ্ধির কারণে মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষ দুঃখ-দুর্দশা ও নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়। বিএন সরকার হীনপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর অধিকতর চরমপন্থীদের উসকে দেয়ার কারণে ক্রমবর্ধমান বহু জাতিগোষ্ঠীর এ সমাজে জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
আমাদের আন্দোলন শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন। আমরা আমাদের দেশ মালয়েশিয়া এবং বিদেশেও গণতান্ত্রিক সংস্কার আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একত্রে প্রচারণা চালাই। মালয়েশিয়ায় গত ২০ বছরের অবনতিশীল পরিস্থিতির কারণে দেশটির বহু নাগরিক বিদেশে চলে গেছেন। সারা বিশ্বে তারা সক্রিয়। বিদেশে অবস্থানরত এসব মালয়েশীয় নাগরিক একটি আন্দোলন শুরু করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তারা বিভিন্ন দেশের সরকার এবং জাতিসঙ্ঘকে মালয়েশিয়া সরকারকে জবাবদিহি করতে চাপ দিয়েছে। এ জন্য তারা একটি আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলে। বিদেশে অবস্থানরত মালয়েশিয়ার হাজার হাজার নাগরিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। প্রবাসীদের মধ্যে অনেকেই নির্বাচনী প্রচারণার অংশগ্রহণের জন্য দেশে চলে আসেন। অন্যরা পোস্টাল ভোটিংয়ের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন।
মালয়েশিয়ার নির্বাচনে অন্যায় প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশটির জনগণ ৯ মে ব্যালটবাক্সে একটি রাজনৈতিক সুনামি সংঘটিত করেছে। পাকাতান হারাপান (কোয়ালিশন অব হোপ) পার্লামেন্টের ২২২টি আসনের মধ্যে ১১৩টিতে জয়লাভ করেছে এবং একটি নতুন সরকার গঠনের জন্য ৪৬ শতাংশ ভোট অর্জন করে।
আশা-আকাক্সক্ষার একটি নতুন রাজনীতি জেগে উঠছে। মালয়েশীয়রা এ সুনামির মাধ্যমে শুধু নিজেদের দেশ ও জাতিকেই জাগিয়ে তোলেনি, সাথে সাথে তারা গোটা বিশ্বের মানুষকেও জাগিয়ে দিয়েছে। অন্ধকার দূরীভূত করে সত্য, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়েই এটা করা সম্ভব।
সামনের পথ এখনো অনেক দীর্ঘ। ছয় দশকের দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে অনেক কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, সাবেক নেতা মাহাথির মোহাম্মদ যিনি বাবাকে ১৯৯৮ সালে বরখাস্ত করে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, তার সাথে আমাদের সংস্কার আন্দোলনের একাত্মতা কিভাবে হবে? এ ব্যাপারে আমার সরল জবাব হচ্ছেÑ আমাদের দেশ ও জাতি যাতে আর কখনো ডুবে যেতে না পারে, সে জন্য অবশ্যই দৃঢ়তার সাথে কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে। মাহাথির মোহাম্মদ সঠিকভাবে সব কিছু করার জন্য এখন ব্যতিক্রমধর্মী হিসেবে দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়েছেন। বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। আমাদের অবশ্যই ব্যাপক সংস্কারের প্রতিশ্রুতিগুলো এবং নির্বাচনী চুক্তি পূরণ করতে হবে।
মালয়েশিয়ার জনগণ অবশ্যই আর কখনো সরকারকে ভয় পাবে না। আমরা একটি শক্তিশালী, পরিবর্তনশীল গণতন্ত্র চাই, যেখানে দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স থাকবে এবং মানবাধিকারকে সমুন্নত করা হবে। আমরা চাই, এমন একটি সরকার যেটি নীতি আদর্শ এবং কর্মপন্থা ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। আমরা মালয়েশিয়ার সাবেক নেতার চুরি করা শত শত কোটি ডলার এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাবে জমা করা অবৈধ অর্থ, স্বর্ণমুদ্রা ও বিলাসবহুল হ্যান্ডব্যাগ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় তহবিলে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং একটি খোলামেলা, স্পন্দনশীল বা পরিবর্তনশীল বহুমুখী সংস্কৃতির সহিষ্ণু সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সবার জন্য সত্য, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং আইনের শাসন সমুন্নত থাকবে।হ
লেখক : নূরুল ইজ্জাহ আনোয়ার : পারমাতাং পাউহ আসন থেকে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি দেশটির সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের মেয়ে। তার মা ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাঈল এখন দেশটির ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী।
Ñদ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর
করেছেন মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement