০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ঢাকা হোক বসবাসযোগ্য

- প্রতীকী ছবি

লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা ইআইইউ বাসযোগ্যতা নির্ণয়ে বিশ্বের ১৪০টি শহরের তালিকা গত বছরের ১৪ আগস্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে এবারো দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।

তাদের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের বাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে প্রথম ১০টি হলো- অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, জাপানের ওসাকা, কানাডার ক্যালগেরি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, জাপানের টোকিও, কানাডার টরন্টো, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড। এর বিপরীতে বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর প্রথমেই সিরিয়ার দামেস্ক। তালিকার পরবর্তী শহরগুলো হলো- আমাদের ঢাকা, নাইজেরিয়ার লাগোস, পাকিস্তানের করাচি, পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোর্স বি। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় বহুমুখী যুদ্ধ চলছে। বিমান হামলা, বোমা বিস্ফোরণ, এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারও হচ্ছে সেখানে। ফলে বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় দামেস্কের এক নম্বরে থাকা অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু আমাদের স্বপ্নছোঁয়া উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী ঢাকা, বছরের পর বছর বসবাস-অযোগ্য শহরের তালিকার তলানিতে থাকা জাতির গভীর বেদনা আর শঙ্কা তৈরি করে।

যদি সিরিয়ায় যুদ্ধ না থাকত, তবে ঢাকা বসবাস-অযোগ্য নগরীর তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করত, এই ভাবনাও আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। ‘রাজধানী ঢাকা’ আর ‘নাগরিক সমস্যা’ সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে বহু আগেই। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী দখলদারিত্বের কবলে পড়ে আবদ্ধ জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে।

নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে দুর্বিষহ যানজট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সঙ্কট, পয়ঃনিষ্কাশনের জটিলতা, দুর্গন্ধময় ও বিষাক্ত বাতাস, দূষিত পরিবেশ, অত্যন্ত ঘনবসতি, ভেজাল খাবার, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্দশা, জলাবদ্ধতা, ফুটপাথ দখল, চাঁদাবাজি, মাদকের ভয়াল ছোবল, ছিনতাই, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, লাগামহীন বাসাভাড়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ইত্যাদি সমস্যা। অসংখ্য সমস্যার মধ্যে যেটি প্রধান হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে যানজট। এ সমস্যা এখন নিত্যদিনের বিষয়। যানজটে মানুষের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার হিসাব বিভিন্ন সংস্থা দিয়েছে। বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি বলেছে, এর পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ জাতিসঙ্ঘের ইউএনডিপি বলেছে, যানজটে বছরে ক্ষতি ৩৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

ঢাকা মহানগরে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন নির্মাণকাজের কারণে বায়ুদূষণ আশঙ্কাজনক। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চক্করে এর মাত্রা সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পার্টিকুলেট মেটার (পিএম) ১৭২ মাইক্রোগ্রাম। অথচ জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য পিএম ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতিও ভয়াবহ। মশাবাহিত রোগ; যেমন- চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু প্রভৃতির ঝুঁকি রয়েছে ব্যাপক। ময়লা-আবর্জনার কারণে দূষিত পরিবেশ; পেটের পীড়া, জন্ডিস ও টাইফয়েড আক্রান্ত হয় বহু মানুষ। ঢাকার একটি বার্ষিক ব্যাধি ডায়রিয়া। বছরে অন্তত দু’বার, বর্ষার শুরুতে ও শেষে এটা দেখা দেয়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ঢাকার মলমূত্রের মাত্র ২ শতাংশের নিরাপদ নিষ্কাশন হচ্ছে। বাকিটা মিশে যায় প্রকৃতিতে, পানির উৎসে। বিবিএস ও ইউনিসেফের তথ্য মতে, ঢাকায় সরবরাহ করা পানির দুই-তৃতীয়াংশেই মলবাহিত জীবাণু থাকে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকি। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো নয় বলে একটু বৃষ্টি হলেই স্যুয়ারেজ, ড্রেন আর পাইপের পানি একাকার হয়ে যায়।

জলাবদ্ধতা অত্যন্ত প্রকট সমস্যা। ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ঢাকার রাস্তাঘাট। কিছু এলাকা; যেমন- মিরপুর, মানিক নগর, মালিবাগ, ওয়্যারলেস, তেজগাঁও, কালশী রোড, দৈনিক বাংলা মোড় প্রভৃতি স্থানে রাস্তায় পানি থই থই করে। অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও অফিসগামী যাত্রীরা। বেশির ভাগ রাস্তা ও গলি অপ্রশস্ত, ইট-খোয়া-বিটুমিন ওঠা, ময়লায় ভর্তি। এসবের ফল অসহ্য যানজট। রাস্তার সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। সারা বছরই খোঁড়াখুঁড়ি চলে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। ছিনতাই-রাহাজানি নিত্যঘটনা। খুনখারাবি সর্বদাই আছে। বাজার পুরো নিয়ন্ত্রণহীন। পণ্যের পাইকারি ও খুচরা দরে পার্থক্য অনেক। নগরীর বাসযোগ্যতার সূচকে এসব তথ্য-উপাত্ত বিবেচনা করেই তালিকা চূড়ান্ত করা হয়।

অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে যেসব সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তার সব এখানে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো সমস্যা এতটাই প্রকট যে, সেগুলোর সমাধান আদৌ সম্ভব কি না তা গভীর ভাবনার বিষয়। দেশের রাজধানী শহরে বসবাসকারী নাগরিকদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার কথা, তার ধারে-কাছেও নেই অভাগা ঢাকাবাসী। তারপরও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ স্রোতের মতো ঢুকছে এ শহরের পেটে। বিদ্যমান বাসিন্দাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে আরো কিছু মানুষ, যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা আর প্রকট হয়ে উঠছে পুরনো সমস্যা।

দুঃসহ জীবন পার করছে এই নগরবাসী। বিভিন্ন সময় ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করার উপায় নিয়ে অনেক নগরবিশারদ, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি সরকারই বিভিন্ন সময় তাদের নানামুখী পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে নগরবাসীকে আশ্বস্ত করে থাকে। কখনো কখনো কিছু বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ চোখেও পড়ে। এর বেশির ভাগই সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারে না। মাঝপথেই হোঁচট খায়, অর্থের অপচয় ঘটে এবং জনগণের ভোগান্তি যে স্তরে ছিল সেই স্তরেই আটকে থাকে।

যে পরিমাণ মানুষ এখানে বাস করে তার ভার সহ্য করার ক্ষমতা এ শহরটি হারিয়ে ফেলেছে। ঘর থেকে বের হলেই চোখে পড়ে হাজারও মানুষের নানামুখী স্রোত। রাস্তাঘাট, টার্মিনাল, শপিংমল, পার্ক- সর্বত্র মানুষের ভিড়। সরকারি হিসাবে ঢাকায় বসবাসরত জনসংখ্যা এক কোটি ৬৫ লাখ। আর প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। তাদের বাসস্থান, পয়ঃনিষ্কাশন, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, যানবাহন, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই সঙ্কট। এত মানুষের চাওয়া পূরণ করা এ শহরটির পক্ষে সম্ভব কি? সব নাগরিকের পরিপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার মতো সম্পদ, সামর্থ্য এ রাষ্ট্রের নেই। আর সামর্থ্য থাকলেও এই ছোট্ট জায়গায় সে ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করাও সম্ভব নয়। এ কারণেই জনসংখ্যার ভার কমানো, শহরমুখী প্রবণতা রোধ করার জোরালো পদক্ষেপই ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপ হবে।

গ্রামে প্রচুর সম্পদ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি সরকার ঢাকা শহরের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে যত পদক্ষেপ নিয়েছে, যত অর্থ ব্যয় করেছে বা যত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তার এক-দশমাংশ পদক্ষেপও নেয়নি গ্রামাঞ্চলে। স্থানীয় সম্পদ কাজে লাগিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে শহরমুখী প্রবণতা রোধ করা যায়। গ্রামীণ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে প্রয়োজনের নিরিখে কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার ওপরও জোর দেয়া হয়নি।

দারিদ্র্যবিমোচন, স্বনির্ভর জাতি গঠন ও সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কর্মমুখী শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান অবলম্বন। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।

দেশের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে স্বাস্থ্য, কৃষি, মেরিন প্রকৌশল শিক্ষায় ১১৭২টি ইনস্টিটিউটের মধ্যে ঢাকাতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অর্ধেকের বেশি- ৬১৮টি। বাকি ৫৫৪টি করা হয়েছে ৩৩টি জেলায়। ৩০টি জেলায় কোনো ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট আজো প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
ঢাকা শহরের জনসংখ্যার চাপ হ্রাস করতে প্রতিটি উপজেলায়-জেলায় ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট নির্মাণ করে কলকারখানা, খামার, হাসপাতাল, ক্লিনিকে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

মোঃ আবুল হাসান ও খন রঞ্জন রায়


আরো সংবাদ



premium cement
রাশিয়া রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে : যুক্তরাষ্ট্র চীনা অ্যাপ টিকটক নিষিদ্ধ করার পক্ষে ৫০ ভাগ আমেরিকান রাজবাড়ীতে মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল যোগাযোগ বন্ধ রাফায় হামলার ব্যাপারে ইসরাইলকে হুঁশিয়ারি হামাসের স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে নৌকাডুবি, ৫০ শরণার্থীর মৃত্যুর ‌শঙ্কা ফিলিপাইনে খরায় জলাধার শুকিয়ে জেগে উঠেছে ৩০০ বছর আগের নগর ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আজ প্রবল কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে সাবমেরিন বিধ্বংসী স্মার্ট ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা ভারতের মোস্তাফিজের মেইডেন দিয়ে আলোচনা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন কলম্বিয়ার বাংলাদেশ-সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে ইউরিয়া সার কারখানার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন

সকল