২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জি২০ সম্মেলনের প্রাপ্তি

-

এ ছাড়া সাংবাদিক খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি সরকারের বর্তমান ইমেজ সঙ্কট ও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি, পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় আসন্ন সার্ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ভারতের অনিচ্ছা প্রকাশ, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে সমঝোতা ইত্যাদি ইস্যু উত্থাপনের জন্য আদর্শ মঞ্চ হয়ে ওঠে এবারের জি২০ সম্মেলন।
লিয়াকত আলী

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে গত ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর ১৩তম জি২০ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির দেশগুলোর প্রতিনিধিরা।
দুই দিনব্যাপী বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবারের জি২০, ২০১৮ সম্মেলনে আয়োজক দেশ আর্জেন্টিনার পাশাপাশি অংশগ্রহণ করে ১৯টি সদস্য রাষ্ট্র ও সাতটি অতিথি রাষ্ট্র। অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে সম্মনে উপস্থিত ছিল চিলি, জ্যামাইকা, ন্যাদারল্যাণ্ডস, রুয়াণ্ডা, সেনেগাল, সিঙ্গাপুরো ও স্পেন।
সাম্প্রতিক বিশ্বের চলমান ঘটনা প্রবাহের মাঝে বিশ্ব নেতাদের এই সাক্ষাতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও কূটনীতির একাধিক ক্ষেত্র বিশেষ করে ব্রেক্সিট চুক্তি, রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব, ইরান প্রসঙ্গ, কোরিয়ার পারমাণবিক চুক্তি বাতিল, চীন-যুক্তরাষ্ট্র আন্তঃসম্পর্ক সমৃদ্ধির মতো ইস্যুতে মুক্ত আলোচনার মঞ্চ হয়ে ওঠে বুয়েন্স আয়ার্সের কির্চন্যার কালচারাল সেন্টার।
এ ছাড়া সাংবাদিক খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি সরকারের বর্তমান ইমেজ সঙ্কট ও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি, পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় আসন্ন সার্ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ভারতের অনিচ্ছা প্রকাশ, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে সমঝোতা ইত্যাদি ইস্যু উত্থাপনের জন্য আদর্শ মঞ্চ হয়ে ওঠে এবারের জি২০ সম্মেলন।
জি২০ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান তিক্ত বাণিজ্যযুদ্ধ অবসানের পরিকল্পনা ছিল বিশ্বনেতাদের। সম্মেলন কার্যকর করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কিছু দাবিতে নতি স্বীকার করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে একমত হয়েছেন জি২০ নেতারা।
বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী ২০টি শিল্পোন্নত দেশকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত জি২০’র এবারের সম্মেলনে কিছু শব্দ প্রয়োগ না করাসহ বেশ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ডব্লিউটিওকে এবার কিছু শব্দ বা শব্দযুগল ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হলো।
সমঝোতা আলোচনা চলার ফাঁকে এক ইউরোপীয় কর্মকর্তা জানান, ‘জি৭ ও জি২০ সম্মেলনে ব্যবহৃত কিছু শব্দ ট্যাবুর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের কিছু আমেরিকান ট্যাবু রয়েছে, আবার কিছু চীনা। এমন একটি ট্যাবু হচ্ছে ‘সংরক্ষণবাদ’ (প্রটেকশনিজম)। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৫ হাজার কোটি ডলারের চীনা পণ্যে ও জি২০ভুক্ত বেশ কিছু দেশ থেকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক আরোপ করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে সমালোচনা হচ্ছে, সে ব্যাপারে খুব সংবেদনশীল মার্কিন প্রশাসন। ফলে ২০০৮ সালে ওয়াশিংটনে জি২০ নেতাদের প্রথম বৈঠকের পর এই প্রথম সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নেতাদের মুখে সংরক্ষণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা আসেনি।
অন্য দিকে চীন ‘ন্যায্য বাণিজ্যনীতি’ শব্দ বন্ধের বিরোধিতা করেছে। ডাম্পিং, শিল্প ভর্তুকি, মেধাস্বত্ব ও প্রযুক্তি পাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে বেইজিং। এমনকি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উৎসাহিত করার লক্ষ্যে আয়োজিত সম্মেলনে ‘বহুপক্ষীয়’ শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সঙ্কোচ প্রদর্শন করা হয়েছে।
এদিকে ২০০১ সালে সংগঠনটিতে যুক্ত হওয়ার পর অর্থনীতিকে উদার করার ক্ষেত্রে চীনকে দায়বদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় ডব্লিউটিওর দিকে আঙুল তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ডব্লিউটিওকে বাণিজ্য ব্যবস্থা সংস্কারে বাধ্য করার জন্য বিশ্বের শীর্ষ বাণিজ্য আদালতে নতুন বিচারক নিয়োগ বন্ধ রেখেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বিচারকস্বল্পতার কারণে বাণিজ্য বিরোধে রায় দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আন্তর্জাতিক এ সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে বেশ কয়েকবার হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প।
বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা-সংক্রান্ত বেশ কিছু পদবাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে বেঁধে ফেলার জন্য বেশ কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হয়েছে। যেখানে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য কাজ করে, আমরা সে পক্ষে থাকি। প্রশ্ন হলো, এটি কি তার লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে? বেশকিছু ক্ষেত্রে এটি ব্যর্থ হচ্ছে।
ডব্লিউটিওর কার্যকারিতা বাড়াতে সংস্থাটির যথাযথ সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রস্তাবিত সংস্কার নিয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অনেক প্রতিনিধি মনে করেন, আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে ওয়াশিংটনকে বাধ্য করার মতো বড় কিছু অর্জন হয়েছে জি২০ সম্মেলনে। সম্মেলনে উপস্থিত এক প্রতিনিধি বলেন, ডব্লিউটিওর বিষয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনায় সম্মত হয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের আগের হুমকিগুলো বিবেচনায় নিলে জি২০ সম্মেলনে ডব্লিউটিও সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্যের মতো বিষয়টি সত্যিই বেশ মজার।
তবুও বলা বাহুল্য, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে মিল ঘটেনি। জি৭ ও জি২০-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাবক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই এসব সম্মেলনে কী কী সিদ্ধান্ত আসছে তা জানতে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে বাকি বিশ্ব।
নানা ইস্যুতে বড় দেশগুলোতে এখন বিভক্তি চলছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বাণিজ্য ও ট্যারিফ ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে আছে। আবার ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যের সাথে বাকি ইউরোপের সার্বিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। সাংবাদিক খাশোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশটির সাথে পশ্চিম ইউরোপের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। আবার এ ইস্যুতে বাণিজ্যিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছে। একই ভূমিকায় আছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন, যদিও অতিসম্প্রতি ইউক্রেনের তিনটি যুদ্ধজাহাজ জব্দ করার ঘটনায় পুরো পশ্চিমা দুনিয়া আপাতত তার বিরুদ্ধে রয়েছে। এ ছাড়া ইয়েমেন ও সার্বিয়া পরিস্থিতি এবং ইউরোপে মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীর ঢল সামলাতে গিয়ে সেখানেও মিশ্র অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
একদিকে বিভক্তি, অন্য দিকে বিভিন্ন ইস্যুর চাপে থাকা বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে খুব ইতিবাচক কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। বাস্তবে তা ঘটেওনি। অপ্রাপ্তির মধ্যে প্রাপ্তি হলো, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সংস্কারের ঘোষণা সম্মেলনের চূড়ান্ত বিবৃতিতে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ আপাতত স্থগিত করে কিছুটা নমনীয় অবস্থান নিতে যাচ্ছে। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ও উঠেছিল। এদিকে জি২০ সম্মেলন শেষ না হতেই পোল্যান্ডের ক্যাটোওয়াইস শহরে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ইস্যুতে মোটেও আন্তরিক নন এবং তার দেশের পূর্ববর্তী প্রতিশ্রুতি থেকে বারবার পিছু হটেছেন তিনি। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশের ভবিষ্যৎ চরম হুমকির মুখে পড়েছে। আশার কথা, জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং ২০২১Ñ২৫ এই পাঁচ বছরের জন্য এই খাতে ২০ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বেড়ে চলেছে। তদুপরি ধনী দেশ ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে লেনদেনে ভারসাম্য কমছে। ইউরোপ, আমেরিকার সাথে এশিয়া-আফ্রিকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছে। ফলে কেবল পৃথকভাবে জি৭ বা জি২০ সম্মেলন করলে বিশ্ব চাহিদার সবটা পূরণ হবে না। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের যৌথ অর্থনৈতিক সম্মেলন এখন সময়ের জরুরি দাবি বলে মনে করি আমরা।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল