০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দুই কোম্পানির তালিকাচ্যুতি এবং পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা

-

একটি দেশের পুঁজিবাজার দেশের আর্থিক খাতের বিকল্প হিসেবে বিনিয়োগে মূলধন জোগান দিয়ে থাকে। সুতরাং আর্থিক খাতের মতো এখানেও সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় থাকবে এটাই সবাই প্রত্যাশা করেন। আর আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের তো কথাই নেই। মাত্র দেড় দশকের মধ্যে দু’টি বড় বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করার পরও পুঁজিবাজার শৃঙ্খলায় না ফিরলে দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখা দূরে থাক একসময় বিশ্ব দরবারে এটি একটি বড় ‘জুয়ার আড্ডা’ হিসেবেই গণ্য হতে পারে, যা একটি সভ্য দেশের কোনো নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ‘এ’ গ্রেডের বা পুঁজিবাজারটি আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জের সদস্য কি না তাতে কারো কিছুই যায় আসে না।
গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশের পুঁজিবাজারে যা ঘটছে তাকে কোনোভাবেই বাজারের স্বাভাবিক আচরণ বলা যায় না। কোনো কারণ ছাড়াই কখনো অস্বাভাবিক দরপতনে ব্যাংকসহ অন্যান্য কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর নেমে আসছে অভিহিত মূল্যেরও নিচে। অনুরূপভাবে কোনো কারণ ছাড়াই একই কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বেড়েছে হু হু করে। এদিকে বাজারে যা ঘটছে তা নিয়ে বিশ্লেষকরা একের পর এক মন্তব্যও করে চলেছেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে তার নানা কারণও বাতলে দিচ্ছেন। কিন্তু কেউই বলতে পারছেন না এটা কোন পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক আচরণ।
কিন্তু দীর্ঘ দিন এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি একটি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকার পরও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ৪০০ থেকে ৫০০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া দু’টি কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করেছে। গত বুধবার ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়ে এ দু’টি কোম্পানির তালিকাচ্যুতি ঘটায়। প্রতিষ্ঠানটির পর্যবেক্ষণে উঠে আসে কোম্পানি দু’টি দীর্ঘ দিন থেকে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও এগুলোর উৎপাদনে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বৃহস্পতিবার থেকে কোম্পানি দু’টির লেনদেন বন্ধ করা হয়। ডিএসই কর্তৃপক্ষের নেয়া এ সিদ্ধন্তে পুঁজিবাজারে কমবেশি আশার সঞ্চার হয়েছে। দেরিতে হলেও এমন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে এবার শৃঙ্খলায় ফিরবে পুঁজিবাজার।
সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারের লেনদেনকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা কোনোভাবেই এ সময়ের বাজার আচরণকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারেন না। এ সময় বেশ কিছু ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে পুঁজিবাজারে। প্রথমে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে চলেছে তুঘলকি কারবার। ব্যাংকের মালিকানা বদল করতে গিয়েই মূলত এ ধরনের ঘটনা ঘটে। আকাশচুম্বী হয়ে যায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ারদর। আর যখন মালিকানা বদলের খেলা শেষ, তখন ধীরে ধীরে আগের দরে ফিরতে শুরু করেছে এসব ব্যাংকের শেয়ারদর।
ব্যাংকের পর এবার শুরু হয় স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ার নিয়ে অনৈতিক খেলা। মৌলভিত্তি কোনো বিষয় নয়। কোম্পানি উৎপাদনে আছে কি নেই তাও বিবেচনায় নেই। বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না কোম্পানিটি কোনো লভ্যাংশ দেয় কি না। শুধু কোন কোম্পানির মূলধন কত কম, কোনটির ফোটিং শেয়ার সাধারণ মানুষের হাতে বেশি নেই সেসব কোম্পানিই প্রাধান্য পায় বাজার খেলোয়াড়দের বিবেচনায়। শুরু হয় পরিকল্পিত মূল্যবৃদ্ধি। কয়েকটি হাউজ থেকে কিছু ব্যক্তি (কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান) নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে দিনের পর দিন এ ধরনের খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই এসব শেয়ারের বিক্রেতা না পেয়ে দিনের সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ দরে পৌঁছে যাচ্ছে শেয়ারের দাম। আবার কিছু কিছু কোম্পানি ‘জেড’ গ্রুপের সেটেলমেন্ট সমস্যা মুক্ত থাকতে নামকাওয়াস্তে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এতে ‘বি’ গ্রুপে থেকে দু’দিনের সেটেলমেন্ট সুবিধা ব্যবহার করে সহজেই টানা মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো যায়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৌশল খাতের দু’টি কোম্পানি আজিজ পাইপ ও বিডি অটোকারস এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হয়। তবে বাজারে গুজব আছে এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের মূল্যবৃদ্ধিতে একটি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান জড়িত।
অপর দিকে, বাজারের মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি হিসেবে পরিচিত কোম্পানিগুলো এ খেলায় দিনের পর দিন মার খাচ্ছে। এ ধরনের বেশ কয়েকটি কোম্পাানির শেয়ার এ মুহূর্তে সাম্প্রতিক সময়ের সর্বনিম্ন দরে বেচাকেনা হচ্ছে। অথচ যথাসময়ে সাধারণ সভা করা, লভ্যাংশ ঘোষণাসহ সিকিউরিটিজ আইন পরিপালনে কোম্পানিগুলো বরাবরই প্রথম কাতারে থাকে। বেশির ভাগ কোম্পানির ক্ষেত্রে যে অভিযোগ প্রায়ই দেখা যায় সেই ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মতো কোনো অভিযোগও এ কোম্পানিগুলো নিয়ে কেউ কখনো করেনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে থাকেন।
সম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বাজারের সাম্প্রতিক এ আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পাওয়ার পর পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে দেখা করতে গেলে চলমান বাজার আচরণের বেশ কিছু বিষয় এ সময় উঠে আসে। তবে পুঁজিবাজারকে স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল করতে তার সদিচ্ছার কোনো অভাব দেখা যায়নি।
কিন্তু আইনি সীমার মধ্যে থেকে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তিনি সমর্থন না করলেও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবে তিনি দৃশ্যমান কোনো শাস্তির ব্যবস্থাও করেননি। কারণ আইন তাকে সে সুযোগ দেয়নি। বিষয়টি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষের হাতে। অবশেষে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ ডিএসই পরিচালনা পর্ষদের কাছ থেকেই আসে এ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ । আরো বড় একটি তালিকা থেকে প্রথমে এ দু’টি কোম্পানিকেই তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। পরে পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্য কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে এ ধরনের একটি বার্তা ইতোমধ্যে পুঁজিবাজারে পৌঁছে গেছে। তাই সামনের দিনগুলোতে অনৈতিক এ খেলা খেলে পার পাবে না এমন বার্তা দিতে পেরেছে পুঁজিবাজারটি।
ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর এটাই হয়তো ডিএসইর নেয়া কঠোরতম পদক্ষেপ। সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বতন্ত্র পরিচালকমণ্ডলী নিয়ে গড়া ডিএসই পর্ষদের এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিতে চার বছর লাগল। তাও না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়াও ভালো।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মতে, ডিএসই কর্তৃপক্ষের নেয়া এ সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারের ুদ্র একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই এতে লাভবান হয়েছেন। লাভবান হবে প্রতিষ্ঠানগুলোও। কারণ বাজার আচরণ স্বাভাবিক থাকলেই বিনিয়োগ পরিকল্পনা সম্ভব। আর এর ওপরই নির্ভর করে পুঁজিবাজারের সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েক শ’ প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ধরে রাখা। নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে গড়ে ওঠা বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।


আরো সংবাদ



premium cement