শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান পাহাড়সম বৈষম্য, বিশৃঙ্খলা দূর করা আর মান নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় জাতীয়করণ করা বলে মনে করেন বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষক নেতৃবৃন্দ এবং শিক্ষকেরা। তারা বলছেন, জাতীয়করণের মাধ্যমেই বন্ধ হতে পারে শিক্ষা নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষের বেপরোয়া বাণিজ্য। এতে শিক্ষকতায় আগ্রহী হবেন মেধাবীরা। আর অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পাবেন শিক্ষক, অভিভাবক আর শিক্ষার্থীরা।
অতিরিক্ত খরচ হবে না সরকারের : এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে সরকারের কোষাগর থেকে অতিরিক্ত কোনো খরচ হবে না বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন নেতৃবৃন্দসহ অনেক সাধারণ শিক্ষক। তাদের মতে শুধু এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় বরং সব নন এমপিও প্রতিষ্ঠানও যদি জাতীয়করণ করা হয় তবু সরকারের অতিরিক্ত কোনো খরচ হবে না এ খাতে।
এ দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তারা বলেন, বর্তমানে বেসরকারি স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে যে শত শত কোটি টাকা বেতন বাবদ আদায় করে। তা থেকে একটি টাকাও পায় না সরকার। প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য আয় থেকেও কোনো টাকা পায় না সরকার। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সারা বছর বেতন দেয় সরকার অথচ শিক্ষার্থীদের বেতনসহ প্রতিষ্ঠানের কোনো আয় পায় না সরকার। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান এসব আয় তাদের ইচ্ছা মতো ব্যয় করে। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা খরচ বাদে বাকি আয় অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের এসব আয় থেকে শিক্ষকেরাও কিছু পান না। শিক্ষকেরা জানান, সারা দেশের সব এমপিও এবং নন এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি জাতীয়করণ করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যৌক্তিক পরিমাণ মাসিক বেতন আদায় করা যায় তাহলে সেই বেতন দিয়েই শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করার পর অতিরিক্ত টাকা থেকে যাবে।
ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় অবস্থিত গোপীনাথপুর আলহাজ শাহ আলম কলেজের সহকারী অধ্যাপক কাজী আশরাফুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০১৪-১৫ সালে ব্যানবেইজের হিসাব অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকপর্যায়ের এমপিও-নন এমপিও মিলিয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থী ধরা হয় দুই কোটি। এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করে দেখা হয় তাদের কাছ থেকে যদি প্রতি মাসে গড়ে ১৫ টাকা করেও বেতন আদায় করা হয় তাহলে তা দিয়ে সব শিক্ষকে মাসিক বেতন পরিশোধ করার পর ৮০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকে।
শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বলেন, রাজধানীসহ সব শহরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেশন চার্জ, ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন বাবদ নানা খাত দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে অভিভাবকদের কাছ থেকে। এ থেকে একটি টাকাও পায় না সরকার। অভিভাবকরাও সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করছে। কিন্তু তারপরও তারা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে লাভবান হবেন অভিভাবকরা।
গত বছর জানুয়ারি মাসে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন কর্মসূচি পালন করেন জাতীয়করণের দাবিতে। কর্মসূচিতে যোগ দেয়া অনেক শিক্ষক তখন বলেন, জাতীয়করণ করা হলে আমরা শিক্ষকরা লাভবান হবো। কিন্তু আমরা শুধু আমাদের লাভের জন্য এখানে আসিনি। আমরা এসেছি জাতীয় স্বার্থে। সারা দেশের অভিভাবকদের স্বার্থে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য আর নৈরাজ্য দূর করে মান বৃদ্ধির স্বার্থে। অনশন আয়োজনকারী সংগঠনের পক্ষ থেকে তখন লিফলেট বিতরণ করে দেখানো হয় জাতীয়করণ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত কোনো খরচ হবে না।
লিফলেটে বলা হয়, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাসিক গড় বেতন ১৫ টাকা। জাতীয়করণ করা হলে শিক্ষার্থীদের গড় বেতন ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয় যার মাধ্যমে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কোটি ৬২ লাখ ৬৩ হাজার শিক্ষার্থীর প্রত্যেকের কাছ থেকে যদি মাসে গড়ে ৭৫ টাকা করে বেতন আদায় করা হয় তাহলে মাসে একশ ২২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে। এর সাথে আরো যোগ হবে ভর্তি ফি, পরীক্ষার ফিসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সম্পত্তি থেকে বার্ষিক আয়। লিফলেটে বলা হয় বর্তমানে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৪০২ কোটি ৪৯ লাখ ৩০০ টাকা রিজার্ভ রয়েছে যা সরকারের কোষাগারে যাবে জাতীয়করণ করা হলে। তা ছাড়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বছরে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা আয় করে নিজস্ব সম্পত্তি থেকে। এটাও পাবে সরকার।
লিফলেটের আরেকটি হিসাবে দেখানো হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকপর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের মাসিক বরাদ্দ ৯২৫ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার কোটি টাকা। জাতীয়করণ করা হলে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন সর্বসাকল্যে আরো ৫০ ভাগ বাড়বে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা যোগ হলে। ফলে বেতন খাতে বর্তমান এক হাজার কোটি টাকা থেকে খরচ বেড়ে দেড় হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। এর সাথে যোগ হবে অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের মাসিক পেনশন এবং এককালীন অবসর ভাতা। কিন্তু এর বিপরীতে জাতীয়করণ করা হলে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে থাকা এক কোটি ৬২ লাখ ৬৩ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যদি যৌক্তিক পরিমাণ বেতন ও ভর্তি ফি আদায় করা যায় তাহলে সরকারের ব্যয় ও আয়ের মধ্যে খুব বেশি ব্যবধান থাকবে না।
অনেক শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় যারা রয়েছেন, যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয় ভাগ-বাটোয়ারার সাথে যুক্ত, যারা নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করছে, যারা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে আসীন তাদের অনেকেই জাতীয়করণ করার বিপক্ষে। এদের মধ্যে প্রভাবশালী অনেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে ভুল বুঝিয়েছে জাতীয়করণ করার বিষয়ে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা