২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভোট পবিত্র আমানত

-

কোনো আসনে একজন ‘সদস্য’ পদপ্রার্থীকে ভোট দিলে বা মত দেয়ার বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রশ্নে, কুরআন-হাদিসের মাপকাঠিতে ভোট দেয়ার বিষয়টি শরিয়তের অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অধ্যায় বা বিষয়াধীন হয়ে থাকে। যার প্রতিটিকে আমরা একেকটি আঙ্গিক বা প্রেক্ষিত হিসেবে গণ্য করতে পারি। যেমনÑ
একটি আঙ্গিক হচ্ছে ‘শাহাদত’ বা ‘সাক্ষ্য দেয়া’। ভোটার ব্যক্তি যাকে তাঁর ভোট বা মতামত দিচ্ছেন তাঁর অর্থ হচ্ছে, ভোটদাতা সংশ্লিষ্ট ভোটপ্রার্থী সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ‘ওই প্রার্থী সংশ্লিষ্ট কাজের (রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন পাস করা, ইউনিয়নের জনগণের সার্বিক দায়িত্ব পালন ইত্যাদি) যথাযথ যোগ্যতাও রাখেন এবং প্রয়োজনীয় সততা ও আমানতদারীও তাঁর মধ্যে রয়েছে।’
এখন বাস্তবে যদি ওই প্রার্থীর মধ্যে সেসব যোগ্যতা ও গুণ অনুপস্থিত হয় এবং তা সত্ত্বেও ভোটদাতা জেনেশুনেই তাঁকে ভোট দিচ্ছেন; তা হলে সেটা হবে মিথ্যা সাক্ষ্য যা বড় মাপের কবিরা গুনাহ এবং ভোটার হবে মিথ্যুক, কবিরা পাপে জড়িত; যার কারণে তাঁর উভয় জগত বরবাদ হয়ে যাবে। সহিহ বুখারি শরিফে নবী সা: মিথ্যা সাক্ষ্যকে শিরক-অপরাধের পরবর্তী পর্যায়ের অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন। (মিশকাত)
অন্য আরেকটি হাদিসে মহানবী সা: মিথ্যা সাক্ষ্যকে অন্যতম ‘কবিরা পাপ’ বলে ইরশাদ করেছেন। (বুখারি ও মুসলিম)
যে কেন্দ্রে বা অঞ্চলে কয়েকজন প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন এবং ভোটদাতা জানেন যে, তাঁদের সবার মধ্যে তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন ও সৎ ব্যক্তি অমুক, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যজনেক ভোট দেয়া ওই কবিরা গুনাহে নিজেকে জড়ানোর নামান্তর হবে।
সুতরাং ভোটদাতাকে নিজ পরকাল ও পরিণতি বিবেচনা করে ভোট দেয়া তথা সাক্ষ্য দিতে হবে। কেবল প্রথাগত সম্মান বা লাজলজ্জায় অথবা কোনো লোভ-লালসা ও ভয়ভীতির কারণে নিজকে ওই মহা ক্ষতির মুখোমুখী করতে যাওয়া ঠিক হবে না।
ভোটের দ্বিতীয় আঙ্গিক বা ইসলামী ব্যাখ্যা হচ্ছে, ‘শাফায়াত’ বা সুপারিশ। অর্থাৎ ভোটদাতা যেমন কিনা সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিচ্ছেন, তাঁর মানে তিনি সুপারিশ করছেন। এ সুপারিশ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে যা বলা হয়েছে তা সব সংশ্লিষ্ট ভোটার বা ভোটদাতার সম্মুখে থাকা অত্যন্ত জরুরি। তা হচ্ছেÑ
অর্থ : ‘যে ব্যক্তি কোনো ভালো ও সৎকাজের সুপারিশ করবে, সে ওই ভালো কাজের ও নেকির মধ্যে অংশ পাবে; আর যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজে বা খারাপ বিষয়ে সুপারিশ করবে, সেও সেই মন্দের অংশীদার হবে।’ (সূরা নিসা : ৮৫) ভালো বা উত্তম সুপারিশ হচ্ছে এটাই যে, যথোপযুক্ত ও সৎ আমানতদার ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করা, যিনি আল্লাহর সৃষ্টির হক-অধিকার ঠিকভাবে আদায় করবেন। আর মন্দ সুপারিশ হচ্ছে অযোগ্য, অপদার্থ-পাপী-অপরাধী বা কোনো সন্ত্রাসীর পক্ষে সুপারিশ করে তাঁকে গণমানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে সুযোগ করে দেয়া। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের ভোটের মাধ্যমে পাস করে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী তাঁর তিন বছর বা পাঁচ বছরের সময়ের মধ্যে যত রকম নেক বা বদকাজ করবে, তাঁর সে সব কাজের সওয়াব বা আজাবে আমরাও নিশ্চিত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো। সুতরাং সাধু সাবধান!
ভোটদানের তৃতীয় আরেকটি আঙ্গিক শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘ওকালত’ বা কাউকে উকিল বা প্রতিনিধি নির্ধারণ করা। অর্থাৎ একজন ভোটদাতা ওই প্রার্থীকে নিজের ও জনগণের প্রতিনিধি বা উকিল নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু ওই প্রতিনিধি নির্বাচন বিষয়টি যদি ভোটদাতার একার বা ব্যক্তিগত বিষয়ে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ের হতো, তা হলে তাঁর লাভ-ক্ষতি কেবল তাঁর নিজের একার ব্যাপারে সীমিত থাকত এবং সে তাঁর একার জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতো। অথচ আলোচ্য নির্বাচনের বেলায় তেমন নয়, কেননা ওই প্রতিনিধি নিযুক্তি এমন সব অসংখ্য হক-অধিকার সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে; যার মধ্যে তাঁর সাথে পুরো জাতি অংশীদার। তাই যদি কোনো অযোগ্যকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধিরূপে উত্তীর্ণ করে দেয়া হয়, তা হলে পুরো জাতির সমূহ হক-অধিকার বিনষ্টের সব গুনাহ ওই ভোটদাতার আমলনামায়ও যোগ হবে। অর্থাৎ যার ভোটে পাস করে অযোগ্য, অপদার্থ, সন্ত্রাসী মেম্বার, চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য যতরকম পাপ-অপরাধ করবেন, দেশ ও জাতির যত অধিকার নষ্ট করবেন, তাঁর ভোট দেয়ার কারণে উত্তীর্ণ মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপি-মন্ত্রীরা যত পাপের ভাগী হবে, সমপরিমাণ পাপের ভাগী সংশ্লিষ্ট ভোটার বা ভোটদাতা নিজেও হবে। কেননা, ভোটদাতার ভোটে পাস করেই তো এতগুলো অন্যায়-অপকর্ম করার সুযোগ পেলেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি তথা তাঁরই নিযুক্ত উকিল সাহেব।
সারসংক্ষেপ : আমাদের ভোট দেয়ার তিনটি বাস্তব অবস্থা হয়ে থাকেÑ (ক) সাক্ষ্য দেয়া বা ‘শাহাদাত’, (খ) ‘শাফায়াত’ বা সুপারিশ ও (গ) জাতি ও সমষ্টির ব্যাপারে প্রতিনিধি নিযুক্তি। তিনটি অবস্থা বা ব্যাখ্যার আলোকেই যেরকমভাবে সৎ, আমানতদার, উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রার্থীকে ভোট দেয়ার যেমন বিরাট সওয়াব রয়েছে এবং তাঁর ফলাফলের ভাগিদার হবেন; তেমনি অযোগ্য, অসৎ ব্যক্তিকে ভোট দেয়া মানে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, মন্দ সুপারিশ করা এবং অবৈধ ও নাজায়েজ ওকালত বা প্রতিনিধি নির্ধারণে অংশগ্রহণ ছাড়াও তাঁর ধ্বংসাত্মক ফলাফল ও তাঁর সমপরিমাণ পাপরাশি সংশ্লিষ্ট ভোটদাতার আমলনামায়ও যোগ হয়ে থাকবে।
প্রার্থিতা : কোনো সভা-সংসদ বা পরিষদের সদস্য হওয়ার উদ্দেশ্যে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে যিনি প্রস্তুত হন, তিনি যেন পুরো জাতির সামনে দুটি বিষয়ে দাবি বা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যথাÑ
১. একটি হচ্ছে, ‘তিনি ওই কাজ বা দায়িত্ব সম্পাদনে যোগ্যতা রাখেন যাকে কেন্দ্র করে তিনি প্রার্থী হয়েছেন।’
২. দ্বিতীয়তটি হচ্ছে, ‘তিনি আমানত ও সততার সাথে অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করবেন।’ এখন বাস্তবে যদি তিনি সংশ্লিষ্ট কাজে যোগ্যতাসম্পন্ন হন এবং সততা ও নিষ্ঠার সাথে জাতির সেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্বাচনের ময়দানে আসেন, তা হলে তাঁর ওই পদক্ষেপ অনেকটা বৈধ সীমার ভেতরেই গণ্য করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রেও শরিয়তসম্মত উত্তম পন্থা হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি যেন নিজের যোগ্যতার ও সেবার কথা প্রকাশ করে প্রার্থী না হন, বরং মুসলমানদের কোনো দল বা জামাতের পক্ষ থেকে তাঁকে যোগ্য বিবেচনা করে যেন তাঁর নাম প্রস্তাব করেন এবং তাঁকে দায়িত্ব গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। আর যার মধ্যে মূলত তেমন দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্যতাই নেই, তাঁর পক্ষে দাঁড়ানো বা তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পূর্ণ হারাম ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কোনো আসনের সদস্য পদে নির্বাচিত বা মনোনীত হওয়ার পর থেকে এ আসনের সব জনগণ এবং তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট সবরকম দায়দায়িত্ব ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখের সার্বিক জবাবদিহিতা তাঁর নিজের ঘাড়ে চেপে বসল। এ জন্য তাঁকে ইহকাল-পরকাল উভয় জগতে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন


আরো সংবাদ



premium cement