২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুমিনদের মধ্যে বিরোধের মীমাংসা করে দাও

-

“ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তার পরও যদি দু’টি দলের কোনো একটি অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে তবে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো। যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। এরপর যদি তারা ফিরে আসে তা হলে তাদের মাঝে ন্যায়বিচারের সাথে মীমাংসা করিয়ে দাও এবং ইনসাফ করো। আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি মেহেরবাণী করা হবে।”(সূরা আল হুজরাত : ৯-১০)
তাফসিরকারকেরা বলেছেন, উল্লিখিত আয়াতের শুরুতে আল্লাহ এ কথা বলেননি, যখন ঈমানদারদের মধ্যে দু’টি গোষ্ঠী পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয় বরং বলেছেন, যদি ঈমানদারদের দু’টি দল একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এ কথা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া মুসলমানদের নীতি ও স্বভাব নয় এবং হওয়া উচিতও নয়। মুমিন হয়েও তারা পরস্পর লড়াই করবে এটা তাদের কাছ থেকে আশাও করা যায় না।
তবে যদি এমনটি ঘটে তাহলে সে ক্ষেত্রে এমন কর্মপন্থা গ্রহণ করা উচিত যাতে মীমাংসা হয়ে যায়। ‘তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও’। আয়াতের মাধ্যমে সব মুসলমানকে সম্বোধন করা হয়েছে। যারা ওই বিবদমান দল দু’টিতে শামিল নয় এবং যাদের পক্ষে যুদ্ধমান দু’টি দলের মধ্যে সন্ধি ও সমঝোতা করে দেয়া সম্ভব। এ নির্দেশের মাধ্যমে এটিও পরোক্ষভাবে বোঝা যায় যে, মুসলমানদের দু’টি দল পরস্পর লড়াই করতে থাকবে আর মুসলমান নিষ্ক্রিয় বসে তামাশা দেখবে আল্লাহর দৃষ্টিতে সেটা মুসলমানের কাজ নয়। বরং এ ধরনের দুঃখজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে তাতে সব ঈমানদার লোকদের অস্থির হয়ে পড়া উচিত এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণে যার পক্ষে যতটুকু চেষ্টা করা সম্ভব তাকে তা করতে হবে। উভয়পক্ষকে লড়াই থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতে হবে। তাদের আল্লাহর ভয় দেখাতে হবে। প্রভাবশালীরা উভয়পক্ষের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করবে। বিবাদের কারণগুলো জানবে এবং নিজ নিজ সাধ্যমতো তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সব রকম প্রচেষ্টা চালাবে।
‘যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে’Ñ আল্লাহর নির্দেশ অর্থ আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নত অনুসারে যা ন্যায় তা মেনে নিতে উদ্যোগী হবে এবং সত্যের এ মানদণ্ড অনুসারে যে কর্মপন্থাটি সীমালঙ্ঘন বলে সাব্যস্ত হবে তা পরিত্যাগ করবে। আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নত অনুসারে কোনো বিবাদে ন্যায় কী ও অন্যায় কী তা নির্ধারণ করা তাদেরই কাজ যারা এ উম্মতের মধ্যে জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি দিক দিয়ে বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করার যোগ্য।
‘তাদের মাঝে ন্যায়বিচারের সাথে মীমাংসা করিয়ে দাও এবং ইনসাফ করো’Ñ শুধু সন্ধি করিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়নি, বরং নির্দেশ দেয়া হয়েছে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে সন্ধি করিয়ে দেয়ার। এ থেকে বোঝা যায় হক ও বাতিলের পার্থক্যকে উপেক্ষা করে শুধু যুদ্ধ বন্ধ করানো হয় এবং যেখানে সত্য ও ন্যায়ের অনুসারী দলকে অবদমিত করে সীমালঙ্ঘনকারী দলকে অন্যায়ভাবে সুবিধা প্রদান করানো হয় আল্লাহর দৃষ্টিতে তার কোনো মূল্য নেই। সে সন্ধিই সঠিক যা ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তিশীল। এ ধরনের সন্ধির দ্বারা বিপর্যয় দূরীভূত হয়।
‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই’Ñ এ আয়াতে দুনিয়ার সব মুসলমানকে এক বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। দুনিয়ার অন্য কোনো আদর্শ বা মত ও পথের অনুসারীদের মধ্যে এমন কোনো ভ্রাতৃত্ব বন্ধন পাওয়া যায় না, যা মুসলমানদের মধ্যে পাওয়া যায়। এটাও এ আয়াতের বরকতে সাধিত হয়েছে। এ নির্দেশের দাবি ও গুরুত্বগুলো কী, বহুসংখ্যক হাদিসে রসূলুল্লাহ সা: তা বর্ণনা করেছেন। ওই সব হাদিসের আলোকে এ আয়াতের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বোধগম্য হতে পারে। হাদিসগুলো নিম্নরূপ :
হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমার থেকে তিনটি বিষয়ে ‘বাইয়াত’ নিয়েছেন। ১. নামাজ কায়েম করব। ২. জাকাত আদায় করতে থাকব। ৩. প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করব। (বুখারি-কিতাবুল ঈমান)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : মুসলমানদের গালি দেয়া ফাসেকি এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরি। (বুখারি-কিতাবুল ঈমান) মুসনাদে আহমাদে হজরত সাঈদ ইবনে মালেক ও তার পিতা থেকে অনুরূপ বিষয়বস্তু সংবলিত হাদিস বর্ণিত করেছেন।
হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জত হারাম। (মুসলিম-কিতাবুল র্বির ওয়াস্সিলাহ, তিরমিজি-আবওয়াবুল র্বিও ওয়াস্সিলাহ)
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: ও হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, নবী সা: বলেছেন, ১. মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে সহযোগিতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোনো ব্যক্তির জন্য তার কোনো মুসলমান ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করার মতো অপকর্ম আর নেই। (মুসনাদে আহমাদ)
হজরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী নবীর এ হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, ঈমানদারদের সাথে একজন ঈমানদারের সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমন দেহের সাথে মাথার সম্পর্ক। সে ঈমানদারদের প্রতিটি দুঃখকষ্ট ঠিক অনুভব করে যেমন মাথা দেহের প্রতিটি অংশের ব্যথ্যা অনুভব করে। (মুসনাদে আহমাদ) অপর একটি হাদিসে এ বিষয়বস্তুর প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে।
ওই হাদিসে নবী সা: বলেছেন : পারস্পরিক ভালোবাসা, সুসম্পর্ক এবং একে অপরের দয়ামায়া ও স্নেহের ব্যাপারে মুমিনগণ একটি দেহের মতো। দেহের যে অঙ্গেই কষ্ট হোক না কেন তাতে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় ভুগতে থাকে। (বুখারি ও মুসলিম)
আরো একটি হাদিসে নবীর সা: এ বাণীটি উদ্ধৃত হয়েছে যে, মুমিনগণ পরস্পরের জন্য একই প্রাচীরের ইটের মতো একে অপরের থেকে শক্তিলাভ করে থাকে। (বুখারি কিতাবুল আদাব, তিরমিজি-কিতাবুল র্বির-ওয়াস্সিলাহ)
ইসলামের এ পবিত্রতম সম্পর্কের ভিত্তিতে তারা একে অপরের ভাই এবং আল্লাহর ভয়েই তাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক রাখার চেষ্টা করা উচিত।
লেখক : ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement