২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রক্তস্বল্পতা : জনস্বাস্থ্যের প্রধান সমস্যা

রক্তস্বল্পতায় ভয়ঙ্কর সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে জনগণ রক্তশূন্যতায় ভোগেন। এর মধ্যে অপুষ্টি, অজ্ঞতা, ঘন ঘন গর্ভধারণ, মাসিক, কৃমির সংক্রমণ, রক্তের ক্যান্সার ও পাকস্থলীর বিভিন্ন অসুখ

বাংলাদেশের প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে রক্তস্বল্পতা অন্যতম। কোনো ব্যক্তির বয়স এবং পুরুষ-মহিলাভেদে যে পরিমাণ হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে থাকা প্রয়োজন তার চেয়ে পরিমাণে কম থাকলে সেই ব্যক্তির রক্তস্বল্পতা আছে বলে ধরা হয়। রক্তস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া মানে রক্ত কমে যাওয়া নয়। আমাদের শরীরের রক্তের উপাদান লোহিত কণিকায় হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলেই দেহে রক্তশূন্যতা, রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া বলা হয়। এই রক্তস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতার কারণে দেহ সঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারে না। ফলে দেহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী রক্তস্বল্পতা রোগে ভুগে।

আমাদের দেশে, বিশেষ করে কিশোরী, যাদের বয়স ৯ বছর থেকে ২০ বছরের মধ্যে তারাই এ রোগে ভুগে বেশি। কারণ মেয়েদের প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার পর যে পরিমাণ রক্ত দেহ থেকে বের হয়ে যায় উপযুক্ত খাদ্য গ্রহণের অভাবে সেই পরিমাণ রক্ত দেহে তৈরি হয় না। ফলে আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলের বেশির ভাগ মেয়েরা সঠিক স্বাস্থ্য নিয়ে গড়ে উঠতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সমস্যায় ভুগে গর্ভবতী মহিলা ও বুকের দুধ প্রদানকারী মায়েরা। তাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না, যে মাস থেকে তার মা হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবে তার তিন-চার মাস থেকে লৌহসমৃদ্ধ খাবার বা আয়রন বড়ি খেতে হয়। গর্ভকালীন অধিক মৃত্যুর হারের অন্যতম কারণ রক্তশূন্যতা। আমাদের বাংলাদেশে এ রক্তশূন্যতার হার অত্যন্ত বেশি। এ রক্তশূন্যতার কারণে গর্ভবর্তী মায়েরা নানা ত্রুটিযুক্ত সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। অভিভাবক এবং প্রত্যেক মাকে এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

রক্তশূন্যতা কী : বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী রক্তে প্রয়োজনীয় পরিমাণ হিমোগ্লোবিন পরিমাণ কমে গেলে তাকে বলা হয় রক্তশূন্যতা। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক পরিমাণ প্রতি মিলিলিটার রক্তে ১৩-১৮ গ্রাম বা ডেসিলিটার এবং প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের রক্তে প্রতি মিলিলিটার রক্তে ১১.৫-১৬.৫ গ্রাম বা ডেসিলিটার এবং শিশুদের পাঁচ মাস থেকে ৫৯ মাস বয়স পর্যন্ত রক্তে প্রতি মিলিলিটার রক্তে ১১ গ্রাম বা ডেসিলিটার থাকা প্রয়োজন।

রক্তশূন্যতার কারণ : বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে জনগণ রক্তশূন্যতায় ভুগেন। এর মধ্যে অপুষ্টি, অজ্ঞতা, ঘন ঘন গর্ভধারণ, মাসিক, কৃমি সংক্রমণ, রক্তে ক্যান্সার ও পাকস্থলীর বিভিন্ন অসুখ। তবে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো-

* দৈনন্দিন খাবার গ্রহণের মধ্যে লৌহজাতীয় খাবারের অভাবজনিত কারণ।

* রক্তে লৌহের ঘাটতির কারণে রক্তে লোহিত কণিকার উৎপাদন ব্যাহত হওয়া।

* রক্তের কোষগুলো বেশি পরিমাণে মারা গেলে বা রক্তে লোহিত কণিকা বেশি ভেঙে গেলে, সাধারণত এটি হয় থ্যালাসেমিয়া রোগ হলে।

* দেহে লৌহ ভিটামিন বি-১২, ভিটামিন সি অথবা ফলিক এসিডের অভাব দেখা দিলে।

* থ্যাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ বা লিভারের অসুখ যেমন- লিভার সিরোসিস রোগ হলে।

* দেহ থেকে অতিরিক্ত রক্ত বেরিয়ে গেলে যেমন- সন্তান জন্মদান, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্ত স্রাব হলে, রক্তক্ষরণজনিত রোগ হলে যেমন- পেপটিক আলসার, অর্শ্ব রোগ ও ক্যান্সার। * পেটে কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হলে এ সমস্যাটি বেশি দেখা দেয়।

* শিশুকে স্তন দানের সময় প্রয়োজনীয় আয়রনসমৃদ্ধ খাবার মা না খেলে এ সমস্যা দেখা দেয়। * পাকস্থলী অন্ত্রে ক্যান্সার হলে।

* দেহে কোনো কারণে অপারেশন হলে।

* ঘন ঘন সন্তান নিলে।
* প্রসবের সময় রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার কারণে।
* তা ছাড়া, যেকোনো খাবার গ্রহণে দেহে লৌহ শোষণে বাধা দেয়ার কারণে, যেমন- চা, কপি। শিশু খাবারে প্রয়োজনমতো আয়রন না থাকলে।
* প্রয়োজনমতো প্রোটিন জাতীয় খাবার না খেলে।

দৈনিক চাহিদা : প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রতিদিন আয়রনের প্রয়োজন ২৪ মিলিগ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার প্রতিদিন আয়রনের প্রয়োজন ৩২ মিলিগ্রাম এবং গর্ভাবস্থায় ৪০ মিলিগ্রাম। শিশুকে বুকের দুধদানকালে ৩২ মিলিগ্রাম, শিশুর ২০-২০ মিলিগ্রাম।

রক্তশূন্যতা বোঝার উপায় : অল্প ও মাঝারি রক্তশূন্যতায় তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। তবে রক্ত পরীক্ষা করলে রক্তস্বল্পতা ধরা পড়ে। সাধারণত রক্তশূন্যতা একটু বেশি দেখা দিলে নানা লক্ষণ শরীরে ফুটে ওঠে, যা দেখে বোঝা যায় লোকটি রক্তশূন্যতায় ভুগছে।

লক্ষণগুলো হলো : অবসাদ, দুর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, চোখে ঝাপসা করা, হাত পায়ে ঝিমঝিম করা, মাথা ব্যথা করা, হাত-পাসহ পুরো শরীর ফ্যাকাশে হওয়া, অলসতা বেড়ে যাওয়া, মুখে ঘা, জিহ্বায় ঘা, গিলতে অসুবিধা ভোগ করা, নখ ভঙ্গুর বা চামচের মতো হওয়া। তা ছাড়া চামড়ার ভার, নখ, ঠোঁটের ভেতরের অংশ শরীর এবং মুখের চামড়ার রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া এবং নাড়িরগতি বেড়ে যাওয়া। মেয়েদের মাসিকে সমস্যা কিংবা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া অথবা পেটে নিচতলায় অসহ্য ব্যথা অনুভব করা এবং মাসিক না হওয়া অথবা ব্যথাসহ মাসিক হওয়া। কম পরিমাণে মাসিক হওয়া অথবা রক্তস্রাব বেশি হওয়া। রক্তে অনুচক্রিকার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে সঙ্গম করার চাহিদা কমে যাওয়া।

যা যা করণীয় : বাড়িতে বসেই রক্তশূন্যতা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। লক্ষণগুলো সামান্য প্রকাশ পেলেই লৌহজাতীয় খাবার নিয়মিত খেতে হবে। উদ্ভিজ ও প্রাণিজ খাদ্যে উভয়তেই আয়রন পাওয়া যায়। যেমন- কলিজা, গোশত, মাছ, ডিম, সয়াবিন, কলা, মটরশুটি, শিমের বিচি, সবুজ ও লালশাক সবজি, ফুলকপি, ডাল, বাদাম, কিসমিস, খেঁজুর, কুল (বরই), ধনেপাতা, পাকা তেঁতুল, ছোলা, আটা, শালগম, চিড়া, কালো জাম, শুঁটকি মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে এসব খাবার কিশোর-কিশোরী মহিলা মা এবং শিশুকে প্রতিনিয়ত পরিমাণমতো খেতে হবে। উদ্ভিদ খাদ্যে ফাইটেট, অক্সালেট নামক উপাদান থাকায় আয়রন শরীরে ভালোভাবে শোষিত হতে পারে না।

তবে প্রাণিজ আয়রন উদ্ভিদ আয়রন শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই আয়রনযুক্ত উদ্ভিদ খাবারের সাথে মাছ, গোশত খাওয়া ভালো। তবে মনে রাখবেন সবজি সারারাত ফ্রিজে রাখলে আয়রনের মাত্রা মারাত্মক কমে যায়। আয়রনজাতীয় খাদ্য গ্রহণের পর চা বা কফি খাবেন না। চা বা কফিতে যে ট্যানিন নামক উপাদান থাকে তা রক্তে আয়রন শোষণের মাত্রা কমিয়ে দেয়। গর্ভবতী মাকে গর্ভধারণের তিন-চার মাস থেকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং আয়রন ট্যাবলেট ৬০ গ্রাম এবং ৫০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড খাওয়া উচিত। তবে মনে রাখবেন দেহে রক্তশূন্যতা বেশি দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

কোনো অবস্থায়ই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ গ্রহণ করা যাবে না। নিজে নিজে কোনো ট্যাবলেট বা সিরাপ গ্রহণ করবেন না। আপনার শরীরের জন্য কোন ওষুধ প্রয়োজন তা চিকিৎসকই বুঝে দিবেন। অপুষ্টি, দারিদ্র্যতা, পরিবারের অধিক সদস্য সংখ্যা, কুসংস্কার এ রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। অপর দিকে, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এ রোগ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আসুন আমরা সবাই খাদ্য গ্রহণে সচেতন হই, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করি ও সুস্থ জীবন গড়ি।
লেখক : শিক্ষক, কলাম ও স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক


আরো সংবাদ



premium cement