২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বিরতিহীন বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্বোধন

উন্নয়নে রাজশাহী কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে : প্রধানমন্ত্রী

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান
গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বনলতা উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : বাসস -

ঢাকা-রাজশাহী-ঢাকা রুটে বিরতিহীন ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ ট্রেনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে যুক্ত হয়ে বাঁশি বাজিয়ে এবং সবুজ পতাকা উড়িয়ে এই নতুন ট্রেনটির উদ্বোধন করেন তিনি। এ সময় ভিডিও কনফারেন্সের অপরপ্রান্তে রাজশাহী রেলস্টেশনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ও রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। এ দিকে ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ ট্রেন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, উন্নয়নে রাজশাহী কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, কেন জানি এলাকাটার উন্নতি হয়নি। সেই জন্য আমরা রাজশাহীর দিকে আলাদাভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করছি। রাজশাহীর জন্য আমরা পদ্মা নদী ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। রেল, নৌ এবং আকাশপথের যোগাযোগেও উন্নয়ন দরকার। আমরা রাজশাহী, সৈয়দপুর ও বরিশালের বন্ধ বিমানবন্দর চালু করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামনে ঈদ আর জ্যৈষ্ঠ মাসের পাকা আমÑ দুটোই মাথায় রেখে আমরা বনলতা এক্সপ্রেস চালু করলাম। আশা করি, রাজশাহী থেকে আম আসবে। আর ঈদ করতে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরবে। তিনি বলেন, এখন রেলপথ যেন প্রতিটি বন্দরের সাথে যুক্ত হতে পারে সেই পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তাহলে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোতে সহজে কাঁচামাল নিয়ে যাওয়া এবং উৎপাদিত পণ্য পাঠানো যাবে। নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে।
তিনি আরো বলেন, ট্রেনে অল্প খরচে আরামদায়ক ভ্রমণ করা যায়। এটি নিশ্চিত করতে আমরা রেলপথকে আলাদা মন্ত্রণালয় করেছি। কেননা, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সাথে যখন রেল যুক্ত ছিল তখন বাজেটের টাকা ভাগ করার সময় রেল খুবই অল্প পেত। আমরা উন্নয়ন করে যাচ্ছি। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রয়োজন।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীই এই ট্রেনের নাম রাখেন ‘বনলতা এক্সপ্রেস’। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন ঘোষণার পর বেলা ১১টা ৪৪ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে রাজশাহী ত্যাগ করে। প্রথম দিন যাত্রীরা বিনা টিকিটেই এই ট্রেনে যাত্রা করেন। বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে রাজশাহীবাসীর একটি প্রাণের দাবি পূরণ হলো। ঢাকা-রাজশাহী যোগাযোগে যোগ হলো এক নতুন মাত্রা।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, ২০০৮ সালে আমরা ক্ষমতায় এসে রেলকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখলাম। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানের সাথে রেল যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছিল। আমরা সেসব রেল যোগাযোগ পর্যায়ক্রমে চালু করছি। রেলের জন্য আমরা নতুন নতুন বগি কিনেছি। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। আন্দোলনের নামে সরকারি সম্পদ ধ্বংস করেছে।
রাজশাহীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী মো: নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, যে দেশ যত উন্নত সে দেশের রেল তত উন্নত। বিরতিহীন ট্রেন চালুর ব্যাপারে এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের যে দাবি ছিল সেটি আজ পূর্ণ হলো। আশা করছি, রাস্তার ওপর নির্ভরতা, যানজট ও দুর্ঘটনায় প্রাণহানি থেকে মানুষ মুক্ত হবে। তিনি বলেন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম আমরা রেলের মাধ্যমে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। সেই পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলাচলকারী একটি ট্রেন যেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত যায় সেই পরিকল্পনাও আমরা ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছি। এ জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে ট্রেনের পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করছি। একটু সময় লাগবে। কিন্তু অচিরেই আমরা এটি করতে পারব।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনও। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বিরতিহীন ট্রেন চালু, এটি যে কত বড় ভাগ্য! কত বড় পাওয়া তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। ট্রেনটি চালু করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এমপি, রাজশাহী-৫ আসনের এমপি ডা: মনসুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমপি ডা: সালিম উদ্দিন আহমেদ শিমুল, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আদিবা আনজুম মিতা, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার নূর-উর-রহমান, পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এ কে এম হাফিজ আক্তার, রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মো: হুমায়ুন কবির, মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহীন আকতার রেনী, রাজশাহী পুলিশ সুপার (এসপি) মো: শহিদুল্লাহ, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক খোন্দকার শহিদুল ইসলাম প্রমুখ। ভিডিও কনফারেন্স পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসক এস এম আবদুল কাদের।
ট্রেনটিতে সংযুক্ত রয়েছে উড়োজাহাজের মতো বায়োটয়লেট। এ কারণে মলমূত্র রেললাইনের ওপরে পড়বে না। রয়েছে রিক্লেনার চেয়ার ও স্লাইডিং ডোর। আছে ওয়াইফাই সুবিধা। প্রতিটি বগিতে রয়েছে এলইডি ডিসপ্লে, যার মাধ্যমে স্টেশন ও ভ্রমণের তথ্য প্রদর্শন করা হবে। রয়েছে ওজুখানা ও নামাজের স্থান। এ ছাড়া রয়েছে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট আসন। কিন্তু নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোনো ধরনের শ্লিপিং বার্থ। ট্রেনটি শুধু দিনের বেলায় চলাচল করবে, তাই এর দরকার পড়ছে না আপাতত।
ট্রেনের একটি খাওয়ার বগি ও পাওয়ার কার বগি বাদেই মোট আসন সংখ্যা ৯২৭টি। বিরতিহীন চার্জ ধরে এই ট্রেনে ভ্রমণের জন্য অন্য ট্রেনের তুলনায় যাত্রীদের ১০ শতাংশ বেশি ভাড়া গুনতে হবে। সাধারণ শোভন চেয়ারের ভাড়া পড়বে ৩৭৪ টাকা। আর এসি চেয়ারের ভাড়া লাগবে ৭২২ টাকা। বলা হচ্ছে, বনলতা ঢাকা-রাজশাহীর ৩৪৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে চার ঘণ্টা ৪০ মিনিটে। অন্য ট্রেনের তুলনায় সময় বাঁচবে প্রায় দুই ঘণ্টা। ঘণ্টায় ট্রেনটির সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠবে ৯০ থেকে ৯৫ কিলোমিটার।
আগামী ২৭ এপ্রিল থেকে সপ্তাহের শুক্রবার বাদ দিয়ে বাকি ছয় দিন ট্রেনটি ঢাকা-রাজশাহী-ঢাকা রুটে চলাচল করবে। সকাল ৭টায় ট্রেনটি রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে পৌঁছাবে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। আর ঢাকা থেকে বেলা ১টা ১৫ মিনিটে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী পৌঁছাবে সন্ধ্যা ৬টায়। রাজশাহী-ঢাকা রুটে এত দিন আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা এক্সপ্রেস, ধূমকেতু ও সিল্কসিটি এক্সপ্রেস চলাচল করত। বনলতা এক্সপ্রেস চালুর মাধ্যমে এই রুটে এখন আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা হলো চারটি।
এ দিকে অপর একটি সূত্র জানায়, দেশের প্রথম ও সর্বাধুনিক হাইস্পিড ট্রেন ‘বনলতা এক্সপ্রেস’। কিন্তু ট্রেনটি পাচ্ছে পুরনো দুটি ইঞ্জিন। ফলে প্রত্যাশিত গতিবেগ উঠবে না রাজশাহী-ঢাকা রুটের প্রথম ও একমাত্র বিরতিহীন এই ট্রেনের। তবে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, বনলতা চলাচলের জন্য যে দু’টি ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে সেগুলো ২০১৩ সালে ভারত থেকে আমদানি করা। এই ইঞ্জিনে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ৯০ থেকে ৯৫ কিলোমিটার।
অন্য দিকে, বনলতার সর্বাধুনিক হাইস্পিড কোচের ঘণ্টায় গতিবেগ ১৪০ কিলোমিটার। নতুন ইঞ্জিন পেলে এটি প্রতি মিনিটে পাড়ি দিতে সক্ষম আড়াই কিলোমিটার পথ। ৩৪৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই ট্রেন ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টায় পৌঁছে যেত গন্তব্যে।
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উন্নয়ন-অগ্রগতির অন্তরায় এবং একটি বৈশ্বিক সমস্যা আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কে কোথায় সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের সাথে লিপ্ত সেটা শুধু গোয়েন্দা সংস্থাই নয়, আমাদের দেশবাসীকেও সতর্ক থাকতে হবে এবং এদের খুঁজে বের করে সাথে সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে জানাতে হবে।’ ‘কারণ, আমরা দেশে শান্তি চাই। শান্তিই দিতে পারে উন্নতি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ হলেই দেশ এগিয়ে যাবে,’ যোগ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা গতকাল সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা-রাজশাহী রুটে প্রথম বিরতিহীন আন্তঃনগর ট্রেন বনলতা এক্সপ্রেসের উদ্বোধনকালে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর জ্যেষ্ঠ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপির নাতি ছোট্ট শিশু জায়ান চৌধুরীর কলম্বোয় বোমা হামলায় মৃত্যুর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, কয়েক দিন আগে ২১ তারিখে শ্রীলঙ্কায় যে ঘটনা ঘটল তাতে আমরা বাংলাদেশের কয়েকজনকে হারিয়েছি। সব থেকে দুর্ভাগ্য অনেক শিশু সেখানে মারা যায়। যেখানে আমাদের বাংলাদেশের শিশু জায়ানকে হারাতে হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশেও এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর অনেক চেষ্টা চলছে। তবে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, যারা ইসলাম ধর্মের নাম নিয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ চালায় তারা এই পবিত্র ধর্মকে কলুষিত করছে। বিশ্বব্যাপী এই পবিত্র ধর্মের বদনাম করছে। তারা আসলে ইসলাম ধর্মের প্রচণ্ড ক্ষতি করে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘যে ধর্ম সব থেকে মানবতার ধর্ম, সব থেকে শান্তির ধর্ম- সেই ধর্মের নামে তারা জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে। কাজেই এ ধরনের কাজে যারা সম্পৃক্ত-তাদেরকে বিরত থাকতে হবে।’
গত রোববার শ্রীলঙ্কায় গির্জা, অভিজাত হোটেল ও কলম্বোর পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৫৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জুমার খুতবায় সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে তরুণ এবং যুবসমাজকে এ সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী শুক্রবার দিন প্রতিটি মসজিদে শ্রীলঙ্কার এই বোমা হামলা এবং জায়ান চৌধুরীর নিহত হওয়ার ঘটনায় এবং এর আগে নিউজিল্যান্ডের দু’টি মসজিদে গুলি চালিয়ে মুসলমানদের হত্যার ঘটনায় আপনারা দোয়া কামনা করবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement