০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্র হচ্ছে পাকিস্তান!

-

পাকিস্তান কি এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে? সাম্প্রতিক সময়ে বেশ বড় ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে এ অঞ্চলে। ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে চিরচেনা সমীকরণগুলো। বিশ্লেষকেরা নতুন করে ভাবতে বসেছেন, সূত্র মেলানোর চেষ্টা করছেন। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার ও তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা জোরদার হওয়া, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর-কেন্দ্রিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মধ্য এশিয়ার অর্থনীতিকে বিন্যস্ত করার পরিকল্পনা, হঠাৎ করে সৌদি আরবের পাকিস্তান, ভারত, চীন, বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগে এগিয়ে আসার মতো ঘটনা অনেক হিসাবই বদলে দিয়েছে।
মার্কিন-নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তানে আবার তালেবানের ক্ষমতায় ফেরা নিশ্চিত। তালেবানের সাথে রয়েছে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক। ফলে কাবুলের বর্তমান সরকারের ভারতের দিকে ঝুঁকে থাকার বর্তমান অবস্থার অবসান হতে পারে আফগান শান্তিচুক্তির পর। এতে এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব কমার পাশাপাশি ও পাকিস্তানের প্রভাব বাড়বে। আর তা আশপাশের এলাকায়ও সম্প্রসারিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে সিপিইসির মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থানও জোরদার করার সুযোগ করে নিতে পারবে পাকিস্তান।
তবে পাকিস্তানকে সবচেয়ে বেশি জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে। সিপিইসির অন্যতম প্রকল্প গোয়াদর বন্দরে সৌদি আরবের বিপুল বিনিয়োগের ফলে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ইরান-সৌদি দ্বন্দ্ব এবার পাকিস্তানে এসে ভিড়তে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে মার্কিন অবরোধের ফলে ইরান তার প্রধান রাজস্ব উৎস তেল বিক্রি করতে না পেরে যখন বেশ বিপর্যয়কর অবস্থায় রয়েছে, তখনই সৌদি আরব ইরানের ঘরের কাছে পাকিস্তানি বন্দর গোয়াদরে তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠা করে এই এলাকার তেলবাজার হাতের মুঠোয় নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এটি ইরানকে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করেছে।
মার্কিন অবরোধের জের ধরে ইরানি তেল রফতানি দিনে প্রায় এক মিলিয়ন ডলার হ্রাস পাওয়ায় দেশটির প্রধান রাজস্ব আয় কমে গেছে। শতাধিক বড় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক, তেল রফতানিকারক ইরান থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে।
এ দিকে জ্বালানি সরবরাহে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও বাজারের আরো বড় অংশ দখল করার জন্য তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে রিয়াদ। এশিয়ার বাজার ধরে রাখা এবং সৌদি তেলের সাথে পাল্লা দিতে ইরান ব্যবসা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। চীন তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য বিশ্ববাজারের মোট সরবরাহের এক-তৃতীয়াংশ কেনে। আর তা ইরানি প্রয়োজন মেটানোর জন্য খুবই দরকারি। ভারতও বিপুল পরিমাণ ইরানি তেল কেনে। সিপিইসিতে তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে এই উভয় দেশেই খুব সহজে, কম খরচে তেল সরবরাহ করতে পারবে সৌদি আরব।
বিশ্লেষকদের মতে, এশিয়া হলো তেলের পরবর্তী প্রজন্মের মূল্যবান বাজার। পাশ্চাত্য বিকল্প জ্বালানি সমাধান পেলেও এশিয়ার মর্যাদা অটুট থাকবে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো আগামী কয়েক দশকে প্রধান তেল রফতানি বাজার হিসেবেই বিরাজ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন অর্থনৈতিক কৌশলকে আরো এগিয়ে নিতে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি ইসলামাবাদ, নয়াদিল্লি ও বেইজিং সফর করেছেন। তেল শোধনাগার ও এ সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে রিয়াদ গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের বন্দর নগরী গোয়াদর থেকে সৌদি আরব বিশেষভাবে উপকৃত হবে। এই বন্দর দিয়ে সৌদি আরব মাত্র সাত দিনে চীনে তেল সরবরাহ করতে পারবে। ফলে এটিই সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার জন্য প্রধান বেস স্টেশন হতে পারে।
অবশ্য এটা প্রায় উইন-উইন অবস্থা। অবশ্য এর একটি বিপরীত চিত্রও আছে। সেদিকেও নজর দিতে হবে।
এশিয়ার তেল বাজারের একটি বড় অংশ থেকে তেহরানকে সৌদি আরবের বঞ্চিত করার ফলে ইরান চাইবে না তার খুব কাছাকাছি জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান করুক। ইরানের সাথে পাকিস্তানের দীর্ঘ মরু সীমান্ত রয়েছে। আর ভারতের সাথে তৈরি হতে থাকা ইরানি বন্দর চাহাবার থেকে গোয়াদরের দূরত্ব মাত্র ১৭৫ মাইল। আরো খারাপ বিষয় হলো, সিরিয়া ও ইয়েমেনের প্রক্সি যুদ্ধে ইরান ও সৌদি আরব পরস্পর বিপরীত দিকে রয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এসব উত্তেজনাকর বিষয়ের প্রেক্ষাপটে রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পাকিস্তানকে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। উভয় দেশকে হাতে রাখার মতো করে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা সহজ কাজ নয়। সাম্প্রতিক অতীতে ইয়েমেন ইস্যুতে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করার ফলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছিল পাকিস্তানের। আবার ২০১৫ সালে সৌদি আরব যখন সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে ইরান, ইরাক ও সিরিয়াকে বাদ দিয়ে ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স গঠন করে পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রাহিল শরিফকে এর প্রধান করেছিল, তখন ইরান ব্যাখ্যা চেয়েছিল।
এখন পর্যন্ত গোয়াদরের প্রতি হুমকি বিবেচিত হয়নি চাহাবার। ইরানের দক্ষিণ উপকূলে বন্দর আব্বাসের উন্নতি অব্যাহত রয়েছে। ফলে চাহাবার ইরানের জন্য একটি বিকল্প মাত্র। আবার ইরান যদি সিপিইসি বা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় যোগ দেয় তবে এটি হতে পারে গোয়াদর বন্দরের সহযোগী। তবে এখন তা সুদূরের ঘটনা বলে মনে হচ্ছে। ইরান এখন সম্ভবত চাহাবারকে গোয়াদরে সৌদি উপস্থিতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাবে।
একই ধরনের শঙ্কা অনুভব করে পাকিস্তানের সাবেক বন্দর ও জাহাজ চলাচলবিষয়ক মন্ত্রী মির হাসিল খান বিজেনজোহাস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গোয়াদর হলো ইরানের চাহাবারের কাছে। আর রেকো দিক প্রকল্পটি জাহেদানের (ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী) দ্বারপ্রান্তে। সুন্নি উগ্রবাদীরা (তারা সৌদি ওয়াহাবি মতাদর্শের অনুসারী) ওই এলাকায় সক্রিয়। তাহলে কেন গোয়াদরে সৌদি আরবের বিনিয়োগে তেহরান উদ্বিগ্ন হবে না?
উত্তপ্ত সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে অতীতেও সমস্যা ছিল, পাকিস্তান ২০১০ সালে ইরানের অনুরোধে সুন্নি বিদ্রোহী নেতা আবদুল মালেক রিগিকে গ্রেফতার করেছিল। তবে এখন কোনো গোলযোগ হলে ইরান হয়তো সৌদি আরবকে দায়ী করবে। আর এর ফলে চাহাবার হতে পারে গোয়াদর বন্দরের নিরাপত্তা প্রতিদ্বন্দ্বী। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য পাকিস্তানকে কঠোর নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে হবে, দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি কামনা করতে হতে পারে।
একই সাথে সৌদি-ইরান সম্পর্কে সমন্বয় সাধনও (উভয় পক্ষের মধ্যেই কট্টরপন্থী থাকলেও) সব পক্ষের জন্য সেরা বিকল্প হতে পারে। রিয়াদ ও তেহরান উভয় পক্ষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দেশ বিবেচিত পাকিস্তান তাদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি অবসানে ভূমিকা রাখতে পারে। মুসলিম পরমাণুশক্তিধর দেশ হিসেবে সৌদি নিরাপত্তা সমাধানে গুরত্বপূর্ণ দেশ। পাকিস্তানে রয়েছে ইরানের বিশেষ স্বার্থ। ইরানের পর পাকিস্তানেই রয়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম শিয়া জনসংখ্যার উপস্থিতি।
এ ধরনের মধ্যস্থতার বিষয়টি উপলব্ধি করে গত বছর নির্বাচিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমাদের লক্ষ্য হবে মধ্যপ্রাচ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস চালানো। আমরা ওই ভূমিকা পালন করতে চাই। নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করার আশাবাদ ব্যক্ত করে ইরানও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফকে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল।
গত বছর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস প্রথমবারের মতো উদযাপন করেছিল ইরান। কিন্তু পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফরে সৌদি আরব গিয়েছিলেন, যদিও ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিই প্রথম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইমরান সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চেয়েছেন। বোধগম্যভাবেই অবরোধে ভারাক্রান্ত ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত ইরানের কাছে একই কামনা করার প্রশ্নই ছিল না।
পাকিস্তানের সামনে এটি একটি বড় ধরনের সমস্যা আবার সম্ভাবনাও। পাকিস্তান যদি দক্ষতার সাথে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে তবে তার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement