ফেসবুকে যেভাবে সক্রিয় অপহরণকারী চক্র
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৪৩
মধ্যরাত। ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং করছে তেইশোর্ধ্ব যুবক অনিক (ছদ্মনাম)। হঠাৎ এক সুন্দরী তরুণীর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। রিকোয়েস্ট পেয়ে, ওই তরুণীর প্রোফাইল দেখছিল ছেলেটি। এরই মধ্যে ম্যাসেঞ্জারে এসএমএস ‘হাই কিউট বয়’। উত্তর দেয় অনিকও। হয়তো তার কোনো বান্ধবী মনে করে রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে। কিছুক্ষণ পরেই অনিকের ম্যাসেঞ্জারে অডিও কল। হ্যালো বলতেই, অপরপ্রান্ত থেকে এক নারীকণ্ঠে ঘুমাওনি এখনো। কিছুটা অবাক হয়ে উত্তর দেয় অনিক, না ঘুমাইনি। এরপর একটু আধটু কথা। ফেসবুকে সুন্দর চেহারার ছবি আর মিষ্টিকণ্ঠ শুনে প্রতিদিনই কথা হয় ভার্চুয়ালে পরিচয় হওয়া মেয়েটির সাথে। তারপর মোবাইল নম্বর আদান প্রদান। সামাজিক বন্ধুত্ব থেকে পরে ধীর ধীরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ে যায় ছেলেটি।
এ যাত্রায় ছেলেটি বেঁচে গেলেও অনেকেই এমন ভার্চুয়াল প্রেমের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। জানা গেছে, বেশ কিছু প্রতারকচক্র আছে, যারা তাদের গ্রুপের মধ্যে এক দুইজন নারী সদস্যের টোপ দিয়ে টার্গেট করা ব্যক্তিদের সাথে বিভিন্নভাবে সম্পর্ক করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে থাকে। বিষয়টি হাতেগোনা কয়েকজন র্যাব-পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থায় অভিযোগ করলেও বেশির ভাগ ভুক্তভোগীই মানসম্মানের ভয়ে বা পারিবারিক কলহের কারণে চেপে যান।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ চক্রগুলো সুন্দরী মেয়ের ছবি দিয়ে ফেসবুকে ফেইক আইডির মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও চাকরিজীবীদের টার্গেট করে থাকে। এ ক্ষেত্রে চক্রের ছেলে সদস্যরা টার্গেটকৃত ব্যক্তির বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়। এরপর নারী সদস্যদের দিয়ে টোপ ফেলা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন কৌশলে প্রতারকচক্র টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করে থাকে। কখনো কখনো অপহরণ, কখনোবা মাইক্রোবাসে যাত্রী তুলে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করে রাস্তায় ফেলে যায়।
এমন একটি প্রতারকচক্রের এক নারীসদস্য কাজল বেগমসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। র্যাব জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে ছেলেদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করত সঙ্ঘবদ্ধ অপহরণ চক্রের এক নারীসদস্য কাজল। সম্পর্কের এক মাসের মধ্যেই প্রেমিকের সাথে দেখা করার প্রস্তাব দিয়ে দেখা করার ফাঁদে ফেলে প্রেমিককে অপহরণ করে দাবি করত মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ।
এ চক্রটি রায়হান (২৪) নামে এক যুবককে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ করে। এরপর র্যাবের হাতে চক্রের ৫ সদস্যকে আটকের পর বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। গত বুধবার দিনগত রাতে সাভারের আমিন বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে র্যাব-৪। গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন- আজিজুল হাকিম (৪০), লিটন মোল্লা (২৬), নজরুল ইসলাম বাবু (৪২), নুরু মিয়া (৬২)। এ সময় উদ্ধার করা হয় অপহৃত রায়হানকে।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির। তিনি বলেন, রাজধানীর কলাবাগান থেকে গত ১২ এপ্রিল রাত ১১টা ১৫ মিনিটের দিকে অপহরহণকারীরা রায়হানকে (২৪) অপহরণ করে সাভারের আমিন বাজারে নিয়ে আটকে রাখে। ছয় দিন রায়হানকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পর পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর পরিবারের সাথে আলোচনা করে ৫ লাখ টাকায় মুক্তিপণ রফাদফা হয়।
রায়হানের পরিবার চক্রের সদস্য বাহারের সাথে যোগাযোগ করে মিরপুরের ৬০ ফিট ভাঙা ব্রিজের কাছে সিগারেটের বক্সের ভেতর করে এক লাখ টাকা নিয়ে আসে। বাকি ৪ লাখ টাকা না দিলে রায়হানকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় চক্রটি। পরে র্যাবের কাছে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চক্রের ৫ সদস্য গ্রেফতারসহ উদ্ধার করা হয় রায়হানকে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপহরণকারীরা জানায়, তারা দশ বছর ধরে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও চাকরিজীবী এবং তাদের পরিবারের সদস্যকে টার্গেট করে মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন ও কৌশলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে।
অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির আরো বলেন, নুরু মিয়া (৬২) ও কাজল বেগম (২৬) বাবা-মেয়ের পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া নেয়। ভাড়া বাসাতেই তারা অপহরণ করে নিয়ে এসে নির্যাতন ও মুক্তিপণ দাবি করত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টের পাওয়ার ভয়ে এক মাস কিংবা দুই মাস পর পর তারা বাসা পরিবর্তন করে ফেলে।
তিনি বলেন, সাধারণত লোকলজ্জার ভয়ে প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আসে না। অনেকেই লাখ লাখ টাকা গচ্চা দিয়েও ভয়ে কিংবা মানসম্মানের জন্য কাউকে জানায় না।
অপহরণকারী চক্রের কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢাকাসহ আশপাশের বাসস্টেশন থেকে যাত্রীদের চাহিদা মতো স্থানে যাওয়ার কথা বলে মাইক্রো বা প্রাইভেটকারে ওঠায়। এরপর গাড়িতে যাত্রীবেশে আগে থেকে অবস্থানকৃত ৩-৪ জন গাড়ি চলা অবস্থায় ভিকটিমকে অজ্ঞান করে। কখনো হাত-পা ও মুখ বেঁধে তাদেরকে পরিকল্পিত এলাকায় নিয়ে আসে এবং ভিকটিমকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে ভিকটিমের পরিবার-পরিজনদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে।
কখনো সুন্দরী মেয়ের ছবি দিয়ে ফেসবুকে ফেইক আইডির মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও চাকরিজীবীদের টার্গেট করে তার সাথে বন্ধুত্বের মাধ্যমে মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে এবং পরে ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। একপর্যায়ে ভিকটিমের সাথে দেখা করার কথা বলে অপহরণ করে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা