২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণতন্ত্র নাকি ভিন্ন কিছু

-

গ্রিক শব্দ ডেমোক্র্যাশিয়া থেকে ইংরেজি ডেমোক্র্যাসি শব্দের উৎপত্তি। এই ডেমোক্র্যাসির বাংলা হলো ‘গণতন্ত্র’, যার অর্থ ‘জনগণের শাসন’। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিসের শহর রাষ্ট্র অ্যাথেন্সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটানো ব্যবস্থার প্রয়াসে ডেমোক্র্যাশিয়া শব্দের ধারণা জন্ম নেয়। একসময় একে ডেমোক্র্যাশিয়া অর্থাৎ জনগণের শক্তি বলা হতো। খ্রিষ্টপূর্ব ৪২২ সালে Clean ডেমোক্র্যাসিকে বর্ণনা করেছেন এভাবেÑ That shall be the democratic which shall be the people, for the people.
গণতন্ত্র নামের ব্যবস্থাটিকে পরিবার, সমাজ, সংগঠন সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করলেও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ সর্বাধিক। আর রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে মজবুত করতে প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের সমান ভোটাধিকার রাষ্ট্রকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের সর্বাধিক অধিকার।
এর বিপরীতে, ১৯২২ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ইতালির ৪০তম প্রধানমন্ত্রী হয়েও মুসোলিনি ১৯২৫ সালে নব শাসন ব্যবস্থার জন্ম দেন। তিনি ১৯৩৬ সালে সরকারিভাবে এই শাসন ব্যবস্থার মোড়লে ‘ডুচে অব ফ্যাসিজম’ উপাধি গ্রহণ করেন। এর অর্থ ফ্যাসিজমের নেতা।
ফ্যাসিজম হচ্ছে এমন একটা চরমপন্থা, যেখানে আদর্শহীন জাতীয়তাবাদের নামে খামখেয়ালি ও কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনৈতিক এক মতাদর্শ ব্যাঘাত ঘটায় জনজীবনে এবং রাষ্ট্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সর্বগ্রাসী দল বা গোষ্ঠী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়। ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসীরা মুখে রাষ্ট্রের গুরুত্বের কথা বলতে থাকে এমনভাবে, যেখানে সবকিছুকেই রাষ্ট্রের নামে নিজেদের অধীন মনে করে। ফলে গণতন্ত্রে জাতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বিচার করলেও তা ফ্যাসিজমে করা হয় না। তাদের কাছে ভিন্নমতের কোনো ঠাঁই নেই। তারা ক্ষমতায় থাকলে ভিন্নমতকে সহ্য না করে চরমভাবে দমন করে। আর তা করতে গিয়ে রাষ্ট্রে চলে নিপীড়নÑনির্যাতন, ধর্ষণ, গুম এবং হত্যা। সেখানে মানবতা বলতে কিছুই থাকে না, থাকে শুধু সন্তান হারানোর করুণ আর্তনাদ। আদালতের দরজায় ন্যায় বিচার তখন ডুকরে ডুকরে কাঁদে।
রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফ্যাসিজম চেপে বসলে, সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়। তখন মানুষ বেশকিছু বিপদ সঙ্কেত দেখতে পায়Ñ ফ্যাসিজমে বিশ্বাসীদের সাথে কথিত মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়। তারা নিজেদের শত্রুকে চিহ্নিত করে চরম আঘাত করে, করপোরেট শক্তির সুরক্ষার জন্য শ্রমজীবী শক্তির প্রতি দমনমূলক আচরণ, অবাধ দলবাজির মাধ্যমে দুর্নীতিকে ছড়িয়ে দেয়া ও গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণসহ বুদ্ধিজীবীদের অবজ্ঞা এবং অপরাধের বিপরীতে শাস্তি নিয়ে টালবাহানা পরিশেষে প্রতারণামূলক নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসে।
বর্তমান সময়ে পৃথিবীর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পপুলিজম নামে এক পুরাতন ইজম নতুন করে ফিরে এসেছে। যার বাংলা লোকরঞ্জনবাদ বা জনতুষ্টিবাদ। এই তুষ্টিবাদের নেতারা সাধারণ জনগণের দেশাত্ববোধ, আবেগ ও বঞ্চনা থেকে হতাশাকে চিহ্নিত করে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় বিষয়কে মিশ্রিত করে জনগণকে জাতিগত ও ধর্মীয় দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের স্বপ্নে মাতহারা করে তোলে। যেমনÑ রাশিয়ার পুতিন, আমেরিকার ট্রাম্প, ভারতের মোদি ও ফিলিপাইনের দুতার্তে। তাদের মধ্যে কেউ আবার জনপ্রিয় নীতিবোধ থেকে আর কেউ উগ্র জনগণের উগ্রতা দিয়ে।
জনতুষ্ঠিবাদী নেতারা জনগণকে স্বপ্ন দেখান। হতাশা থেকে মুক্তির স্বপ্ন, অলৌকিক স্বপ্নও তারা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে দেখান। যা আদৌ পূরণ করা সম্ভব কি না, তা চিন্তায় রাখেন না। দেশের সব সমস্যার জন্য বিদেশী কিংবা দেশীয় প্রতিপক্ষকে দায়ী করেন।
১৯৫টি স্বাধীন দেশসহ ২৩৪টির মতো দেশে বেশকিছু তন্ত্র বিরাজমান। গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের আড়ালে আজকের বিশ্বে ফ্যাসিজম ও জনতুষ্টিবাদ এক নব অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আমি যে দেশকে নিয়ে গর্ব করি, সেই বাংলাদেশ কোন তন্ত্রের আড়ালে তার রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালিত হচ্ছেÑ তা অনেকের মতো আমার জানার আগ্রহ জাগে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি ছাত্র ও যুবসমাজ। দেশের ৬৫ শতাংশ তরুণ। যাদের মধ্য থেকে প্রায় ২২ লাখ প্রতিবছর কর্মবাজারে আসছে। অথচ তাদের ৪৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছে। এদের অনেককেই পড়াতে গিয়ে অনেক পরিবার দারিদ্র্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে। কিন্তু চাকরি তাদের কাছে সোনার হরিণ। কেননা নানান কোটায় আজ মেধা হচ্ছে শিকল খাঁচায় আবদ্ধ। কী দুর্ভাগ্য জাতির চাকরির জন্য মেধাবীরা যখন রাজপথে, তখনো ৩০ লাখ তরুণের ২৫ ধরনের পদে নিয়োগ আবেদন প্রায় দুই বছর আটকে রেখেছে সোনালী, জনতা, কৃষি, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান। না হচ্ছে পরীক্ষা, না হচ্ছে চাকরি, জমছে শুধু দীর্ঘশ্বাস। বিপরীত মেধার বিনিময়ে চাকরি এ স্লোগানে বিদ্যাঙ্গনগুলো যখন মুখরিত, সেই সময় রাষ্ট্রের তথাকথিত সরকার তার রাজনৈতি পেশিশক্তির অহঙ্কার ছাত্র বাহিনী দিয়ে বিদ্যাপীঠকে করে যাচ্ছে কলঙ্কিত।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে ৩০০ জন আইন প্রণেতার মধ্যে ১৫৩ জন বিনাভোটে এমপি। আর তাদের দিয়ে গঠিত তথাকথিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে উদাসীন হবেন তাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মাত্রা কোনো পর্যায়ে সীমা অতিক্রম করলে জাতির চিন্তাশক্তি বিভ্রান্ত, কর্মশক্তি দ্বিধাগ্রস্ত ও মন উত্তেজিত হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত করে জীবনকে, তা লেখার ক্ষমতা অনেকটা দূরসাধ্য।
কোনো দেশে একাধারে যুবক ও শেয়ার বাজারের মাধ্যমে জনগণের লাখো কোটি টাকা লোপাট করা, হলমার্কের মাধ্যমে ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লকারের টাকা বিদেশে পাচার এবং সোনা তামা হওয়া, কয়লা হয়ে যায় ময়লা অতঃপর ভোট রাজনীতির দৃশ্যমান উন্নয়নে সমগ্র দেশের রাস্তাঘাটগুলো সম্পূর্ণ বেহাল ও বীভৎস, যা কল্পনা করলে ভয়ঙ্কর চিত্র ফুঁটে উঠে। তার বিপরীতে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি ও চালকের আসনে অদক্ষ লোকের অনুমতি প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। এ অবস্থায় নিহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা না জানিয়ে অট্টহাসি দেয়া একজন অনির্বাচিত মন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব।
পৃথিবীর মাঝে অমরত্ব হওয়ার বহু কৌশল রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তা হওয়া অতি সহজ। কেননা এর চাইতে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির অস্তিত্ব জগতে নেই বললেই চলে। অন্য দিকে, যারাই রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে সমাজ ও দেশে বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে মানবসৃষ্ট নিকৃষ্ট বিপর্যয় আনেন, সময় তাদের উচিত শিক্ষা দিতে ভুল করে না।
একটা দেশে ফ্যাসিজম কী পরিমাণ দানা বাঁধলে ন্যূনতম দাবি নিয়ে ১৪-১৬ বছরের কোমলমতি ছাত্রদের পরিবহন নৈরাজ্যের লাগাম টানার অধিকারসংবলিত আহ্বানে সরকার পুলিশ ও পেটুয়া বাহিনী দিয়ে তাদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করতে পারে।
১৯৮৩ সালে পরিবহন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন আইন ৩৫ বছর পর আজ আর কার্যকর হতে পারে না। তেমনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত ৩০ শতাংশ কোটা আজো কি যৌক্তিক? তা ছাড়া স্বাভাবিক নিয়মেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমে প্রায় ২৫ হাজার হওয়ার কথা।
ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা অন্যের অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তিগত বিষয় ততক্ষণ ব্যক্তিগত, যতক্ষণ তা কারও পছন্দ কিংবা অপছন্দের বিষয়বস্তু না হয়। একজন মানুষের আচরণে পরিবারের কোনো সদস্যকে, সমাজের কোনো সংস্কৃতিকে এবং দেশের কোনো নাগরিককে প্রভাবিত ও উদ্বুদ্ধ করলে তা পারিবারিক ও সামাজিক এবং জাতীয়পর্যায় রূপ নেয়।


আরো সংবাদ



premium cement