২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
‘চুরিহাট্টা ট্ট্যাজেডি’

এখনো পোড়া লাশের সন্ধানে স্বজনরা

প্রতিদিনই খোঁজ নিচ্ছেন হাসপাতাল মর্গ আর থানায়
এখনো পোড়া লাশের সন্ধানে স্বজনরা - নয়া দিগন্ত ফাইল ছবি

চুড়িহাট্টায় আগুনে পোড়া লাশের সন্ধানে এখনো  এদিক-ওদিক  ছুটছেন স্বজনরা। চকবাজারের সেই ভয়াবহ অগুনের পর দেড় মাসেরও বেশি সময় চলে গেছে। কিন্তু এখনো কয়লা হয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের সন্ধান পায়নি অনেকে। পুরো লাশ না হোক, সামান্য ছিঁটেফোঁটা হলেও প্রতিনিয়ত তারই সন্ধান করছেন নিহতের আপন লোকজন। হাসপাতালের মর্গ, আশপাশের থানায় এবং বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মগবাজারস্থ অফিসে গিয়েও মিনতি কণ্ঠে লাশের সন্ধান চাইছেন তারা।

গত কয়েকদিনে চুরিহাট্টার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, চকবাজার থানার পুলিশ কর্মকর্তা আর মগবাজারের রেডক্রিসেন্ট অফিসে গিয়ে মিলেছে লাশের খোঁজে আসা স্বজনদের নানা তথ্য। কথা হয়েছে লাশ না পাওয়া কয়েকজন হতভাগ্য ব্যক্তির সাথেও। নয়া দিগন্তের সাথে এসব ব্যক্তির আলাপকালে জানা গেল প্রিয়জনের লাশ না পাওয়ার কষ্ট আর লাশ খোঁজার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। স্বজনদের একটিই প্রশ্ন, ‘কোথায় পচছে আমাদের স্বজনদের এসব পোড়া লাশ’ ?

এদিকে চকবাজারে আগুনের পর স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তরের তিনটি আলাদা তালিকা তৈরি করে পৃথক তিনটি সংস্থা। ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চকবাজার থানা এবং রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এই তালিকা তিনটি প্রস্তুত করেছে। তিন তালিকাতেই দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি লাশের খোঁজ এখনো মিলছে না। যদিও চকবাজার থানায় গিয়ে তাদের তালিকা অনুযায়ী তিনটি লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রয়েছে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ মোরাদুল ইসলাম জানিয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পরে দুটি লাশের ডিএনএ টেষ্টের মাধ্যমে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে।

স্ত্রী সন্তান অথবা স্বামীর লাশ এখনো খুঁজে পাননি এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে তারা থানা থেকেও আশানুরূপ কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। তাদের মাঝে মাঝে মনে হয়, চকবাজারের থানা পুলিশও কী যেন আড়াল করতে চাইছেন।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ফিল্ড অফিসার (মাঠ কর্মকর্তা) শাকিলা আক্তার নয়া দিগন্তকে জানান, এখনো সব লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, লাশগুলো এতটাই  আগুনে পুড়ে গিয়েছিল যে এগুলোকে আর লাশও বলা যায় না। একেবারে কয়লা হয়ে গেছে। সব লাশ সনাক্ত করা না গেলে লাশগুলো তাহলে এখন কোথায় আছে এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে অফিসিয়ালি যে রেকর্ড আছে তাতে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে কিছু লাশ এখনো হিমায়িত অবস্থায় আছে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমেই এগুলো আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এর বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে এখনো পাঁচটি লাশ রয়েছে এমন দাবি করে এই কর্মকর্তা রেড ক্রিসেন্টের নিজস্ব রেকর্ড বই থেকে সেগুলোর একটি তালিকাও দিয়েছেন।

তালিকা অনুযায়ী দেখা গেছে পাঁচটি লাশের নাম। সেগুলো হলো আশেক লাল, বিবি হালিমা শিল্পী, ফয়সাল সারোয়ার, রফিক ও মোহাম্মদ রনি। চকবাজার থানা থেকে সংগ্রহ করা তালিকায় অবশ্য ফয়সাল সারোয়ারের লাশ সিআইডির কর্তৃক ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে স্বজনদের কাছে হন্তান্তরের তালিকায় দেখানো হয়েছে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি চুরিহাট্টায় আগুনে পুড়ে মারা গেছে চকবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন সুমনের মামা সালেহ আহমেদ (মরদেহ ব্যাগ নং- ১০), এবং মামী নাসরিন জাহান (মরদেহ ব্যাগ নং- ৩০) । তাদের সাথে ছিল পাঁচ বছরের শিশু সন্তান আত-তাহী। ঘটনার দিন বাবা মায়ের সাথে আগুনে পুড়ে মারা যায় অবুঝ এই শিশু সন্তানটিও। জাকির হোসেন জানান, মামা মামীর লাশ আমরা পেয়েছি।

কিন্তু পাঁচ বছরের শিশু আমার মামাতো ভাই আত-তাহীর লাশ আমরা এখনো খুঁজে পাইনি। থানায় জিডি করতে চেয়েছিলাম। পুলিশ আমাকে বলেছে, জিডি করার দরকার নেই, লাশের সন্ধান পেলে আমরাই আপনাকে জানাব। কিন্তু আমরা বসে নেই। বিভিন্ন স্থানে লোক মারফত প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর নিচ্ছি। লাশের খোঁজ পাওয়ার চেষ্টা করছি।

স্ত্রীর লাশের সন্ধান পেতে এখনো বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গ আর থানায় নিয়মিত দৌড়াচ্ছেন জহিরুল হক সুমন। ঘরে তার ছোট ছোট দুটি মেয়ে সন্তান। আমার মেয়েরা তার মাকে হয়তো কোন দিন পাবে না, কিন্তু মায়ের কবর তো দেখতে পাবে? সেই জন্যই লাশের খোঁজে আজ থানায় তো কাল মর্গে এখনো দৌড়াচ্ছেন তিনি। ঘটনার পরের দিন স্ত্রীর লাশের সন্ধান চেয়ে চকবাজার থানায় জিডিও করেছেন। জিডি নং ৯৯৪ তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।

চুরিহাট্টা মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়েন এখানকারই বাসিন্দা মোহাম্মদ সাহেব উল্লাহ। ঘটনার দিন ২০ ফেব্রুয়ারি এশার নামাজের পরে তিনিও ছিলেন ঘটনাস্থলে। আগুন লাগার ঠিক ৫/৬ মিনিট আগে কাছেই এক দোকানে চা খাচ্ছিলেন তিনি। আগুনের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি জানালেন, ওই দিন কত লোক এখানে নিহত হয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। কেননা আগুনের তীব্রতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, লাশগুলো কয়লা হয়ে গিয়েছিল।

এছাড়া ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের পানির তোড়ে লাশের হাড়গোড় সব কিছুই ছাই হয়ে ড্রেনে চলে গেছে। লাশ মিলবে কোথা থেকে? এর পরও প্রতিদিনই অনেক অপরিচিতজন চুরিহাট্টায় আসেন আপনজনের লাশের তালাশে।

চকবাজার থানা সূত্র জানায়, ঘটনার পর আগুনে পুড়ে যাওয়া বেশিরভাগ লাশই চেনা যায়নি। তারপরও নিহতের নিকট আত্মীয়রা তাদের পরিচিত পোশাকের কিছু অবশিষ্ট অংশ দেখে চিহ্নিত করছেন। নিহতের আত্মীয়দের দাবি অনুযায়ী তাদের কাছে লাশগুলো হন্তান্তর করা হয়। সূত্রটি আরো জানায়, প্রথম দিনে অর্থাৎ ঘটনার পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি ৪৫টি লাশ, ২২ ফেব্রুয়ারি একটি লাশ, ২৩ ফেব্রুয়ারি দুটি লাশ হস্তান্তর করা হয়। এরপরে পর্যায়ক্রমে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২টি, পহেলা মার্চ একটি, ২ মার্চ একটি, ৬ মার্চ ৮ টি, ৭ মার্চ ৩টি, ১২ মার্চ ৪টি পোড়া লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

চকবাজার থানা পুলিশের তালিকায় দেখা গেছে লাশ ব্যাগ নং- ২৪, ৫২ এবং ৫৪ এই তিনটি লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখার কথা বলা হয়েছে। পরে অবশ্য চকবাজার থানা থেকে জানানো হয়েছে এই লাশ তিনটিও সিআইডি কর্র্তৃক ডিএনএ পরিক্ষার মাধ্যমে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের রিপোর্টে ঘটনার পরে ১২ মার্চ পর্যন্ত ৯ দফায় মোট ৬৭টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর পরে সিআইডি কর্তৃক লাশ এবং স্বজনদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে আরো দুটি লাশ হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে।

অন্যদিকে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির তালিকার মধ্যে দেখা গেছে চুরিহাট্টায় আগুনের ঘটনায় মোট ৭৬ জন হতাহত হয়েছেন। এর মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া ৫৭ টি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। আর ৫টি লাশ ডিএনএ পরীক্ষা করে স্বজনদের কাছে দেয়া হয়েছে।

এভাবে মোট ৬২টি লাশ হস্তান্তরের রেকর্ড রেডক্রিসেন্ট কাছে রক্ষিত আছে। বাকি ১৪ জনকে ঘটনার পরের দিন থেকে ৩/৪ দিনের মধ্যেই জীবিত অবস্থায় বাইরে এবং বিভিন্ন হাসপাতালে চিক কিৎসাধীন অবস্থায় পাওয়া যায়।
রেডক্রিসেন্ট সূত্র আরো জানায়, পাঁচটি লাশের খোঁজ নিতে এখনো মগবাজারে আমাদের অফিসে নিয়মিত আসছে নিহতের স্বজনরা। স্বজনদের ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করেছে সিআইডি। পরিক্ষাটি অনেক ব্যয়বহুল। একটু সময়ও লাগছে। নমুনা মিলে গেলে বিভিন্ন মর্গে রাখা লাশগুলো দাবিদার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement