১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বাল্টিমোর সেতুতে আঘাতের আগে 'মে ডে' বার্তা পাঠিয়েছিল জাহাজটি

ভেঙে পড়া ব্রিজের একটা অংশ - ছবি - বিবিসি

সাড়ে নয় শ’ ফিট লম্বা বিশাল ডালি জাহাজের কর্মীরা যখন বুঝতে পারলো যে, কী হতে যাচ্ছে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর শহরের ল্যান্ডমার্ক হিসাবে পরিচিত পাটাপস্কো নদীর ওপরে ফ্রান্সিস স্কট কী সেতুতে সেই জাহাজের ধাক্কায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সে সময় সেতুটিতে বেশ কয়েকটি যানবাহন অতিক্রম করছিলো। লাইনটি দুই দশমিক ছয় কিলোমিটারের ও বেশি দীর্ঘ ছিলে।

কর্মকর্তারা বলছেন, জাহাজটিতে ‘বিদ্যুতের সমস্যা’ ছিল এবং দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে একটি ফোনকলে তা জানিয়েছিলে।

বাল্টিমোর বন্দর থেকে শ্রীলঙ্কায় ২৭ দিনের যাত্রার শুরুতে বন্দর ছেড়ে যাওয়ার পরে জাহাজটির বিদ্যুৎ একেবারেই চলে গিয়েছিল। এটি এ সময় সেটি ফ্রান্সিস স্কট কী সেতুর দিকে যাচ্ছিল।

যখন জাহাজের আলো হঠাৎ নিভে যায় তখন মধ্যরাত ছিলে, জাহাজের নাবিকরা এ সময় অন্ধকারে ডুবে যায়।

জাহাজটি অকার্যকর হয়ে গিয়েছিলে, কোনো ইলেকট্রনিক্স এবং ইঞ্জিনের পাওয়ার ছিলে না। যা ঘটছিল তখন তা থামানোর জন্য তাদের কোনো উপায় ছিলে না।

সমস্যাটি সমাধান করতে এবং বিদ্যুৎ ফিরে পেতে নাবিকদের আপ্রাণ ব্যর্থ চেষ্টার সময় একাধিক অ্যালার্ম বেজে উঠেছিলে।

জাহাজের পাইলট নাবিকদের আদেশ দিয়েছিলেন, রাডারটিকে পোর্টের দিকে শক্তভাবে ধরে রাখতে এবং নোঙ্গর ফেলে দিতে বলেছিলেন যাতে স্টারবোর্ডটি ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যায়।

একটি জরুরি জেনারেটর থাকলেও জাহাজের ইঞ্জিনগুলো ব্যবহার করা যায়নি।

জাহাজটির পাইলটের আর কোনো উপায় ছিল না। দেড়টার কিছুক্ষণ আগে, তারা একটি মে ডে কল করে আসন্ন সংঘর্ষের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে।

রেডিও ট্র্যাফিক রেকর্ডে মেরিল্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটির একজন কর্মকর্তার কথা শোনা যায়, ‘একটি জাহাজ আসছে যেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, যতক্ষণ না আপনি এটি নিয়ন্ত্রণে না পান, আমাদের সমস্ত ট্র্যাফিক বন্ধ করতে হবে।’

নিখোঁজদের সন্ধানে চলছে তল্লাশি
সেতুটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর ছয়জন নিখোঁজ রয়েছে। তারা মারা গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নিখোঁজ ছয়জনের সন্ধানে নৌকা এবং হেলিকপ্টারগুলো অনুসন্ধান প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আরো দু’জনকে পানি থেকে তোলা হয়েছে, যাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।

ইউএস কোস্ট গার্ডের রিয়ার অ্যাডমিরাল শ্যানন গিলরথ সন্ধ্যায় বলেছেন, পানির তাপমাত্রা এবং কতক্ষণ তারা পানির নিচে ছিল তার ওপর ভিত্তি করে বাকি নিখোঁজ ব্যক্তি যারা পানিতে পড়েছিল তাদের মৃত বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।

মেরিল্যান্ডের গভর্নর ওয়েস মুর পরে নাবিকদের ‘নায়ক’ হিসাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ‘জীবন বাঁচিয়েছে’।

কারণ কর্তৃপক্ষ কল এবং সংঘর্ষের দুই মিনিটের মধ্যে সেতুতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলে।

স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ছয়জন শ্রমিক মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হনডুরাস এবং এল সালভাদরের নাগরিক।

বিবিসি নিজে এটি নিশ্চিত হতে পারেনি এবং এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য কনস্যুলার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছে।

জাহাজের ২২ জন নাবিকই ছিল ভারতীয়। জাহাজের নাবিকদের কেউ তেমন কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি।

৪৭ বছরের পুরনো সেতুটির এমন নাটকীয় ধ্বংস গভর্নর মুর সহ শহরের অনেককে নাড়া দিয়েছিল।

মঙ্গলবার একটি সংবাদ সম্মেলনে মুর বলেন, “এটি এমন একটি জায়গা যেটা প্রতিদিন ৩০ হাজার মেরিল্যান্ডবাসীর জন্য স্বাভাবিক যাতায়াতের পথ। 'কী ব্রিজ ভেঙে পড়েছে' এটা শোনা খুবই মর্মান্তিক। এটি হৃদয় বিদারক।”

ঠিক কি কারণে ডালি জাহাজটিতে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়।

ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের চেয়ারম্যান জেনিফার হোমেন্ডি বলেছেন, তদন্তকারীরা এখন সমুদ্রযাত্রার ডেটা রেকর্ডার থেকে তথ্য চাইবে।

‘এটি আমাদের তদন্তের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ’ বলেন তিনি।

মঙ্গলবার সকালে বাল্টিমোরে সূর্য উঠার পর সেতুর কাছাকাছি থাকা শ্রমজীবী এলাকার বাসিন্দারা জেগে উঠে এমন দৃশ্যে হতবাক হয়ে যায়।

‘আমি এটা অনুভব করেছি, পুরো বাড়ি কেঁপে উঠেছে,’ পানির কাছাকাছি বসবাসকারী জন ফ্ল্যান্সবার্গ বিবিসিকে বলেছেন।

‘আজকের দিনটা ভালো যাবে না। অনেক ট্র্যাজেডি।’

অন্য এক এলাকার বাসিন্দা, ডারলিন আরউইন বলেছেন, তিনি ‘গড়গড় শব্দ’ শুনে প্রথমে বুঝতে পেরেছিলেন যে একটি সমস্যা ছিল।

কয়েক ঘণ্টা পরে, যখন তিনি তার জানালা দিয়ে পাটাপস্কো নদীর দিকে তাকান তখনই ধ্বংসের মাত্রা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ধসে পড়া সেতুর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে কমপক্ষে তিন হাজার কনটেইনার বহনকারী বিশাল পণ্যবাহী জাহাজটি আটকে ছিল।

ততক্ষণে পুরো এলাকাটি অনুসন্ধান ও উদ্ধার চেষ্টার দৃশ্যে পরিণত হয়েছিলে।

একটি স্থানীয় স্কুলে, দু’টি মার্কিন সামরিক ইউএইচ - ৬০ ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার একটি খেলার মাঠে পার্ক করা ছিল।

‘এখন দিনের আলোতে এটি দেখতে খুবই মর্মান্তিক,’ মিসেস আরউইন বলছিলেন।

যদিও কর্মকর্তারা বার বার নিখোঁজদের সন্ধানে জোর দিয়েছিলেন। ঘটনাটি মার্কিন পূর্ব উপকূলের অন্যতম ব্যস্ততম বাল্টিমোর বন্দরেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।

মেরিল্যান্ডের সিনেটর বেন কার্ডিন সাংবাদিকদের বলেছেন, জলপথটি পুনরায় চালু করা মার্কিন অর্থনীতির জন্য ‘ক্রিটিকেল’ হবে।

বন্দরটি ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়াম থেকে শুরু করে কৃষি সরঞ্জাম পণ্যের জন্য একটি মূল আঞ্চলিক কেন্দ্র।

বন্দরটি জেনারেল মোটরস এবং হোন্ডাসহ গাড়ির নির্মাতারা ব্যবহার করে।

মেরিল্যান্ড পোর্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্যে দেখা যায়, বন্দরটিতে গত বছর কমপক্ষে সাড়ে সাত লাখ যানবাহন চলাচল করেছে।

মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে বক্তৃতা দেয়ার সময়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তিনি তার নিজ রাজ্য ডেলাওয়্যার এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে ‘অনেক, অনেকবার’ এই সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াত করেছেন।

এটি পুনরায় চালুর জন্য যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন তা নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

‘এই জরুরি অবস্থায় তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যয় করব’ বলেন তিনি।

‘একইসাথে আমরা সেই বন্দরটি পুনর্নির্মাণ করতে যাচ্ছি।’

বাইডেন যোগ করেন, ১৫ হাজার চাকরি ‘এই বন্দরের ওপর নির্ভর করে’।

কর্তৃপক্ষ বলছে, আপাতত তারা সম্পূর্ণভাবে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানের দিকে মনোযোগ দেবে।

মুর বলেছেন, পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া ‘সংক্ষিপ্ত হবে না’।

জাহাজ ডালির জন্য এই ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়।

একটি ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ভেসেল ফাইন্ডারের তথ্য অনুযায়ী, জাহাজটি ২০১৬ সালে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প বন্দরে আরেকটি সংঘর্ষে জড়িত ছিল। সেই সময়ে কোনো হতাহত বা উল্লেখযোগ্য ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement