১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কাশ্মিরে সশস্ত্র হামলা সামলাতে কড়া নির্দেশ মোদির

অস্ত্রধারীদের খোঁজ চলছে এখনো - ছবি : সংগৃহীত

ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে একের পর এক সশস্ত্র হামলার পরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্দেশ দিয়েছেন যেন তাদের দমনে যে সমস্ত ব্যবস্থাপনা আছে তা যেন অতি দ্রুত সেখানে কাজে লাগানো হয়।

গত রোববার থেকে শুরু হয়ে পর পর একটি সশস্ত্র হামলা ও তিন জায়গায় অস্ত্রধারীদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। ওই সব ঘটনায় নয়জন হিন্দু তীর্থযাত্রী, একজন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্য ও দুজন সন্দেহভাজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য মারা গেছেন।

কাশ্মিরের পুলিশ সন্দেহ করছে নতুন কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী জম্মু-কাশ্মিরে প্রবেশ করে এই হামলাগুলো চালাচ্ছে।

আরো অস্ত্রধারী কাঠুয়া আর ডোডা অঞ্চলে লুকিয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। তাই অচেনা ব্যক্তি বা সন্দেহজনক বস্তুর ব্যাপারে এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে পুলিশ, এমনটাই খবর সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের।

জম্মু-কাশ্মির পুলিশ তাদের এক্স হ্যান্ডেলে চারজন সন্দেহভাজন সশস্ত্র ব্যক্তির ছবি প্রকাশ করেছে এবং প্রত্যেকের ব্যাপারে তথ্য দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ ভারতীয় রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

কী নির্দেশ দিলেন নরেন্দ্র মোদি
জম্মু-কাশ্মিরে লাগাতার সশস্ত্র হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী মোদি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বৈঠকে বসেছিলেন।

সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে যে বৈঠকে জম্মু-কাশ্মিরের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রীর সামনে ব্যাখ্যা করেন ডোভালসহ পদস্থ কর্মকর্তারা।

সশস্ত্র গোষ্ঠী দমনে নিরাপত্তা বাহিনী এবং এজেন্সিগুলো কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তারও বিস্তারিত জানানো হয় বৈঠকে।

এরপরই মোদি নির্দেশ দেন যে সশস্ত্র গোষ্ঠী দমনের যত ব্যবস্থাপনা আছে, তার প্রত্যেকটিকে কাজে লাগাতে হবে। বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী ও এজেন্সির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সম্ভাব্য হুমকিগুলোর মোকাবিলা করার কথা বলেছেন মোদি, সরকারি সূত্রগুলো উদ্ধৃত করে জানিয়েছে এএনআই।

বাড়তি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সাথে আলাদা করে কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদি।

গত রোববার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয়বার শপথ নেয়ার দিনই এই সপ্তাহের প্রথম সশস্ত্র হামলা হয় জম্মু-কাশ্মিরের রিয়াসি জেলায়। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহন করা একটি বাসের ওপরে হামলা চালায় অস্ত্রধারীরা, যাতে নয়জনের মৃত্যু হয়।

এরপর কাঠুয়া ও ডোডা জেলায় পরপর সশস্ত্র ব্যক্তি ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।

হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপরে হামলা
গত রোববার রিয়াসিতে ভক্তদের একটি বাসে হামলার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক সশস্ত্র হামলাগুলোর সূত্রপাত।

জম্মুর রিয়াসিতে তীর্থযাত্রীদের একটি বাস লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা। বাসটি খাদে পড়ে যাওয়ার পরও গুলি বৃষ্টি চলতে থাকে বলে ওই বাসের জীবিত যাত্রীরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। ওই ঘটনায় বাসটির চালক এবং কন্ডাক্টরসহ নয়জন মারা যান ও ৩৩ জন আহত হন।

হামলায় আহত অতুল মিশ্র সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেছিলেন, আমাদের বাসটি শিবখোরি থেকে কাটরা যাচ্ছিল। হঠাৎই একজন অস্ত্রধারী গুলি চালাতে শুরু করে, যার পরে আমরা বাসে শুয়ে পড়ি। তখনই বাসটি খাদে পড়ে যায়। গোলাগুলি থেমে গেলে কিছু লোক আমাদের খাদ থেকে তুলে আনে এবং তারপর অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।

চলতি বছরে জম্মু ও কাশ্মিরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এটিই সব থেকে বড় প্রাণঘাতী হামলা।

তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হামলাটি এমন একটি এলাকায় সংঘটিত হয়েছে যা এর আগে শান্তিপূর্ণ বলেই বিবেচিত হতো।

রিয়াসি হামলার সময়ে বাসটিতে অন্তত ৫০ জন যাত্রী ছিলেন। বাসের নিহত চালক ও কন্ডাক্টর জম্মুর বাসিন্দা। নিহতদের মধ্যে চারজন রাজস্থানের এবং তিনজন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা।

একই দিনে দুই জায়গায় সংঘর্ষ
রিয়াসির ঘটনার পরে জম্মুর কাঠুয়া ও ডোডায় অস্ত্রধারীদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর তিনটি সংঘর্ষ হয়েছে, যার সর্বশেষটি শুরু হয় বৃহস্পতিবার।

সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে যে- বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে কাঠুয়া জেলার সাইদা সুখাল গ্রামটি ঘিরে ফেলে তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। সেখানে দুজন অস্ত্রধারী লুকিয়ে থাকতে পারে, গোপন সূত্রে এই খবর পেয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে বলে সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে।

জম্মু পুলিশ এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ১১ জুন সন্ধ্যায় সাইদা সুখাল গ্রামে দুই ব্যক্তি আসে। কয়েকটি বাড়িতে তারা জল চাইতে গেলে গ্রামবাসীর সন্দেহ হয়। গ্রামবাসী দরজা বন্ধ করে দেয়। এ সময় কেউ কেউ চেচামেচি শুরু করলে অস্ত্রধারী এই ব্যক্তিরা আতঙ্কিত হয়ে শূন্যে গুলি চালাতে শুরু করে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন গ্রামের এক ব্যক্তি। তার চিকিৎসা চলছে।

এরপরই নিরাপত্তা বাহিনী চলে যায় গ্রামটিতে এবং সশস্ত্র ব্যক্তিদের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়।

কাঠুয়ার ওই গ্রামটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রথম অভিযানটি চলে প্রায় ১৫ ঘণ্টা। দীর্ঘ ওই অপারেশনের পরে দুজন সন্দেহভাজন অস্ত্রধারী ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।

এক কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যও ওই সংঘর্ষে মারা গেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।

পুলিশ সূত্র উদ্ধৃত করে বিবিসির সংবাদদাতা রিয়াজ মাশরূর জানাচ্ছেন, ‘লাশ দুটির কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে গুলিসহ একটি এমফোর রাইফেল, একটি একে অ্যাসল্ট রাইফেল, একটি স্যাটেলাইট ফোন এবং দুই লাখ ১০ হাজার ভারতীয় টাকা পাওয়া গেছে। এছাড়াও পাকিস্তানে প্রস্তুত খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ ও কিছু বৈদ্যুতিক যন্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদের একজন জৈশ-এ-মোহাম্মদের বড়মাপের সদস্য বলে মনে করছে নিরাপত্তা বাহিনী।’

একই দিনে ডোডা জেলাতেও মঙ্গলবার বিকেল থেকে সশস্ত্র ব্যক্তিদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর পৃথক একটি সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।

জম্মুর পীরপাঞ্জালে বাড়ছে সশস্ত্র হামলা
জম্মু অঞ্চলের পুঞ্চ এবং রাজৌরি জেলাদুটি পীর পাঞ্জাল পর্বতমালার মধ্যে পড়ে।

গত মাসে পুঞ্চ জেলার সুরানকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি কনভয়ে হামলা চালায় সশস্ত্র ব্যক্তিরা। এতে বিমান বাহিনীর এক সদস্য নিহত ও চারজন আহত হন।

এরপরই ওই এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী, যা বেশ কয়েকদিন ধরে চলে। সশস্ত্র ব্যক্তিদের অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আবার ৩১ মে পুঞ্চের মারহা বুফলিয়াজে রাতভর তল্লাশি অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র ব্যক্তিদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। কিন্তু অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে অস্ত্রধারীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

রিয়াসিতে তীর্থযাত্রীদের বাসের ওপরে এই হামলার ঘটনা ২০২২ সালের পর জম্মুতে তীর্থযাত্রীদের উপর দ্বিতীয় হামলা।

প্রথম হামলা হয়েছিল ২০২২ সালের মে মাসে। হিন্দু তীর্থস্থান বৈষ্ণোদেবী থেকে ফেরার পথে একটি বাসে আগুন লাগে। এতে চারজন তীর্থযাত্রী নিহত ও ২৪ জন আহত হন।

প্রাথমিক তদন্তে এটিকে দুর্ঘটনা বলা হলেও পরে জানা যায়- ওই বাসে বোমা রেখে দেয়া হয়েছিল।

সেই বোমা বিস্ফোরণেই বাসে আগুন ধরে যায়।

গত বছর তিনেক ধরে, ২০২১ সাল থেকে জম্মুর পির পাঞ্জাল অঞ্চলের রাজৌরি ও পুঞ্চ জেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে এবং এতে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এইসব ঘটনায় গত বছর জম্মু অঞ্চলে মোট ১৯ জন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। গত দুই বছরে পীরপাঞ্জলে দুই ডজনেরও বেশি সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন।

সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে জম্মু ও কাশ্মিরে নিরাপত্তা বাহিনীর হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement