বিজেপির স্বেচ্ছাসেবীরা হোয়াটসঅ্যাপে যেভাবে লাখ লাখ মানুষকে নিশানা করছেন
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩০ মে ২০২৪, ০৯:৩৮, আপডেট: ৩০ মে ২০২৪, ০৯:৪০
বিজেপি কর্মী অঙ্কুর রানা দ্রুত ফোন টাইপ করে চলেছেন। কয়েক শ’ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বার্তা পাঠাচ্ছেন, যেগুলো তারই তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মীরাট লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর তিনি। গত মাসে সেখানে ভোটের আগে বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমার ৪০০ থেকে ৪৫০টি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে, যার প্রতিটিতে ২০০ বা ৩০০ জন সদস্য আছেন।’
‘এছাড়া প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এভাবে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষের কাছে পৌঁছাই।’
তিনি একটি প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ দলের অংশ ছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল লাখ লাখ ভোটার এবং গোষ্ঠীর কাছে বিজেপির বার্তা পৌঁছে দেয়া। উত্তরপ্রদেশের আরো কয়েক ডজন লোকসভা আসনে এই একই রকমের দল গঠন করা হয়।
বিজেপির এই ‘হোয়াটসঅ্যাপ অভিযানে’র ব্যাপকতা কিন্তু সত্যিই বিস্ময়কর।
চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনে ৩৭০টি আসনের টার্গেটে পৌঁছানোর জন্য অন্যান্য মেসেজিং অ্যাপ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপকেই মূল পথ হিসাবে বেছে নিয়েছিল বিজেপি। এবং এর পিছনে একটা সঙ্গত কারণও রয়েছে। বিশ্বে হোয়াটসঅ্যাপের বৃহত্তম মার্কেট ভারত।
৫০ কোটিরও বেশি মানুষ প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময় এই মেসেজিং প্ল্যাটফর্মে ব্যয় করেন।
হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রতিদিন 'গুড মর্নিং' থেকে শুরু করে 'মিম'- অনেক কিছুই একে অন্যের সাথে ভাগ করে নেন ভারতীয়রা। এর মধ্যে বিভিন্ন ভাষায় শেয়ার করা রাজনৈতিক টিপ্পনিও রয়েছে।
আর অঙ্কুর রাণার মতো স্বেচ্ছাসেবকরা নির্বাচনী যন্ত্রের মূল অংশ। বিজেপির বার্তা যাতে ওই 'ফরওয়ার্ড' করা বার্তার মধ্যে থাকে সেটা সুনিশ্চিত করাটা তাদের কাজ।
উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় সোশ্যাল মিডিয়া সমন্বয়কারী হিসাবে কাজ করেন এমন আরো ১০ জন বিজেপি কর্মীর সাথে বিবিসি কথা বলেছে, যাদের প্রত্যেকেই জানিয়েছেন যে তারা কয়েক শ’ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পরিচলনা করেন। এর প্রত্যেকটিতে ২০০ থেকে ২০০০ সদস্য রয়েছে।
এটি একটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত অভিযান এবং মীরাটের বিজেপি স্বেচ্ছাসেবকরা জানিয়েছেন প্রতিদিন দিল্লির সদর দফতর থেকে তাদের রাজনৈতিক বার্তা এবং 'হ্যাশট্যাগ' পাঠানো হয়।
এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির প্রশংসা থেকে শুরু করে বিরোধীদের সমালোচনা পর্যন্ত রয়েছে, যা রাজ্য স্তরের সদর দফতরে প্রবাহিত হওয়া দরকার বলে ওই দলটি মনে করে।
সেখান থেকে অঙ্কুর রানা-সহ মীরাটের ১৮০ জন স্বেচ্ছাসেবকের কাছে পৌঁছে যায় এই বার্তা। এই স্বেচ্ছাসেবকরা আবার শৃঙ্খলের আরো নিচু তলাতে বার্তা পৌঁছে দেন। আর এইভাবে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পোলিং বুথ পরিচালনাকারী ব্যক্তির কাছেই পৌঁছে যায় সমস্ত বার্তা।
প্রতিদিনের টার্গেট
তরুণদের কাছে পৌঁছানোর জন্য হোয়াটসঅ্যাপ বিশেষভাবে কার্যকর, বলছিলেন রানা।
যে সময়টাতে বিজেপির হয়ে বিনা বেতনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন না তিনি, সেই সময়ে মুম্বাইয়ে একটি ডিজিটাল বিপণন সংস্থা চালান।
তার মতে, চল্লিশোর্ধ্বরা আবার ফেসবুকে বেশি সক্রিয়।
রানা বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় লাখ নতুন মানুষের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে আমাদের।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে অনেকটা এগিয়ে বিজেপি।
যদিও দলের কর্মীদের বক্তব্য, ব্যক্তিগত স্তরের সম্পর্ক ছাড়া এটা সম্ভব নয়, কারণ আগে তাদের নতুন ফোন নাম্বার জোগাড় করতে হবে।
মীরাটের একটি বুথের কাছে বিজেপির হয়ে প্রচারের দায়িত্বে থাকা বিপিন বিপালা বলছিলেন, ‘সভাপতি-সহ আমাদের দলের একেবারে নিচুতলা থেকে শীর্ষ পর্যন্ত প্রত্যেক সদস্য ৬০ জন ভোটারের জন্য দায়বদ্ধ।’
তিনি বলেন, ‘যে ৬০ জনের দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়েছে, তাদের সাথে নিরন্তর যোগাযোগ রাখতে হয় এবং সেটাও সামনাসামনি। বিজেপিকে ভোট দেয়ার জন্য তাদের উৎসাহিত করতে হয়।’
‘তাদের কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নেয়া এবং আমাদের মেসেজিং গ্রুপে সেটি অন্তর্ভুক্ত করাও আমাদের দায়িত্ব’, জানান তিনি।
তার দায়িত্বে থাকা ভোটারদের নিয়ে বিপিন যে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছেন তার নাম 'হিউম্যানিটি ইজ লাইফ'।
যা থেকে বোঝা যায়, ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপকে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক চেহারা না-দিতেও চেষ্টা করা হয়, যাতে এর আবেদন বজায় থাকে।
তবে ইন্টারনেটে কোনো কিছু একেবারে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখাটা যে বেশ কঠিন বিষয়, এটা সবাই জানেন।
এবং যখন সেই বার্তা ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট এবং গ্রুপগুলোতে পাঠানো হচ্ছে, তখন কী ধরনের বার্তা শেয়ার করা হচ্ছে এবং তার উৎসই বা কী, সেটা জানাও খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
কী জাতীয় বার্তা পাঠানো হয়?
একটি ভাইরাল বার্তা, যা বিভিন্ন গ্রুপে বহুবার ফরোয়ার্ড করা হয়েছিল সেখানে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু মুসলিমদের তোষণ করার অভিযোগ আনা হয়। সেই ভাইরাল বার্তা বিবিসির নজরেও এসেছে।
সেখানে হিন্দিতে লেখা ছিল, ‘কংগ্রেস ইতোমধ্যেই ভারতকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে, তারা কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ঘোষণা করেনি।’
ওই হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় ১৮টি পন্থার তালিকা প্রকাশ করে দাবি করা হয়েছিল, ওই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেই না কি কংগ্রেস মুসলিমদের তোষণ করে থাকে।
এই বার্তার উৎস কোথায় তা প্রমাণ করা অসম্ভব। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে নির্বাচনী সমাবেশে বিজেপি নেতৃত্বের মন্তব্যের প্রতিফলন কিন্তু এই বার্তায় দেখা যায়।
গত এপ্রিল মাসে যেমন একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধেও 'ইসলামোফোবিয়ার' অভিযোগ তোলা হয়েছিল।
কারণ একটি নির্বাচনী সভায় তিনি মন্তব্য করেছিলেন বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে জনগণের সম্পদ 'অনুপ্রবেশকারীদের' মধ্যে বিলিয়ে দেবে।
'অনুপ্রবেশকারী' বলে প্রধানমন্ত্রী মুসলিমদের ইঙ্গিত করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
এর পুনরাবৃত্তি করে বিজেপি তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হ্যান্ডলগুলো থেকে অ্যানিমেটেড ভিডিও-ও শেয়ার করেছে।
বিজেপি নেতাদের যে দাবি, কংগ্রেসের ইস্তাহারে বিষয়টির (জনগণের সম্পত্তি মুসলিমদের বিলিয়ে দেয়ার) উল্লেখ রয়েছে, সেটা কিন্তু ভুল। বাস্তবে কংগ্রেসের ইশতেহারে সম্পদ পুনর্বণ্টন বা মুসলমান জাতীয় শব্দের উল্লেখই নেই।
রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিরণ গারিমেলা ভারতে হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করছেন।
তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আনুষ্ঠানিক মতাদর্শের প্রতিফলন সাধারণত ব্যক্তিগত গ্রুপগুলিতে শেয়ার করা বার্তাতেও দেখা যায়।
তিনি বলেন, ‘তাদের (বিজেপির) টপ-ডাউন পদ্ধতি রয়েছে, আইটি সেল-এর (বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া টিম) অভিযান আছে, সেই অভিযানকে ঘিরে একটা কনটেন্ট তৈরি করা হয় যা ক্রমাগত শেয়ার করা হয়। তবে এই পুরো জিনিসটার বিশেষত্ব হচ্ছে, সাধারণ মানুষও এই মতাদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে।’
তিনি বলেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে দেয়া বার্তার প্রকৃতি দেখে এটা বোঝা কঠিন যে কোন কনটেন্ট আইটি সেল থেকে এসেছে এবং কোনটি দলের সমর্থকদের।’
এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, বার্তাগুলো একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলেও দ্রুত অন্যান্য প্ল্যাটফর্মেও যদি দেখা যেতে থাকে, তখন মানুষ ভাবতে বাধ্য হন তারা যা দেখছেন সেটাই সত্যি!
বিজেপির বিজ্ঞাপন
এবারের ভোটে বিজেপির প্রচারমূলক বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছে, ইউক্রেনে আটকে পড়া পড়ুয়াদের সরিয়ে ফেলতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ 'থামিয়ে দিয়েছিলেন' প্রধানমন্ত্রী মোদি।
দাবিটি প্রথম ২০২২ সালের মার্চ মাসে করা হয়েছিল, যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক পরপরই। এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) বেশ কয়েকজন ব্যক্তি একই জিনিস শেয়ার করেন।
বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমও অতিরঞ্জিত করে বিষয়টি পেশ করে।
সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই দাবি নাকচ করে দেয়। তাদের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘কেউ বোমা হামলা রুখে দিয়েছে বা আমরা এটি সমন্বয় করছি, এইসব বলাটা সম্পূর্ণ ভুল বলে আমি মনে করি।’
কিন্তু দুই বছর পর বিজেপির শীর্ষ নেতারা নির্বাচনী প্রচারের সময় বিষয়টি আবার উল্লেখ করছেন। এই বিজ্ঞাপনটি সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
কেন এই দাবির পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নের কোনো জবাব অবশ্য দেয়নি বিজেপি।
সমাজ মাধ্যমের প্রভাব
মীরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে, আমরা বিশের কোঠায় থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তারা দাবিটি শুনেছে কি না এবং তা বিশ্বাস করেছে কি না। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী জানিয়েছে এক্স হ্যান্ডেলে এই ভিডিওটি তারা দেখেছে।
বিশাল ভার্মা ও তার বন্ধুরা সবাই সায় দিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি ভারতের অনুরোধে যুদ্ধে বিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল।’
আমাদের চারপাশে জড়ো হওয়া অন্য শিক্ষার্থীরাও মাথা নাড়িয়ে একই কথা জানাল। মাত্র কয়েকজন শিক্ষার্থী দ্বিমত পোষণ করেন।
তাদেরই একজন কবির। তিনি বলেন, ‘এটি সত্যি নয়। আমি ছাত্রদের তৈরি ভিডিও দেখেছি, তারা বলেছে সরকার তাদের সাহায্য করেনি।’
আশপাশের গ্রামবাসীদেরও আমরা একই কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তারা জানিয়েছিলেন টেলিভিশনে সম্প্রচারিত সংবাদে তারা এই দাবির কথা শুনেছেন।
৪১ বছরের সঞ্জীব কাশ্যপ বলেন, 'হ্যাঁ, যুদ্ধবিরতি হয়েছিল বিশ্ব মোদিকে সম্মান করে তাই!’ পেশায় একজন কৃষক তিনি।
৭৫ বছরের জগদীশ চৌধুরী বলেন, ‘দেখুন, আমরা শুনেছি যে যুদ্ধ থেমে গেছে, আমরা নিজে সেখানে গিয়ে দেখিনি। তবে আমি মনে করি এর মধ্যে অবশ্যই কিছু সত্যতা রয়েছে।’ আরো চারজন গ্রামবাসীর সাথে সহমত প্রকাশ করে এই কথাগুলো বলেছিলেন তিনি।
মানুষের বিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে পারা একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। শেষ পর্যন্ত, জনগণ কাকে ভোট দেবে তাও প্রভাবিত করতে পারে এই শক্তি।
সূত্র : বিবিসি