১৬ জুন ২০২৪
`

ভারতের নির্বাচনে মুসলিমদের নিশানা করে প্রচারণা

- সংগৃহীত

গত মাসে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার মুসলিম-বিরোধী বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।

তবে এটা এমন না যে শুধু মোদিই মুসলিমদের নিয়ে বিতর্কিত বক্তৃতাবাজি করছেন। তার ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) টানা তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতায় আসার প্রচেষ্টায় দলের শীর্ষ নেতারা একই ধরনের মনোভাবের প্রতিধ্বনি করছেন।

হিন্দুতভা ওয়াচ নামে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক একটি বেসরকারি সংগঠন, ১৯ এপ্রিল ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকে শত শত জনসভা নথিভুক্ত করেছে, যেখানে বিজেপির ‘তারকা প্রচারক’ এবং প্রার্থীরা মুসলিমদের নিশানা করে উস্কানিমুলক ভাষণ দিয়েছেন।

হিন্দুতভা ওয়াচ-এর প্রতিষ্ঠাতা রাকিব হামিদ নাইক বলেন, মোদি ছাড়াও বিজেপির নামকরা প্রচারকদের মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, বিজেপির জাতীয় প্রেসিডেন্ট জগত প্রকাশ নাড্ডা এবং কয়েকটি বড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

এক সাক্ষাৎকারে নাইক বলেন, ‘এরাই সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন।’

বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচন
ভারতের ছয় সপ্তাহ-ব্যাপী নির্বাচনে বিজেপি লড়াই করছে বিরোধীদের একটি জোটের বিরুদ্ধে। বিশ্বের সব চেয়ে বড় গণ্য করা এই নির্বাচন ১ জুন পর্যন্ত চলবে এবং ৪ জুন ভোট গণনা এবং ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

গত ২১ এপ্রিল মোদি বিতর্কের ঝড় তুলে ফেলেন, যখন তিনি তার সমর্থকদের সাবধান করে বলেন যে বিরোধী ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে তারা ভারতের সম্পদ ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘যাদের বেশি বাচ্চা-কাচ্চা’ তাদের মাঝে বিতরণ করে দেবে।

এক সময় ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটি দিয়ে বাঙালি শরণার্থীদের বোঝানো হতো। কিন্তু ইদানিং এই শব্দ দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ভারতের ২০ কোটি মুসলিমদের বেলায় ব্যবহার করে, তাদের সবাইকে বহিরাগত হিসেবে বর্ণনা করার জন্য।

মুসলিমদের মাঝে-মধ্যে ‘সন্তান উৎপাদক’ বলা হয়, যেটা একটা ভিত্তিহীন অভিযোগ, যা দিয়ে তাদের জনসংখ্যার ব্যাপারে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।

বিষয়টি এই পটভূমিতে দেখে, বিরোধী দল এবং অধিকার নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠীগুলো মোদির মন্তব্যর নিন্দা করে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই তার কথার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে অন্যান্য বিজেপি নেতাদের মুখে।

নাইক একজন নির্বাসিত কাশ্মিরি মুসলিম সাংবাদিক। ২০২১ সালে হিন্দুতভা ওয়াচ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। পরের বছরগুলোতে তারা ভারতে ঘৃণাসূচক বক্তব্য এবং অপরাধ-সংক্রান্ত তথ্যের ভাণ্ডার হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো তাদের কাজ উদ্ধৃত করে।

হিন্দুতভা ওয়াচ যদিও প্রায় তিন হাজার ঘৃণাসূচক বক্তব্য এবং অপরাধ নথিভুক্ত করেছে। নাইক বলেন, এই বছর নির্বাচন-কেন্দ্রিক ঘৃণা ছিল নজিরবিহীন।

তিনি বলেন, ‘মুসলিমদের নিশানা করে এমন উস্কানিমুলক, ঘৃণাসুলভ জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচনী প্রচারণা আমি এর আগে কখনো দেখিনি।’

নয়া দিল্লিতে বিজেপির মুখপাত্র এবং ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসে মন্তব্য চেয়ে বার বার ইমেইল করা হয়। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বিজেপির লবি প্রতিষ্ঠানের কাছে মন্তব্য চেয়েছে।

গত সপ্তাহে, মোদি তার ‘অনুপ্রবেশকারী’ মন্তব্য নিয়ে যে বিতর্ক, তা নিয়ে আলাপ করেন। স্থানীয় গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার সময় তিনি অস্বীকার করেন যে তিনি ‘মুসলিমদের বেশি বাচ্চা-কাচ্চা’ মন্তব্যটি করেছেন।

নিউজ১৮ চ্যানেলকে তিনি বলেন, ‘আমি হিন্দু-মুসলিম বিভেদ করব না, এটা আমার অঙ্গিকার।’

সমালোচকদের কাছে তার অঙ্গিকার অর্থহীন। যেদিন তিনি হিন্দু-মুসলিম কার্ড খেলবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেন, সেদিন তিনি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খণ্ডে সমর্থকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘জিহাদি মনোভাবের অনুপ্রবেশকারীরা বিরোধীদের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে এবং আমাদের বোনদের বিপদের মুখে ফেলছে।’

পরের দিনগুলোতে হিন্দুতভা ওয়াচ অন্তত ১০টি জনসভা নথিভুক্ত করেছে, যেখানে মোদি ভোটারদের সাবধান করে বলেছেন, কংগ্রেস জাতীয় সম্পদ মুসলিমদের বিতরণ করবে, তাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করবে এবং তার সময় তৈরি করা হিন্দু মন্দির বন্ধ করে দেবে।

হিন্দুতভা ওয়াচের নথিভুক্ত সব মুসলিম-বিরোধী বক্তব্যই ঘৃণাসূচক ভাষণ না, যেটা ভারতে কোনো অপরাধ না। এ ধরনের বক্তব্য উস্কানিমুলক, বিপজ্জনক বা সাম্প্রদায়িক হিসেবে গণ্য করা হয়।

ভারতীয়রা যাকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলে থাকে, সেটা বহুদিন ধরে ১৪০ কোটি মানুষ, আটটি বড় ধর্ম আর ২২টি সরকারি ভাষার দেশ ভারতের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে।

কংগ্রেস এখন বিরোধী দল, কিন্তু ১৯৮৪ সালে তারা শিখ-বিরোধী মনোভাবের জোয়ারে নির্বাচনে জয় পায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার শিখ দেহরক্ষীরা হত্যা করলে এই মনোভাবের সৃষ্টি হয়।

কারনেজি এন্ডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মিলান ভাইসনাভ বলেন, মুসলিম-বিরোধী কথা-বার্তা বিজেপির নির্বাচনী কৌশলের ‘অপরিহার্য’ অংশ।

১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ২০১৪ সালের পর থেকে ক্ষমতায়, বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে দু’টি লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করেছে বলে বলছেন ভাইসনাভ। তিনি বলেন, জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি এবং একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণায় আমরা যে ধরনের বক্তৃতাবাজি শুনেছি, সেটা আমাকে খুব একটা অবাক করে না। কারণ এক দিক থেকে সেটা বিজেপির সব প্রচারণার সাথেই যুক্ত।’

ভাইসনাভ বলেন, ২০০২ সালে মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও সহিংস হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি উস্কানিমূলক কথা বলতে পিছপা হননি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় দেশে মুসলিম-বিরোধী বক্তৃতাবাজি বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়।

তিনি বলেন, ‘এক দিক থেকে দেখলে আজকের প্রচারণা নজিরবিহীন। তার আংশিক কারণ সেটা যেভাবে বড় করে উঠে আসছে। কিন্তু এ ধরনের প্রচারণা নতুন কিছু নয়।’

‘লাভ জিহাদ’, ‘ভূমি জিহাদ’, ‘ভোট জিহাদ’
ভোটারদের সংগঠিত করার জন্য বিজেপি প্রার্থীরা অন্যান্য দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে মুসলিমদের সম্পর্কে পুরনো বক্রোক্তি এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রায় ব্যবহার করে থাকেন।

এগুলোর একটা ‘ভূমি জিহাদ’ নামে পরিচিত। এটা একটা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যার সারমর্ম হলো, মুসলিমরা খাস জমির ওপর অনুমোদনহীন ধর্মীয় স্থাপনা তৈরি করে ভূমি দখল করছে।

আরেকটির নাম ‘লাভ জিহাদ’। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মতে, মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারী বিয়ে করে তাদের ধর্মান্তর করাচ্ছে, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে একটি মুসলিম দেশে পরিণত করা।

হিন্দুতভা ওয়াচ এই দুই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের বেশ কয়েকটি ঘটনা নির্বাচনী প্রচারণার সময় নথিভুক্ত করেছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে এই বুলির নতুন একটি সংস্করণের আবির্ভাব হয়, ‘ভোট জিহাদ’। একজন স্থানীয় বিরোধী নেতা মুসলিমদের প্রতি ‘ভোটের জিহাদ’ দিয়ে মোদিকে ক্ষমতা থেকে তাড়ানোর আহ্বান জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে ‘ভোট জিহাদ’ ঘোষণা করেছে।

মোদি বলেন, ‘আমি আশা করি যে আপনারা সবাই জিহাদের মানে জানেন এবং কার বিরুদ্ধে সেটা চালানো হচ্ছে।’

জিহাদের প্রসঙ্গ বিভিন্ন জনসভায় নিয়মিত তোলা হয়েছে। মে মাসের ১৫ তারিখের এক সভায় স্বতন্ত্র প্রার্থী সঞ্জয় শর্মা তার সমর্থকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, তারা যদি ‘এখনি জেগে না ওঠেন তাহলে এই জিহাদি মনোভাব ছড়াতেই থাকবে।’

হিন্দুতভা ওয়াচ-এর দেয়া অনুবাদ অনুযায়ী, শর্মা বলেন যে ‘আমাকে ভোট দিন, যদি আপনারা গরু জবাই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে চান। আমাকে ভোট দিন যদি আপনি লাভ জিহাদ থামাতে চান।’

‘বাকভীতি’
এক দিক থেকে দেখলে বিজেপি প্রার্থীদের বক্তৃতাবাজির বেশিভাগ হচ্ছে চিরাচরিত রাজনৈতিক কৌশলে। রাজনিতিকরা অতিরঞ্জিত দাবি এবং ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে তাদের সমর্থকদের চাঙ্গা করেন।

ভাইসনাভ বলেন, ‘দেখুন (যুক্তরাষ্ট্রে) হাউস এবং সেনেট প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারে কী বলছে। দেখুন, রিপাবলিকান দলের সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা কী নিয়ে টুইট করছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের রাটগারস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিরন গারিমেলা জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে মুসলিমদের দেশ দখলের কথা-বার্তাকে ‘বাকভীতি’ বলে বর্ণনা করেন। গবেষকরা এই বাক্যাংশ ব্যবহার করছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র দু’দেশেই অনেক ঘটনা দেখতে পাই যেখানে এ ধরনের বক্তৃতাবাজি ব্যবহার করা হচ্ছে।’

অভিজ্ঞ ভারতীয় সাংবাদিক ও অধিকার কর্মী অজিত শাহি জানান, শুধু বক্তৃতাবাজিই চিন্তার কারণ নয়।

তিনি বলেন, ‘ভারতে এই বক্তৃতাবাজি আরো বড় একটা আন্দোলনের অংশ। যার সংগঠন আছে, অর্থায়ন আছে এবং কর্মী বাহিনী আছে।

অজিত শাহি এখন ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিলের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর।

তিনি বলেন, ‘যদি শুধুই বক্তৃতাবাজি হতো, তাহলে সেটা হয়তো সহ্য করা যেত। কিন্তু এই বক্তৃতাবাজির সাথে যুক্ত আছে সংগঠিত, গভীরভাবে অর্থায়িত এবং সুদূর প্রসারী এক আন্দোলন।’
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা


আরো সংবাদ



premium cement