০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলল যুক্তরাষ্ট্র?

মানবাধিকার নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় - ছবি : বিবিসি

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে উল্লেখযোগ্য রকমের মানবাধিকার হনন হয়েছে। মনিপুর ছাড়াও গত এক বছরে সংখ্যালঘু, সাংবাদিক এবং প্রতিবাদী ব্যক্তিদের ওপরে হামলার ঘটনাও তারা উল্লেখ করেছে মানবাধিকার সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের কথাও যেমন ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেমনই ভারতের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিচার বহির্ভূত হত্যার যে অভিযোগ উঠেছে, তার উল্লেখও করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

আবার বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের কথা লিখতে গিয়ে প্রতিবেদনটিতে বিবিসির দিল্লি এবং মুম্বাই দফতরে আয়কর হানার বিষয়টিরও উল্লেখ করেছে।

তবে জাতীয় ও রাজ্যের নির্বাচনগুলি যে অবাধ এবং নিরপেক্ষ হয়েছে, সেকথাও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

মোট ২৫ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

তবে ভারত ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে এখনো কোনো বক্তব্য দেয়নি।

তবে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে তারা শীর্ষ পর্যায়ে ভারতের সাথে মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার পরে ব্যুরো অফ ডেমোক্র্যাসি, হিউমান রাইটস অ্যান্ড লেবার’-এর শীর্ষ কর্মকর্তা রবার্ট গিলক্রিস্ট সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে এই মন্তব্য করেন।

মনিপুর নিয়ে কী বলছে যুক্তরাষ্ট্র?
বার্ষিক মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ভারত বিষয়ে‘এক্সিকিউটিভ সামারি’ বা সারাংশ শুরুই হয়েছে কুকি এবং মেইতেইদের মধ্যে গত বছর মে মাস থেকে চলতে থাকা সংঘর্ষের বিষয়টি দিয়ে। ঘটনাক্রমের বর্ণনা করার পরে ওই প্রতিবেদনে অনেকবার মনিপুরের বিষয়ে লেখা হয়েছে।

ওই রাজ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে, নিয়মিত কারফিউ জারি করে, ইন্টারনেট বন্ধ রেখেও যে সহিংসতা বন্ধ করা যায়নি, তা লিখেছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবার দেশের সুপ্রিম কোর্টও যে সহিংসতা বন্ধের চেষ্টায় সরকারি পদক্ষেপ নিয়ে যে সমালোচনা করেছে, সেটাও বলা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে।

অপহরণ, শারীরিক আঘাত করা এবং অত্যাচার, ধর্ষণের যেসব ঘটনা সংবাদমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলির কাছ থেকে তারা পেয়েছে, সেসব উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

মনিপুরের মানবাধিকার কর্মী বাবলু লইথংবামের বাড়িতে যে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছিল উত্তেজিত জনতা, সেই বিষয়টি আলাদা করে লেখা হয়েছে। ওই ঘটনায় যে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং লইথংবাম ও তার পরিবারকে সুরক্ষা দেয়ার আবেদন করেছে সরকারের কাছে, সেটাও বলা হয়েছে।

বাক-স্বাধীনতা হরণ
মনিপুর ছাড়া ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরেছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যেখানে সরকার এবং তার সহযোগীরা‘সরকারের সমালোচনাকারী গণমাধ্যমের ওপরে চাপ তৈরি করছে এবং হয়রানি করার’ অভিযোগ উঠেছে।

তবে তারা এটাও লিখেছে ভারতে স্বাধীন গণমাধ্যম সক্রিয় ছিল এবং মোটের ওপর সরকারের সমালোচনাসহ বিভিন্ন ধরনের মতই প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমে। তবে কিছু গণমাধ্যম সংস্থা নানা বিধিনিষেধের আওতায় পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

তারা লিখেছে, আইন অনুযায়ী এমন বিষয় ছাপা নিষিদ্ধ, যা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে বা নানা গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা তৈরি করতে পারে। এই আইনটি প্রয়োগ করে কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্রকে প্রিন্ট মিডিয়া, টেলিভিশন মাধ্যম এবং স্ট্রিমিং পরিষেবাসহ ডিজিটাল মাধ্যম, বই প্রকাশ ইত্যাদির ওপরে বাধা সৃষ্টি করেছে।

বিবিসির দফতরে আয়কর হানা
বাক-স্বাধীনতার কথা প্রসঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিবিসির দফতরে আয়কর হানার বিষয়টি।

প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে,‘গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আয়কর বিভাগ বিবিসির দিল্লি ও মুম্বাইয়ের অফিসে ৬০ ঘণ্টা তল্লাশি চালায়। জানুয়ারিতে বিবিসির একটি তথ্যচিত্র প্রকাশের পরপরই এই অনুসন্ধান শুরু হয়, যেখানে অভিযোগ করা হয় যে গুজরাটে ২০০২ সালের দাঙ্গার সময় প্রধানমন্ত্রী মোদী গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে একটি ভূমিকা ছিল।'

‘যদিও কর কর্তৃপক্ষ বিবিসির কর পরিশোধ এবং মালিকানা কাঠামোর অনিয়মের কারণে এই তল্লাশির কারণ বলে জানিয়েছে, তবে সংস্থার আর্থিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত নন এমন সাংবাদিকদেরও তল্লাশি করেছে আর কিছু সরঞ্জামও বাজেয়াপ্ত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে সরকার তথ্যচিত্রটি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার জন্য জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে, মিডিয়া সংস্থাগুলিকে ভিডিওটির লিঙ্কগুলি সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করেছে।

ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে তদন্তের একাধিক প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনটিতে।

বলা হয়েছে,‘২০১৯ সাল থেকে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক হামলা, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, অভিযান, ভুয়া মামলা এবং চলাচলে বিধিনিষেধের মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছেন।’

আবার রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ২০২৩ সালে তাদের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার মানদণ্ডে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতকে ১৬১তম স্থান দিয়েছে এবং সেটা যে ভারতের সর্বকালের সর্বনিম্ন স্থান, সেটাও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পশ্চিমবঙ্গে ভোটে সহিংসতা
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তৃতীয় অংশে রয়েছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেয়ার অধিকারের বিষয়টি।

সেখানে বলা হয়েছে‘যদিও রাজনৈতিক দল গঠন বা কোনো সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি, তবে সরকারি কর্মকর্তা বা নীতির সমালোচনা করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সদস্যদের ওপরে প্রতিশোধ নেয়া, ভুয়া খবর ছড়ানো এবং এবং প্রচারের জন্য অবাধে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে না পারাসহ নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল অভিযোগ এসেছে।'

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচনে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে, যেখানে ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত গ্রামীণ পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৫২ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

ওই নির্বাচনটি ছিল রাজ্যের ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন।

বিদেশের মাটিতে হত্যার অভিযোগ
কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেই ভারতের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে বলেছিল যে ভারত সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সেসব দেশের মাটিতে, তাদের নাগরিককে হত্যা করেছে এবং হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল।

কানাডায় এক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা খুন হন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরেক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, যাতে ভারত সরকারে কর্মরত এক ব্যক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনটিতেও এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

সেখানে লেখা হয়েছে এরকম খবর পাওয়া গেছে (ভারতের) সরকার সাংবাদিক, প্রবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্য, নাগরিক সমাজের কর্মী এবং মানবাধিকার রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে আন্তঃদেশীয় দমন-পীড়নে জড়িত।

প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে,‘অন্য দেশের সরকার, প্রবাসী সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি এরকম অভিযোগ করেছে প্রতিশোধের জন্য ব্যক্তি-হত্যা বা অন্য দেশে বসবাসকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি দেয়া হয়েছে।'

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ১৮ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেছিলেন এক শিখ কানাডীয় নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার সাথে ভারত সরকারের এজেন্টদের যোগসূত্রের তদন্ত করছে তার সরকার।

তবে এটাও উল্লেখ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে নিজ্জরকে ভারত সরকার‘সন্ত্রাসী' হিসেবে ঘোষণা করেছে। তিনি খালিস্তান নামে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন, সেটাও বলা হয়েছে। আর ওই হত্যায় যে ভারত সরকার কোনো জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে, সেটাও জানানো হয়েছে মানবাধিকার সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement