ভারতে লোকসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২২
ভারতের নাগরিকরা ১৯ এপ্রিল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দেশটির লোকসভা সদস্যদের নির্বাচন করতে শুরু করেছে। এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য ভোটে লড়ছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি আর তার জোট সঙ্গীদের এগিয়ে রেখেছে।
বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিপরীতে লড়াই করছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। কংগ্রেসসহ ২৪ জনেরও বেশি বিরোধী দল এই জোটে রয়েছে।
পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার সদস্যদের বেছে নেয়ার এই নির্বাচন হচ্ছে এক তিক্ত পরিবেশের মধ্যে।
বিরোধীরা অভিযোগ করছে, তারা পক্ষপাতিত্বের শিকার হচ্ছে। কারণ কেন্দ্রীয় অ্যাজেন্সিগুলো অনেক বিরোধী নেতাদের বাড়িতেই তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে।
কংগ্রেস বলছে, ছয় সপ্তাহ ধরে আয়কর বিভাগ তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে রেখেছে। যার ফলে নির্বাচনী প্রচারণার খরচ চালাতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
আবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতাকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই সব দুর্নীতির অভিযোগ অবশ্য তারা সকলেই অস্বীকার করছেন।
বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনকে হস্তক্ষেপ করার জন্য আবেদন করেছিল। সেই নির্বাচন কমিশনও আবার তাদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা সব দল এবং প্রার্থীদের সমান নজরে দেখছে, পক্ষপাতিত্ব করছে না।
পরিসংখ্যান মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে
প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত বিশ্বের সব থেকে জনবহুল দেশ। এমন একটা দেশের নির্বাচন-সংক্রান্ত সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যেতে পারে।
লোকসভার ৫৪৩ জন সদস্যকে নির্বাচন করতে ছয় সপ্তাহ ধরে সাত দফায় ভোট নেয়া হবে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবে ৪ জুন। এই নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৯৬ কোটি ৯০ লাখ।
একটা ধারণা দেয়ার জন্য বলা যেতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল আর ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় সমসংখ্যক মানুষ ভারতের নির্বাচনের ভোটার তালিকায় রয়েছেন।
ওই সব দেশগুলোর মিলিত জনসংখ্যা ভারতের ভোটারের সংখ্যার থেকে সামান্য কম, তাই ওই দেশগুলোর সাথে বেলজিয়ামের জনসংখ্যাও জুড়ে দেয়া যেতে পারে।
এবারের ভোটারদের মধ্যে ৪৯ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ এবং ৪৭ কোটি ১০ লাখ নারী। প্রথমবার ভোট দেবেন, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮-১৯ বছর, এমন ভোটার এক কোটি ৮০ লাখ। প্রবীণ ভোটার, যাদের বয়স ৮৫ থেকে ৯৯ বছর, এমন ৮২ লাখ মানুষের নাম আছে ভোটার তালিকায়।
সব জায়গায় পৌঁছবেন ভোটকর্মীরা
নিরাপত্তা আর ভোটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণেই নানা দফায় ভোট করানো হচ্ছে।
বয়স্ক আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে যাদের, তাদের বাড়িতে গিয়েও ভোট নেয়ার ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজিব কুমারের কথায়, ‘ভারতের প্রতিটি কোনায় গণতন্ত্রকে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য সারাদেশে ১৫ লাখ ভোট কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একজন ভোটার জঙ্গলে বাস করুন অথবা তুষারাবৃত পাহাড়ে, আমাদের কর্মীরা বাড়তি পরিশ্রম করে হলেও প্রত্যেক ভোটারের কাছে পৌঁছবেন। আমরা ঘোড়া আর হাতি বা খচ্চরের পিঠে চেপেও যেমন যাব, তেমনই হেলিকপ্টারেও যাব। আমরা সব জায়গায় পৌঁছব।’
বেশিভাগ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রই স্কুল, কলেজ বা কমিনিউটি সেন্টারে হলেও বেশ কিছু অদ্ভুত জায়গাও বাছা হয়েছে বুথ তৈরি করার জন্য। যার মধ্যে রয়েছে জাহাজের কন্টেইনার, পাহাড়ের চূড়া বা জঙ্গলের মধ্যেও বুথ হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন যখন বলে যে ‘প্রত্যেক ভোটারই গুরুত্বপূর্ণ’ সেটা শুধু কথার কথা নয়। বিগত লোকসভা নির্বাচনে, ২০১৯ সালে পাঁচজন ভোটকর্মী বাসে চেপে আর তারপরে পায়ে হেঁটে দু’দিন ধরে পৌঁছিয়েছিলেন এমন একটি বুথে, যেখানে মাত্র একজন ভোটার ছিলেন। উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের ওই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের একাকী ভোটার ছিলেন একজন ৩৯ বছর বয়সী নারী।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে রাজ্য
রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হলো উত্তরপ্রদেশ। রাজ্যটিতে ভোটার রয়েছেন প্রায় ২৪ কোটি। এটিই ভারতের সব থেকে জনবহুল রাজ্য আর এখান থেকেই লোকসভায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হন।
বিশ্লেষকরা বলেন, দিল্লি যাওয়ার পথটা উত্তরপ্রদেশ হয়েই যায়। এই রাজ্যে যে দল ভালো ফল করে, সাধারণত ভারত শাসন করে থাকে তারাই। এই রাজ্য থেকে ভারতের আটজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন, ওই বছর বিজেপি উত্তরপ্রদেশের ৮০টির মধ্যে ৭১টি আসনে জিতেছিল। পরের বার ২০১৯ সালে অবশ্য বিজেপির জেতা আসনের সংখ্যাটা কমে ৬২ হয়েছিল। মোদি ২০১৯ সালে প্রাচীন শহর বারাণসী আসন থেকে জিতেছিলেন, এবারো তিনি ওই আসন থেকেই লড়ছেন।
উত্তরপ্রদেশ থেকে যেমন সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন, অন্যদিকে রয়েছে সিকিম, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম আর আন্দামান, লাক্ষাদ্বীপ এবং লাদাখের মতো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলো। যার প্রতিটি থেকে মাত্র একজন করে সদস্য নির্বাচিত হন।
অন্য যেসব রাজ্য এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে আছে ৪২টি আসনের পশ্চিমবঙ্গ, ৪৮টি আসনের মহারাষ্ট্র, ৪০ আসনের বিহার এবং ৩৯টি আসনের তামিলনাডু।
ভোটের হেভিওয়েট যারা
দেশের ২২টি রাজ্য আর কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে এক দিনেই ভোট নেয়া হয়ে যাবে, তবে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারের মতো বড় রাজ্যগুলোতে সাত দফায় ভোটগ্রহণ হবে।
বিজেপি, কংগ্রেস,আম আদমি পার্টি আর সিপিআইএম-সহ ছয়টি জাতীয় স্তরের স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ছাড়াও আরো কয়েক হাজার প্রার্থী এই নির্বাচনে লড়তে চলেছেন। জাতীয় দলগুলো ছাড়াও ৫৮ টি আঞ্চলিকভাবে স্বীকৃত দল এবং আরো অনেক ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাও ভোটের ময়দানে নেমেছেন।
তবে সবার নজর থাকবে হেভিওয়েট প্রার্থীদের দিকে। প্রথমেই নাম করতে হয় নরেন্দ্র মোদির।
তিনি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। জনমত সমীক্ষাগুলো জানাচ্ছে, তিনিই সম্ভবত ফিরে আসতে চলেছেন। যদি ৭৩ বছর বয়সী মোদি এবারো জিততে পারেন, তাহলে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবেন।
একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে মোদির বড় সমর্থক গোষ্ঠী আছেন, যারা মনে করেন তিনি সুশাসন দিতে পেরেছেন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ‘মাথা উঁচু’ করেছেন।
অন্যদিকে তার সমালোচকরা বলেন যে পেশীশক্তির প্রদর্শন করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের যে রাজনীতি তিনি করেন, সেখানে সংখ্যালঘুদের কোনো জায়গা নেই আর তিনি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ যে ভাবমূর্তি ছিল, সেটাও নষ্ট করে দিচ্ছেন।
নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ধর্ম আর ধর্মীয় প্রতীকগুলোকে ব্যবহার করেন, তা খুবই কার্যকরি হয়। কারণ দেশটির ৮০ ভাগ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
এ বছরের নির্বাচনে তার প্রধান স্লোগান হয়ে উঠেছে, ‘এবার ৪০০ পার’, অর্থ তার দল সংসদে ৪০০টি আসন জেতার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তবে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাদের প্রয়োজন ২৭২টি আসন। গত নির্বাচনে, ২০১৯ সালে দলটি ৩০৩ টি আসনে জয়ী হয়েছিল।
মোদির লেফটেন্যান্ট শাহ
মোদির ভোট ব্যবস্থাপনা সামলান তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার নির্বাচনী কৌশল মেনে চলে বিজেপি বহু নির্বাচন জিতেছে।
তার সমর্থকরা বলছে, তিনি হিন্দু ধর্মকে রক্ষার জন্যই কাজ করেন। তবে কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ সরিয়ে নেয়া বা নাগরিকত্ব আইনের মতো বিতর্কিত আইনগুলো প্রণয়নের পেছনেও তারই হাত থেকেছে বলে মনে করা হয়। সমালোচকরা বলে থাকেন দেশের নতুন নাগরিকত্ব আইনটি মুসলিম-বিরোধী।
বিজেপির আরো এক হেভিওয়েটের দিকেও নজর থাকবে, যদিও তিনি এই ভোটের প্রার্থী নন।
মুণ্ডিত মস্তক, গেরুয়া বসন পরা উগ্রবাদী থেকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যোগী আদিত্যনাথকে মনে করা হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরেই বিজেপির সবথেকে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ।
তিনি এই নির্বাচনে লড়ছেন না ঠিকই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় অন্যতম প্রধান ভূমিকা রয়েছে তারই।
সমর্থকদের কাছে তিনি একজন ধর্মীয় প্রচারক, কিন্তু সমালোচকরা বলছে যে তিনি বিভাজনের রাজনীতি করেন এবং জনসভায় বক্তৃতা করে মুসলিম-বিরোধী মানসিকতা চাগিয়ে তোলেন।
তার সাত বছরের শাসনামলে মুসলমানদের গণপিটুনি আর ঘৃণাভরা ভাষণ অনেক সময়েই সংবাদ শিরোনামে এসেছে।
বিরোধী পক্ষের ওজনদার যারা
রাহুল গান্ধী কখনো মন্ত্রী হননি, কিন্তু সবচেয়ে পরিচিত বিরোধী নেতা। তবে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের অনেকটাই বংশ পরম্পরায় পাওয়া। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে তার ঠাকুমা এবং বাবা দুজনেই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
বিগত এক দশকে বিজেপির যত উত্থান হয়েছে, ততই গান্ধীর দল কংগ্রেস ক্ষীণ হয়েছে। তার রাজনৈতিক জীবনের গোড়ার দিকে সমালোচকরা তাকে ’অনিচ্ছুক রাজপুত্র’ বলে আখ্যা দিত।
সেই আখ্যা ঘোচাতে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে দেশব্যাপী দুটি পদযাত্রা, যার মাধ্যমে তিনি ‘হিংসা ও দ্বেষের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ’ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন।
জনমত সমীক্ষাগুলো অবশ্য কংগ্রেসকে বিজেপির অনেক পেছনে ফেলেছে।
প্রায় এক দশক আগে যখন কংগ্রেস শেষবার সরকারে আসীন ছিল, তখন রাহুলের মা সোনিয়া গান্ধীকে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী বলে মনে করা হতো।
তবে গত কয়েক বছরে ৭৭ বছর বয়সী সোনিয়া গান্ধীর যেমন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়েছেন, তেমনই রাজনীতিতে তার প্রভাবও কমেছে।
এ বছর জানুয়ারি মাসে সোনিয়া গান্ধী লোকসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন, তাই এই নির্বাচনে তিনি লড়াই করছেন না।
গান্ধী পরিবারের আরো একটি নাম প্রতি নির্বাচনের আগেই আলোচনায় উঠে আসে। তিনি হলেন সোনিয়া গান্ধীর মেয়ে প্রিয়াঙ্কা। যদিও তিনি কখনো লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হননি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মতোই অনেকটা দেখতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। তিনি অবশ্য কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনী প্রচার চালান আর মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে প্রশংসিতও হন। এবারো তার সমর্থকদের মধ্যে থেকেই দাবি উঠেছিল যে তিনি যেন নির্বাচনে দাঁড়ান।
বিরোধী নেতাদের মধ্যে আর যার নাম আলোচনায় রয়েছে, তিনি হলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি এখন অবশ্য গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন।
তিনি প্রথম প্রচারের আলোয় উঠে এসেছিলেন দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনকারী হিসেবে। তার দল আম আদমি পার্টি বিজেপি আর কংগ্রেসকে হারিয়ে একটানা তিনবার দিল্লির শাসন ক্ষমতায় আছে। আবার পাঞ্জাবেও ওই দলটিই সরকার চালায়।
এ বছর মার্চ মাসে আরো কয়েকজন দলীয় সিনিয়র নেতাদের মতো গ্রেফতার হন। দুর্নীতির অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে বলে থাকেন যে তার সরকারের ওপরে প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে। কেজরিওয়ালের সমর্থকদের মনে একটা আশঙ্কা আছে যে তার গ্রেফতারির ফলে দলের প্রচারণায় সমস্যা তৈরি হবে।
কোন কোন ইস্যুতে ভোট হচ্ছে?
ভারতীয়রা কিসের ভিত্তিতে ভোট দেবেন? মোদির তুরুপের তাস কী হবে? নতুন গড়ে তোলা বিশালাকার রাম মন্দির? অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের চিন্তা বা কল্যাণকারী প্রকল্পগুলোর ওপরে ভিত্তি করেই কি ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেবেন? নাকি জাত আর ধর্মের ভিত্তিতে ভোট দেবেন তারা?
রাম মন্দির
মনে করা হচ্ছে, উত্তরাঞ্চলীয় শহর অযোধ্যায় গড়ে ওঠা হিন্দুদের ভগবান রামের মন্দিরটি এবারের নির্বাচনী দৌড়ে নরেন্দ্র মোদিকে কিছুটা ঐশ্বরিক সহায়তা দিতে পারে।
হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৯২ সালে যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দিয়েছিল, সেই জায়গাতেই গড়ে উঠেছে এই মন্দিরটি। সেই ঘটনার পরে যে দাঙ্গা বেঁধেছিল, নিহত হয়েছিলেন প্রায় দুই হাজার মানুষ।
এ বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী ওই মন্দিরটির উদ্বোধন করেন। সেই অনুষ্ঠান টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। স্কুল, কলেজ আর বেশিভাগ অফিসও সেদিন ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছিল যেন মানুষ ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা দেখতে পারে।
অর্থনীতি
ভারতের স্বাধীনতার শতবর্ষ ‘২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি, তা কি ভোটারদের মনে কোনো দাগ ফেলতে পারবে?
বিশ্বের সব থেকে দ্রুত বাড়তে থাকা অর্থনীতির দেশ ভারত। দেশটির জিডিপি এখন সাড়ে তিন লাখ কোটি মার্কিন ডলার। গত বছর যুক্তরাজ্যকে টপকিয়ে বিশ্বের পঞ্চম সবথেকে বড় অর্থনীতি হয়ে উঠেছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হয়তো পৌঁছিয়ে যাবে সাত লাখ কোটি মার্কিন ডলারে। আর সেটা সম্ভব হলে জাপান এবং জার্মানিকেও পেরিয়ে যাবে ভারতের অর্থনীতি। তাদের আগে থাকবে মাত্র দুটি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
তবে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফল হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থনৈতিক অসাম্য চোখে পড়ার মতো। বৈশ্বিক জনপ্রতি আয়ের দিক থেকে হিসাব করলে ভারতের স্থান ১৪০ নম্বরে। দেশটির তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষ দিনে ১৭৯ ভারতীয় টাকারও কম আয় করে। যদিও সরকারি নথিতে বলা হয় যে ‘চরম দারিদ্র্য’ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
অনেক ভোটারের মাথাতেই কর্মসংস্থান বিষয়টা থাকবে। ভারতীয়দের মধ্যে থেকে ৭০-৮০ লাখ তরুণ প্রতিবছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু আরো লাখ লাখ মানুষ কোনো কাজ জোটাতে পারে না।
সাম্প্রতিক সরকারি তথ্য অবশ্য বলছে, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা কমছে এবং শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, নতুন সৃষ্টি হওয়া বেশিভাগ কাজই খুব কম বেতনের চাকরি।
মানুষ যে সঙ্কটে আছে, তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন দেখা যায় যে লাখ লাখ মানুষ সরকারের গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পে নাম লেখাচ্ছেন। ওই প্রকল্পে কাজ করলে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ ভারতীয় রুপি পাওয়া যায়। আবার কয়েক হাজার মানুষ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোতেও কাজ করতে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন।
নির্বাচনী বন্ড
নির্বাচনের অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনতে যে নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেটিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কারা ওই নির্বাচনী বন্ড কিনেছে আর কোন দল কত অর্থ পেয়েছে, সেই তথ্যও প্রকাশ করার জন্য সরকারি ব্যাংক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত।
সেই তথ্য সামনে আসতেই দেখা যায় যে নির্বাচনী বন্ড থেকে সব থেকে লাভবান হয়েছে বিজেপি। দলটি ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যে এক হাজার ২০০ কোটি ভারতীয় টাকার নির্বাচনী বণ্ড বিক্রি হয়েছিল, তার অর্ধেকই পেয়েছিল বিজেপি।
নানা কেন্দ্রীয় অ্যাজেন্সির তদন্তের মুখে পড়া অনেক সংস্থাই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে অর্থ যুগিয়েছিল বলে একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনী বন্ডের ব্যবস্থাকে ‘ভারতের ইতিহাসে সব থেকে বড় দুর্নীতি’ বলে আখ্যা দিয়ে অভিযোগ করে যে অ্যাজেন্সিগুলোকে দিয়ে তোলাবাজি করানো হয়েছে। তবে সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য সেই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কল্যাণমুখী প্রকল্প
ভারতের কল্যাণমুখী প্রকল্পগুলোর পরিমাণ দেখলে বিস্মিত হতে হয়। নরেন্দ্র মোদির সরকার দাবি করে, তারা প্রায় ৯০ কোটি গরিব মানুষকে সহায়তা দেয়ার জন্য কয়েক লাখ কোটি ভারতীয় টাকা খরচ করেছে। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও কল্যাণমুখী প্রকল্পে প্রচুর অর্থায়ন করে থাকেন।
কিন্তু ওই বিনামূল্যের এক বস্তা চাল বা টয়লেট বানানোর জন্য অর্থ সহায়তা কি একটি দলকে ভোট এনে দেবে?
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলেন, এ ধরনের প্রকল্প হয়তো ভোট পেতে সহায়তা করে। কিন্তু তা একমাত্র ফ্যাক্টর না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
বিভাজনের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রশ্ন
ধর্মীয় বিভাজন ভারতে দীর্ঘ দিন ধরেই ছিল। কিন্তু সরকারের সমালোচকরা বলছে, ওই বিভাজন রেখাটা বিজেপির গত এক দশকের শাসনকালে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তাদের কথায়, ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতা ক্রমশই প্রশ্নের মুখে পড়ছে এবং দেশটা একটা হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। দেশের সব থেকে বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। প্রায় ২০ কোটি মুসলমান, ক্রমশ কোনঠাসা হচ্ছেন।
সরকার অবশ্য এই ব্যাখ্যা অস্বীকার করে আর বলে থাকে যে তারা সবাইকে নিয়েই চলে।
গত লোকসভায় বিজেপির একজনও মুসলমান সংসদ সদস্য ছিলেন না। সমাজকর্মী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন উদাহরণ দেখিয়ে বলছে, বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলমানদের ওপরে সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে।
সরকার অবশ্য এই অভিযোগ স্বীকার করে না যে তাদের কোনো বিভাজনকারী নীতি রয়েছে। বিজেপির সমর্থকদের অবশ্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তোলা অভিযোগ নিয়ে মাথাই ঘামান না।
এমন একটা সময় এই নির্বাচন হতে চলেছে, যখন বিরোধী পক্ষ, সমাজকর্মী আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, ভারতের গণতন্ত্র এখন হুমকির মুখে।
রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেন, সরকার-বিরোধী দলের নেতাদের টার্গেট করেছে, তাদের ওপরে নজরদারি চালাচ্ছে আর বিচার ব্যবস্থা এবং সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজেও নানা বাধা সৃষ্টি করছে।
হিউমান রাইটস ওয়াচের মতো সংগঠন বলছে ভারতের সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে সন্ত্রাস দমন আইনসহ ফৌজদারী মামলা দিচ্ছে, সমালোচকদের জেলে পাঠাচ্ছে বা বৈদেশিক অর্থ সহায়তা-সংক্রান্ত আইনকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী দল, মানবাধিকার সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যমকে হেনস্থা করছে।
সরকার অবশ্য এই সব অভিযোগই অস্বীকার করে।
সূত্র : বিবিসি