১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


বিদেশে চাকরির ফাঁদে পা দিয়ে ‘সাইবার ক্রীতদাস’ হচ্ছে বহু ভারতীয়

বিদেশে চাকরির ফাঁদে পা দিয়ে ‘সাইবার ক্রীতদাস’ হচ্ছে বহু ভারতীয় - ছবি : সংগৃহীত

‘সাইবার ক্রীতদাস’! নতুন করে এই শব্দ দু’টি আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছে ভারতীয়দের মনে। প্রায় পাঁচ হাজার ভারতীয় এখনো কম্বোডিয়ায় ‘ক্রীতদাসের’ জীবন কাটাচ্ছে। সরকার উদ্যোগী হওয়ায় ২৫০ জনকে ভারতে ফেরানো গেলেও বাকিরা মুক্তির আশায় দিন দিন কাটাচ্ছে।

কী এই ‘সাইবার ক্রীতদাস’? আমরা সকলেই কমবেশি সাইবার প্রতারণা শব্দ জোড়ার সাথে পরিচিত। আধুনিক প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের যুগে প্রতারকেরা নানাভাবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেয়। ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়ে টাকা লোপাট কিংবা প্রতারণা করে টাকা হাতানোর মতো অভিযোগও কম নয়। এই সাইবার প্রতারাণাই এখন কম্বোডিয়ায় জাল বিস্তার করেছে।

মোটা বেতনের চাকরির ফাঁদ পেতে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের কম্বোডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর তাদের জোর করে সাইবার প্রতারাণার কাজে নিযুক্ত করা হয়। সেই চক্র বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে আছে। তাদের কাজই হলো বিভিন্ন দেশ থেকে লোক জোগাড় করে কম্বোডিয়ায় পাঠানো।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, কম্বোডিয়ায় পৌঁছানো মাত্রই চাকরির খোঁজে আসা মানুষদের থেকে কেড়ে নেয়া হয় পাসপোর্ট। তারপরই তাদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধ করানো হয়।

প্রতিদিন বেঁধে দেয়া হয় কাজের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা। সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে চলে অত্যাচার। ছুটি তো মেলেই না, উল্টা খাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। দিনে ১২ ঘণ্টা তো কাজ করতেই হবে, না হলে রক্ষা নেই।

শুধু ডেটা এন্ট্রি করেই মিলবে অনেক বেতন! এমন টোপ দিয়ে কম্বোডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় ইচ্ছুকদের। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা জানতে পারে ডেটা এন্ট্রি নয়, সাইবার প্রতারণার কাজ করতে হবে। তারা যাতে কম্বোডিয়া ছাড়তে না পারে, এর জন্য কেড়ে নেয়া হয় পাসপোর্ট-সহ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি।

ভারত ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে মানুষকে কম্বোডিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্প্রতি ভারত সরকারের নজরে আসে বিষয়টি। কিভাবে তাদের দেশে ফেরানো যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিল্লি। কম্বোডিয়া প্রশাসনের সাথে যৌথভাবে সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে শুরু হয় অভিযান।

এখন পর্যন্ত কম্বোডিয়ায় আটকে পড়া ২৫০ জনকে উদ্ধার করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ভারতীয়দের উদ্ধারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ভারতীয় সাইবার ক্রাইম কোঅর্ডিনেশন সেন্টার এবং অন্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করে। তারপরই উদ্ধারের কাজে নামে ভারত।

গোটা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীরর জয়সওয়াল জানান, কম্বোডিয়ায় থাকা ভারতীয়দের জন্য বেশ কিছু নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। সাহায্যপ্রার্থী সকল ভারতীয়কে সাহায্য করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার।

কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হওয়া ভারতীয়দের মধ্যে ছিলেন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা স্টিফেন। দেশে ফিরে তিনি তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানান সংবাদমাধ্যমে।

স্টিফেন জানান, বেকার থাকায় বাড়়িতে চাপ বাড়ছিল। তাই কাজের সন্ধান শুরু করেন তিনি। ওই সময় মেঙ্গালুরুতে এক অ্যাজেন্টের সাথে আলাপ হয় তার। সেই অ্যাজেন্ট ডেটা এন্ট্রির কাজের সন্ধান দেন। বলেন, কম্বোডিয়ায় গিয়ে কাজ করতে হবে। রাজি হতেই স্টিফেনকে পর্যটক ভিসায় সে দেশে পাঠানো হয়।

স্টিফেন বলেন, ‘আমি কোভিডের সময় কম্পিউটারের কোর্স করি। আমাদের তিনজনকে এক সাথে কম্বোডিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। আমাদের বলা হয়েছিল, আমরা পর্যটক হিসেবে যাচ্ছি। কম্বোডিয়ায় পৌঁছানোর পরেই আমাদের একটা অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের টাইপিং স্পিড পরীক্ষা করে দেখা হয়। তারপর আমাদের বলা হয় যে চাকরি পেয়েছি।’

কি কাজ করতে হতো স্টিফেনদের? তিনি জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করা হয়। সেই প্রোফাইলে মেয়েদের নাম এবং ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজ করানো হতো।

কম্বোডিয়ায় গিয়ে সাইবার ‘ক্রীতদাস’-এ পরিণত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। করোনা পর্বের পরেও এমন প্রতারণার অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছিল। করোনা পর্বে অনেকেই চাকরি হারিয়েছিলেন। বেশি প্রভাব পড়েছিল তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে। সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে প্রতারকেরা জাল বিস্তার করেছিল। ভারত ছাড়াও চীন, বাংলাদেশের মতো দেশের যুবসমাজই ছিল প্রতারকদের নিশানায়।

সম্প্রতি প্রতারণার আরো এক ঘটনা সামনে এসেছে। মোটা বেতনের চাকরির প্রলোভন দিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে ভারতীয়দের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর অভিযোগে সরগরম পুরো দেশ। ভারতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুত বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। ঘটনার তদন্তে নেমেছে সিবিআইও।

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা একটি এফআইআর দায়ের করেছে। সেই এফআইআরে একাধিক অ্যাজেন্ট এবং কোম্পানির নাম রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ‘মানব পাচার’-এর অভিযোগ উঠেছে। সেই একই অভিযোগ উঠল কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রেও।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা


আরো সংবাদ



premium cement