১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


থাই সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ শহর হারাল মিয়ানমারের সামরিক জান্তা

বিদ্রোহীরা বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। - ছবি : বিবিসি

তিন বছর আগে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকরা সেদেশের বিদ্রোহীদের কাছে আরো একটি বড় পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এবার তাদের দখল থেকে থাইল্যান্ড সীমান্তের সাথে লাগোয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর বিদ্রোহীদের কাছে হাতছাড়া হয়েছে।

পূর্ব সীমান্তের শহর মায়াওয়ারি শহরের কয়েকশো সৈন্য কারেন বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

থাইল্যান্ডের সাথে মিয়ানমারের যেসব ব্যবসা-বাণিজ্য হয়, তার বেশিরভাগই এই সীমান্ত শহর দিয়ে হয়ে থাকে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অন্য বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর সাথে মিলে এই শহরে হামলা চালিয়ে আসছিল কারেন বিদ্রোহীরা।

শুক্রবার কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে যে, মায়াওয়ারি শহরের ১০ কিলোমিটার দূরে থানগানিয়াং শহরে অবস্থিত ব্যাটেলিয়নের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেছে।

কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, অনেক তরুণ যোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দেখাচ্ছে, যা তারা সৈন্যদের কাছ থেকে জব্দ করেছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক পরাজয়ের এটি সর্বশেষ উদাহরণ।

গত কয়েক মাসে চীন সীমান্ত সংলগ্ন শান রাজ্যের এলাকা এবং বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের বিপুল এলাকা বিদ্রোহীদের কাছে হারিয়েছে সামরিক জান্তা।

হাজার হাজার সৈন্য এর মধ্যেই হয় নিহত হয়েছে অথবা আত্মসমর্পণ করেছে অথবা পালিয়ে গেছে। এর ফলে সেদেশের বাসিন্দাদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।

মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন স্বশাসনের জন্য যুদ্ধ করে আসছে।

তবে নব্বইয়ের দশকে তারা সরকারি বাহিনীর কাছে বেশ কয়েকটি পরাজয়ের মুখোমুখি হয়।

এরপর ২০১৫ সাল থেকে সরকারের সাথে তাদের একটি যুদ্ধবিরতি চলছে।

কিন্তু ২০২১ সালে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর সেই পরিস্থিতি বদলে যায়।

কারেন যোদ্ধারা ঘোষণা করে, অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি বাতিল হয়ে গেছে।

সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর, মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুনের কাছাকাছি এবং থাই সীমান্তের সাথে সবচেয়ে ভালো যোগাযোগের মাধ্যম থাকা কারেন রাজ্যটি সরকারি বিরোধীদের কাছে সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

বিভিন্ন শহর থেকে আসা অনেক তরুণ যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। এই যোদ্ধারা সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ঘাটিতে নতুন করে হামলা শুরু করেছে।

একইসাথে কারেন ন্যাশনালিস্ট ডিফেন্স ফোর্স এবং কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির মতো অন্য বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর সাথে মিলে যৌথ হামলা শুরু করেছে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন।

থাই সীমান্ত সংলগ্ন প্রচারক ও জুয়ারি চক্রের অর্থায়নে শক্তিশালী মিলিশিয়া বাহিনী এতদিন ধরে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে এলেও এ বছরের শুরুর দিকে পক্ষবদল করেছে।

এরপর থেকে বিদ্রোহীদের পাল্লা অনেক ভারী হয়ে উঠেছে।

দেশের বহু এলাকায় যুদ্ধে বিপর্যস্ত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কারেন রাজ্যে নতুন করে সৈন্য পাঠাতে পারছে না। এর ফলে তাদের সীমান্তের সাথে প্রধান সড়কের নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয়েছে।

পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে এখন বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিমান হামলা আরো বাড়িয়েছে সামরিক বাহিনী।

কারেন রাজ্যের এই যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে।

সামনে বিমান হামলা আরো বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় অনেকেই থাই সীমান্তের দিকে চলে যেতে শুরু করেছে।

মিয়ানমারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এবারই সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ আক্রমণের মুখে পড়েছে সামরিক সরকার।

এই তুমুল প্রতিরোধের পেছনে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাওয়া জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেমন রয়েছে, তেমনি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে একটি জোট সামরিক বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছে বলে জানা যাচ্ছে।

এই জোট বলছে, তাদের এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে জান্তা সরকারের পতন।

তবে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ছাড়াও আরো বেশ কিছু জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে মিয়ানমারে মোট ১৩৫টি নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এদের মধ্যে তুলনামূলক শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোর সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে।

যেখানে একাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী জোটবদ্ধ হয়েছে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে।

মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হবার পর থেকেই সে দেশে সংঘাত চলছে। ১৯৬২ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।

এরপর দীর্ঘ সময় ধরে জান্তা বাহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকলেও ২০১৫ সালের এক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি), যার নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি।

তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা সামরিক শাসকদের কাছে হুমকি মনে হওয়ায় পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয় সামরিক বাহিনী।

তবে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি দেশটির সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে কঠোর হাতে তাদের দমন শুরু করে সামরিক বাহিনী।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সারা দেশে ক্র্যাকডাউন চালায়।

এতে ১৬ হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে নির্বিচারে গ্রেফতার এবং পুলিশ হেফাজতে ২৭৩ জনের মৃত্যুর তথ্য উঠে এসেছে।

এছাড়া গণহত্যা, গ্রেফতার, অত্যাচার, যৌন সহিংসতাসহ অন্য নিপীড়নের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

চলতি বছর সামরিক জান্তার নতুন করে ক্ষমতা দখলের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে।

তবে প্রথম আড়াই বছর সামরিক বাহিনী দমন-পীড়নের মাধ্যমে যতটা সহজে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে, পরে সে দৃশ্য অনেকটাই বদলে গেছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালের এপ্রিলেই ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এনইউজি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে যোগ দেয়।

সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে মিলে তারা প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে এবং সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করে ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’।

২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে হামলা চালায় দেশটির উত্তরের জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী, যাদের একসাথে ডাকা হচ্ছে ‘থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স’ নামে।

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ে এই জোট গঠন করা হয়েছে।

তারা একে নাম দেয় ‘অপারেশন ১০২৭’। এছাড়া শত শত স্বেচ্ছাসেবী জাতিগত বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়।

তাদের সাথে অস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দুই বছরের আপাত অচলাবস্থার অবসান ঘটে।

সামরিক বাহিনীকে এই মুহূর্তে নানা ধরনের হামলার সম্মুখীন হচ্ছে হচ্ছে। আর তা কেবল একটি জায়গাতেই না, বরং সারা দেশব্যাপী।

ফলে অনেক জায়গাতেই দখল হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement