১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


ভারত নির্বাচন

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারে বিরুদ্ধে অগোছালো বিরোধীরা

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারে বিরুদ্ধে অগোছালো বিরোধীরা - ফাইল ছবি

কেন্দ্র ও রাজ্যে শাসকবিরোধী বোঝাপড়া পূর্ণাঙ্গ হল না। জাতীয় স্তরে বিরোধী জোটের শরিকরা রুদ্ধশ্বাস
লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে বাম কংগ্রেসের সাথে বোঝাপড়া হল না আইএসএফের।

বিরোধীদের মধ্যে সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার জন্য তৃতীয় পক্ষের দলগুলো একে অপরের দিকে আঙুল তুলছে।

জাতীয় স্তরে দেশের শাসক দল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল তৃণমূল। লোকসভা নির্বাচনে উভয়ের বিরুদ্ধে বিরোধীদের সমঝোতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলেছে অনেকদিন ধরে। জাতীয় ক্ষেত্রে কিছুটা বোঝাপড়া হয়েছে। এই রাজ্যে ধাক্কা খেয়েছে বিকল্প শক্তি।

কেন্দ্রে ইন্ডিয়া জোট
ভোটের অনেক আগেই প্রায় ৩০টি দল মিলে তৈরি করেছিল ইন্ডিয়া জোট। একের পর এক বৈঠক করেছেন বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দলের নেতারা। কংগ্রেস, বাম, আম আদমি পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, এনসিপি, শিবসেনার মতো একঝাঁক দল বিজেপির বিরুদ্ধে এক ছাতার তলায় এসেছে।

দীর্ঘদিন ধরে এই জোটের সলতে পাকানোর পর্ব চলেছে। কিন্তু সার্বিক বোঝাপড়া করা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে বিরোধী জোটের অন্যতম হোতা জনতা দল ইউনাইটেড যোগ দিয়েছে বিজেপি শিবিরে। বিজেপির সাথে বোঝাপড়া না হলেও ওড়িশার বিজু জনতা দল বিরোধী জোটে যোগ দেয়নি।

এই জোটের তৎপরতা সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি, একমাত্র কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো' ন্যায় যাত্রা নিয়ে রাজ্যের রাজ্যে ঘুরেছেন। এই কর্মসূচি উপলক্ষেও তেমন ঘনিষ্ঠতা সর্বত্র নজরে আসেনি। বরং পশ্চিমবঙ্গে এই যাত্রার সময় কংগ্রেস ও তৃণমূলের তীব্র বাদানুবাদ দেখা গিয়েছে।

বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে জোটের প্রক্রিয়ায় কিছুটা সাফল্য এসেছে। কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির মধ্যে প্রবল শত্রুতা থাকলেও দিল্লিতে তারা হাত মিলিয়েছে। যদিও পাঞ্জাবে উভয় দলের মধ্যে লড়াই হচ্ছে।

উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির সাথে কংগ্রেসের বোঝাপড়া চূড়ান্ত। অনেকটা এগিয়েছে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ও এনসিপির সাথে হাত শিবিরের কথাবার্তা। বিহারে আরজেডি, কংগ্রেস ও বাম দলগুলির বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। কেরালায় পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী বাম ও কংগ্রেস।

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ঝিমিয়ে পড়া ইন্ডিয়া জোট কিছুটা জেগেছে। কিন্তু এখনো তারা যৌথ প্রচার বা অভিন্ন কর্মসূচির ব্যাপারে কোনো ঘোষণা করতে পারেনি। অথচ ভোটগ্রহণ শুরু হতে চলেছে আর দুই সপ্তাহের মধ্যে। এই প্রস্তুতি নিয়ে কীভাবে মোদী ব্রিগেডের মোকাবিলা করবে বিরোধীরা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

রাজ্যে তৃতীয় শক্তি
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের পর তৃণমূলের বিরুদ্ধে তৃতীয় শক্তির পরিসর ক্রমশ কমে এসেছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাম, কংগ্রেস ও আইএসএফ আসন সমঝোতা করলেও তারা মাত্র একটি আসনে জয়ী হয়। সেই জয়ী বিধায়ক ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফের নওশাদ সিদ্দিকী এখন সব দলের নিশানায়।

মূলত বামফ্রন্ট নেতৃত্বের উদ্যোগে তৃতীয় পক্ষের আসন বন্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথাবার্তা চলছিল। কিন্তুচার বাম শরিক, কংগ্রেস ও আইএসএফ, এই ছটি দলের মধ্যে ৪২টি কেন্দ্রের ভাগাভাগি নিয়ে ঐকমত্য তৈরি করা যায়নি। এর ফলে ভেঙে গিয়েছে সমঝোতা।

গত বৃহস্পতিবার সমঝোতা থেকে বেরিয়ে আসার কথা ঘোষণা করে দেয় আইএসএফ। তারা দ্বিতীয় দফার প্রার্থী তালিকায় ডায়মন্ড হারবারসহ অন্যান্য কেন্দ্রের নাম জানায়। গতকাল, শুক্রবার ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে নিজেদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে সিপিএম।

সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার জন্য তৃতীয় পক্ষের দলগুলি একে অপরের দিকে আঙুল তুলছে। নওশাদের বক্তব্য,‘আমরা বোঝাপড়া করেই লড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ার দায় বামেদের নিতে হবে।’

সিপিএম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন,‘যে কেন্দ্রগুলিতে বাম ও গণতান্ত্রিক জোটের ভালো ফলের সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে ওরা ভোট কেটে তৃণমূল ও বিজেপির সুবিধা করে দেবে।’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর মন্তব্য,‘হায়দরাবাদে ওআইসিকে বিজেপি যেভাবে কাজে লাগায় এখানেও আইএসএফকে ভোট কাটতে কাজে লাগাচ্ছে।’

তবে বাম ও কংগ্রেসের মধ্যে দুটি বাদে বাকি আসনে বোঝাপড়া নিয়ে সমস্যা নেই। আপাতত ৪০টি কেন্দ্রে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে এই জোট। ২৮টিতে বাম ও ১২টিতে কংগ্রেস প্রার্থীদের নাম ঘোষিত হয়েছে। এখনো দুটি আসনের প্রার্থীর নাম জানায়নি তারা। যদিও পুরুলিয়া ও কোচবিহার কেন্দ্রে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হতে চলেছে।

বিধায়কের পিছু হঠা
গত নভেম্বরে নওশাদ ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে তৃণমূলের শীর্ষ নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে চান। কিন্তু তিনি নন, নজরকাড়া কেন্দ্রটিতে আইএসএফ প্রার্থী মজনু লস্কর।

আইএসএফের কার্যনির্বাহী সভাপতি শামসুর আলি মল্লিক বলেন,‘আমরা চাইনি কোনো একটি কেন্দ্রে নওশাদ সীমাবদ্ধ থাকুন। তিনি আমাদের তারকা প্রচারক। সব কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে তিনি পক্ষে প্রচার করবেন। তাই ডায়মন্ড হারবার বা অন্য কেন্দ্রে তাকে প্রার্থী করা হচ্ছে না।’

লড়াই থেকে পিছু হঠার জন্য ভাঙড়ের বিধায়ককে কটাক্ষ করেছে তৃণমূল ও বিজেপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম বলেন, ‘নওশাদ সিদ্দিকী ভীতু। এতদিন হুঙ্কার দিয়ে এখন ভয় পেয়ে গিয়েছেন।’

অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী সংবাদমাধ্যমে বলেছেন,‘আসামের ইউডিএফের মতো পশ্চিমবঙ্গেও আইএসএফের রাজনীতির একটা সম্ভাবনা ছিল। রাজ্যের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ তাদের আইডেন্টিটি পলিটিক্সের জায়গা খুঁজে নিতে চাইছে। সেই দিক থেকে নওশাদ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারালেন।’

সূত্রের খবর, সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫টির বেশি আসন দাবি করেছিল আইএসএফ। বিস্তর দর কষাকষির পর সাতটির কম আসনে লড়তে নওশাদের দল রাজি হয়নি। রফা না হওয়ায় একলা চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএসএফ।

মইদুলের বক্তব্য,‘একটা বিধানসভা আসন জিতে আইএসএফ মনে করে তারা সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল মানুষদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। আদৌ তাদের সেই ক্ষমতা নেই। তাদের যা সাংগঠনিক ক্ষমতা, তাতে লোকসভা নির্বাচনে একটা কি দুটি আসন দাবি করতে পারত। সাত-আটটি আসন দাবি করলে কীভাবে সমঝোতা হবে!’

পর্যবেক্ষক শুভময় মৈত্র সংবাদমাধ্যমে বলেছেন,‘আইএসএফের ভূমিকা কিন্তু আসাদউদ্দিন ওয়াইসির মতোই হবে। অর্থাৎ ভোট কেটে তারা বিজেপির সুবিধা করে দেবে। যে আশার বার্তা বিজেপি ও তৃণমূল বিরোধী মানুষকে নওশাদ শুনিয়েছিলেন, তারা আইএসএফের পদক্ষেপে আশাহত হবেন। নওশাদের দল লোকসভা নির্বাচনে হয়তো বাম ও কংগ্রেসের থেকে বেশি ভোট পেতে পারে, তবে সেই সম্ভাবনা খুব কম।’

সূত্র : ডয়েচে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement