১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


ভোটের আগের কাশ্মিরে পর্যটকদের স্রোত

- ছবি : ডয়চে ভেলে

শ্রীনগরের ঐতিহাসিক লালচক এখন গমগম করছে। ক্লক টাওয়ারের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বসার জায়গাগুলো ভরা। ফুটপাথে ভিড়। মাঝেমধ্যেই কানে আসছে বাংলায় কথাবার্তা। শালের দাম বা খাবার নিয়ে তুমুল আলোচনা করছেন বাঙালি পর্যটকরা। স্কুল থেকে পড়ুয়ারা ফিরছে। রাস্তা দিয়ে চলছে গাড়ির স্রোত।

এই উপভোগ্য শীতে শ্রীনগর-সহ কাশ্মির ভরে আছে ভারতের নানান রাজ্যের পর্যটকে। বাঙালি, দক্ষিণ ভারতীয়, পাঞ্জাবি, হিন্দিভাষীতে ঠাসা। হোটেলের ঘর ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাও শ্রীনগরের অধিকাংশ হোটেলে জায়গা নেই। সব ভর্তি। রেস্তোরাঁ ভর্তি। পর্যটকে পর্যটকে ছেয়ে আছে কাশ্মির। শ্রীনগরের চারপাশে পাহাড়ের মাথায় বরফ। ডাল লেক একই রকম সুন্দর। শোনমার্গ, পহেলগাঁম, গুলমার্গ ছুটছেন পর্যটকরা।

বস্তুত, কাশ্মিরে এই হামলে পড়া পর্যটকই সরকারের কাছে সাফল্যের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাফল্যের দাবি ঘুরপাক খাচ্ছে এই ছবিটা দেখিয়েই। সহিংসতা যেখানে ছিল নিয়মিত, সেখানে এই শান্তি আনার সাফল্যই তারা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে।

বিজেপি’র মুখপাত্র আলতাফ ঠাকুর বলেন, ‘কাশ্মিরে পাথর ছোড়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা, কাশ্মিরে সন্ত্রাসবাদ, গুলি, হত্যা ছিল প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ, সেই কাশ্মিরের ছবি বদলে গেছে। সহিংসতা নেই। পর্যটক ভর্তি। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বর আর শোনা যায় না।’

তার দাবি, ‘বদলে যাওয়া কাশ্মিরে উপত্যকায় এবার পদ্ম ফুটবেই।’

কাশ্মির আগের তুলনায় শান্ত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কাশ্মিরে গত বছর দুই কোটির বেশি পর্যটক এসেছে। এ বছর সেই রেকর্ডও ভেঙে যাবে, সেই সম্ভাবনাও ষোলো আনা সত্যি। সেইসাথে এটাও সত্যি, শ্রীনগরের গলিতে গলিতে কিছুটা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনীর সৈন্যরা। একটু পরেই সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়ি। কিছুটা দূরে রাখা আছে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) গাড়ি, যার ছোট ছোট গর্ত থেকে বেরিয়ে থাকে বন্দুকের নল।

অশান্ত মণিপুরে এমন গাড়ি কয়েকটা দেখেছিলাম। কাশ্মিরের রাস্তায় একের পর এক গাড়ি ঘুরছে। বাড়ির ছাদে, রাস্তায় একটু পর পর দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক হাতে আধা সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা। কিছুক্ষণ পরই রাস্তার সব গাড়ি থামিয়ে পার করানো হচ্ছে দুই তিনটি বা অনেকগুলো সিআরপিএফের গাড়ি।

সরকারি এক কর্মকর্তা জানান, ‘পুলওয়ামার পর আর কোনো ঝুঁকি নেয়া হয় না। কোনো গাড়ি যাতে এসে সিআরপিএফের কনভয়ে বা গাড়ি ধাক্কা না মারতে পারে, বিস্ফোরণ ঘটাতে না পারে তার জন্য এই ব্যবস্থা। সৈন্যরা মাঝেমধ্যে মোটরসাইকেল বা গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করছেন।’

এই অতি-সক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফলে শ্রীনগর ও তার আশপাশের কিছু এলাকায় সহিংসতা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। ছোটখাট কিছু ঘটনা ঘটলেও তার সংখ্যা আগের তুলনায় নগন্য। কয়েকটি উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা আছে। বিশেষ করে যেগুলো পাকিস্তান সীমান্তের কাছে জঙ্গলঘেরা এলাকা। তবে সেখানকার পরিস্থিতিও আগের থেকে ভালো।

তাই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম) সাবেক সাংসদ ও বিধায়ক ইউসুফ তারিগামি, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) মোহিত বান, ন্যাশনাল কনফারেন্সের ইমরান নবি ডররা স্বীকার করেন, আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে অনেকটা ভালো হয়েছে।

তবে তারা মনে করেন, এর মানে যে শান্তি এসেছে তা নয়। তারিগামির মতে, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। কিন্তু শান্তি এসেছে তা বলা যাবে না।’

কাশ্মিরি পন্ডিত সংঘর্ষ সমিতির সভাপতি সঞ্জয় টিক্কুর বাড়ির দেয়ালে শোভা পাচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি। রাম-সীতার সাথে মহাদেবের ছবিও শোভমান। সাধারণভাবে কাশ্মিরি পণ্ডিত বলতে আমবাঙালি তথা ভারতীয়দের ধারণা হলো, তারা হলেন বিজেপি‘র আদি অকৃত্রিম সমর্থক। কিন্তু অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করে শ্রীনগরে থেকে যাওয়া টিক্কু বলেন, ‘পরিস্থিতি যদি এতটাই ভালো, তাহলে সৈন্যদের সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হোক। তারপর দেখুন অবস্থাটা। অবস্থা যদি এতটাই ভালো হয়, তাহলে পুলিশ কেন আমাদের বলে, ভয়ের কারণ আছে। কয়েকদিন বাড়ি থেকে বেরোবেন না।’

এক সরকারি আধিকারিকের বক্তব্য, ‘সন্ত্রাসবাদ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। কিন্তু তা একেবারে নির্মূল হয়নি। মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনা ঘটছে। অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে।’

তবে তার দাবি, ‘সন্ত্রাসবাদের কাশ্মির, পাথর ছোড়ার কাশ্মির আর এখনকার কাশ্মিরের মধ্যে তুলনা চলে না। সেজন্যই এমনভাবে পর্যটকরা আসতে পারছেন, নির্ভয়ে ঘুরতে পারছেন।’

আসলে এই বৈপরিত্য নিয়েই কাশ্মির তার নিজের জায়গায় আছে। এটা নিয়ে লোকসভা ভোটে যাচ্ছে কাশ্মির। ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর প্রথমবার লোকসভা ভোট। ফলে সেই ভোট ঘিরে নানান প্রশ্ন, আশা, আশঙ্কা সবই আছে। পুলওয়ামায় যেখানে পাঁচ বছর আগে বিস্ফোরণে ৪০ জন সিআরপিএফ সৈন্য মারা গেছিলেন, তার খুব কাছেই ড্রাই ফ্রুটসের দোকানের মালিক বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে কাশ্মিরের মানুষ পাঁচ লাখ টাকার বিমার সুযোগ পাচ্ছে। গরিবরা বিনা পয়সায় রেশন পাচ্ছে। কৃষকরা চার মাস পরপর দুই হাজার টাকা করে পান। বয়স্ক পেনশনসহ তারা সব প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন।’

তারপরেও তার শুধু একটাই আক্ষেপ, ‘৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মিরের মানুষের আলাদা পরিচয়টা যেন চলে গেছে।’ তাই এত কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার পর একটা আক্ষেপ তার থেকেই যাচ্ছে।

এরপরেও প্রতিটি দল, প্রশাসন, সাধারণ মানুষ মনে করছেন এবার প্রচুর ভোট পড়বে। কাশ্মিরের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এখন সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে চান না। রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন এলেই তারা ঢুপ করে যাচ্ছেন। তবে তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেই মত জানাতে চান। তারপরই বোঝা যাবে কে কোথায় দাঁড়িয়ে।

সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement