১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বাংলাদেশের সাথে ছিটমহল বিনিময়ের বিষয় ভারতে হঠাৎ কেন আলোচনায়

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল - ছবি : বাংলাপিডিয়া

বাংলাদেশের সাথে ভারতের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই আর পহেলা আগস্টের মাঝরাতে। তার প্রায় নয় বছর পরে, লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সেই প্রসঙ্গ তুলে এনেছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি ভাষণের জবাব দিতে গিয়ে কংগ্রেস তারই পুরনো একটি বিবৃতি তুলে ধরে বলেছে, ২০১৫ সালে বাস্তবায়িত ‘স্থলসীমা চুক্তি শুধু ভূমি পুনর্বিন্যাস ছিল না, সেটা ছিল হৃদয় মিলেমিশে যাওয়ার মতো ঘটনা।’

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে আসলে নরেন্দ্র মোদির তোলা একটি গুরুতর অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে ভারত-বাংলাদেশের স্থলসীমা চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে এনেছে।

মোদি অভিযোগ করেন, ‘নতুন তথ্য সামনে এসেছে যে কিভাবে বোকার মতো কংগ্রেস কচ্ছথিভু দিয়ে দিয়েছিল।’

কচ্ছথিভু একটি ছোট দ্বীপ, দুই বর্গ কিলোমিটারেরও কম আয়তন এর। শ্রীলঙ্কা আর ভারতের মধ্যে পক প্রণালীতে অবস্থিত এই ছোট্ট দ্বীপটি। শ্রীলঙ্কা ও ভারত দুই দেশই এই দ্বীপটি নিয়ে দাবি-পাল্টা দাবি জানিয়ে আসছিল। অবশেষে, ১৯৭৪ সালে ওই দ্বীপের ওপর থেকে ভারত তার দাবি তুলে নেয়।

এ নিয়ে তামিলনাডুর স্থানীয় রাজনীতি একাধিকবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে মোদিই প্রথমবার জাতীয় রাজনীতিতে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এলেন।

সামাজিক মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে ওই ঘটনাকে মোদি ‘চোখ খুলে দেয়ার মতো’ এবং ‘ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করেছেন।

তিনি লিখেছেন, ‘এটা প্রতিটি ভারতীয়কে রাগিয়ে দিয়েছে এবং মানুষের মনে এ কথা আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে যে কংগ্রেসকে কখনোই বিশ্বাস করা যায় না। ভারতের ঐক্যকে দুর্বল করা, ভারতের স্বার্থে আঘাত করাই ৭৫ বছর ধরে কংগ্রেসের কাজের ধরন।’

কচ্ছথিভু নিয়ে বিতর্ক কেন?
ভারতের ইংরেজি দৈনিক টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন থেকে কচ্ছথিভু নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ওই পত্রিকার লিখেছিল, ভারত সরকারের ‘উদাসীন মনোভাবের’ কারণে ১৯৭৪ সালে কচ্ছথিভু দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার হাতে চলে যায়।

তামিলনাড়ুর বিজেপি প্রধান কে আন্নামালাইয়ের দায়ের করা তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী আবেদন থেকে বিষয়টি জানা গেছে বলে পত্রিকাটি জানায়।

রোববার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে যেমন বিষয়টি উত্থাপন করেন, তেমনই সেদিনই তিনি এক্স হ্যান্ডেলেও লেখেন।

তারপরে সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও।

সেখানে তিনি বলেন, ‘ডিএমকে (দ্রাবিড় মুনেত্রা কাঝাগম- তামিলনাডুর ক্ষমতাসীন দল) আর কংগ্রেস এমন আচরণ করছে যে সবকিছুই কেন্দ্রীয় সরকারের দায় আর তারা যেন কিছুই করেনি। বিষয়টি নিয়ে যেন এখনই শুধু আলোচনা হচ্ছে, এর যেন কোনো ইতিহাস নেই। এটা এখন আলোচনায় এজন্য উঠে এসেছে যে মানুষ জানতে চাইছেন এই বিতর্ক কিভাবে শুরু হয়েছিল? সংসদে একাধিকার এই দ্বীপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’

‘আমি নিজে ২১ বার তামিলনাডু সরকারকে জবাব দিয়েছি। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব ও তখনকার তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির মধ্যে ১৯৭৪ সালে কথা হয় কচ্ছথিভুর ওপরে ভারত আর শ্রীলঙ্কা দুই পক্ষেরই দাবি আছে।’

তবে এর আগে ২০২২ সালে জয়শঙ্করেরই মন্ত্রণালয় – পররাষ্ট্র দফতর সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় জানিয়েছিল যে ‘ভারত-শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সীমারেখার শ্রীলঙ্কার দিকে অবস্থিত কচ্ছথিভু।’

আবার ২০১৩ সালে কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, তারা সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিল যে ভারতের কোনো ভূখণ্ডই শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দেয়া হয়নি।’

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মাছ ধরার অনুমতি
নথিতে দেখা যায়, ভারতীয় উপকূল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ১.৯ বর্গকিলোমিটার জমি নিয়ে এই দ্বীপটি অবস্থিত।

কয়েক দশক ধরে ভারত এই দ্বীপটি নিজেদের বলে দাবি করে আসছিল, কিন্তু তারপর সেই দাবি থেকে তারা সরে আসে।

শ্রীলঙ্কা আগে সিলন নামে পরিচিত ছিল। দেশটি ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরে দ্বীপটি দাবি করেছিল। তারা বলেছিল যে ভারতীয় নৌবাহিনী (তৎকালীন রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি) তাদের অনুমতি ছাড়া কচ্ছথিভুতে সামরিক মহড়া করতে পারবে না।

এরপরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন যে ওই দ্বীপটির বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই এবং দ্বীপটির ওপরে নিজেদের দাবি ছেড়ে দিতেও কোনো দ্বিধা নেই।

জানা যায়, ১৮৭৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বীপের আশেপাশে মাছ ধরার জন্য অনুমতি দিয়েছিল স্থানীয় রামনাথপুরের রাজাকে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ওই রাজার জমিদারি স্বাভাবিকভাবেই মাদ্রাজ রাজ্যের সাথে যুক্ত হয়।

‘কচ্ছথিভু নিয়ে ভারতের দাবি কতটা জোরালো, তা নিয়ে সন্দেহ আছে,’ লিখেছেন কচ্ছথিভুর ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাউথ অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের সাবেক পরিচালক ভি সুর্য্যনারায়ণ।

তার বেশ কয়েকটি বই আছে কচ্ছথিভু দ্বীপ নিয়ে।

তার মতে, ‘শ্রীলঙ্কায় সিরিমাভো বন্দরনায়েকের ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা রোখার জন্য কচ্ছথিভু নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার ছিল। সেখানকার বামপন্থী দলগুলো সন্দেহ করত যে ভারত তার প্রতিবেশীদের ওপরে খবরদারি বাড়াতে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ তারা কচ্ছথিভুর কথা বলত। কচ্ছথিভুর অধিকার শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে সেই সন্দেহ দূর করার চেষ্টা হয়েছিল।’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের চুক্তিতে ভারতীয় মৎস্যজীবীদের কিছু অধিকার দেয়া হয়েছিল। আবার ১৯৭৬ সালের চুক্তিতে সেসব অধিকার বাতিল করা হয়। এভাবেই কচ্ছথিভুর ওপরে সব অধিকার হারায় ভারত। তৎকালীন তামিলনাড়ু সরকার (ডিমএকে তখন ক্ষমতায় ছিল) কচ্ছথিভুকে শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দেয়ার বিষয়টির তীব্র বিরোধিতা করেছিল।’

‘ছিটমহল বিনিময়ের সাথে তুলনীয় নয় কখনোই’
কচ্ছথিভু দ্বীপের ওপর থেকে ভারতের দাবি তুলে নেয়ার সাথে ভারত-বাংলাদেশের স্থলচুক্তি বাস্তবায়ন কখনোই তুলনীয় নয় বলে মনে করেন সাবেক ছিটমহলের নেতৃত্ব।

দুই দেশের মধ্যে স্থলসীমা চুক্তি বাস্তবায়ন করে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হয় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই আর পহেলা আগস্টের মাঝরাতে। ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল মিশে গিয়েছিল ভারতের সাথে আর ১১১টি ভারতীয় গ্রাম হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের অঙ্গ।

স্থলচুক্তি বাস্তবায়নের দাবি তুলে দুই দেশের ছিটমহলবাসীদের বাসিন্দারা যে আন্দোলন করেছিলেন, তার নেতা ছিলেন দীপ্তিমান সেনগুপ্ত।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘কচ্ছথিভু দ্বীপের ঘটনা ছিটমহল বিনিময়ের সাথে তুলনীয় নয় কখনোই। আর ছিটমহল বিনিময়ে মোদির সরকারের ভূমিকা ছিল একান্তই বাস্তবায়নের। নেহরু-নূন চুক্তি, তারপরে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি আর খালেদা জিয়া-নরসীমা রাও চুক্তি – এগুলোই ছিল স্থলসীমা চুক্তির ভিত্তি। সেই অনুযায়ীই আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হচ্ছে ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময়।

‘আর এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কংগ্রেস-বিজেপি-বাম-তৃণমূল কংগ্রেস সকলেই কিন্তু সমর্থন করেছিল। তাই কোনো একটি দল ছিটমহল বিনিময় করিয়েছে, এভাবে দেখাটাও অনুচিত,’ বলেন দীপ্তিমান সেনগুপ্ত।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement