ঈদুল আজহার তাৎপর্য এবং বর্তমান প্রেক্ষিত
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ২৪ জুন ২০২৪, ০৭:১৮
‘উহাদের (কোরবানির পশুর) রক্ত গোশত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, পৌঁছায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমাদের ত্যাগ তিতিক্ষার দৃঢ় সঙ্কল্প (তাকওয়া)।’ (২২-৩৭) বস্তুত ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ একদিকে হজরত ইবরাহিম আ:-এর অপূর্ব ত্যাগের এবং সবরের (ধৈর্য) অবিস্মরণীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল, অন্য দিকে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম প্রকাশ; যা পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী বা সম্প্রদায়ের ভেতর অনুপস্থিত। সর্বোপরি হজের ময়দানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ একই পোশাকে একই তালবিয়া উচ্চারণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বিশ্ব মুসলিম মিলনমেলার অপরূপ যে দৃশ্য; তা মানব সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অতুলনীয়। প্রকৃতপক্ষে সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমা ও অপরিসীম ধৈর্যের পরীক্ষায় ভাস্বর এ উৎসব। শুধু আর্থিক ত্যাগ নয়; রিপুর তাড়না বিসর্জন দিয়ে ক্রোধ, লোভ, প্রতিহিংসা, ঘৃণা-আর্থিক দাম্ভিকতা দুই পায়ে মাড়িয়ে সদ্যোজাত শিশুর অবয়বে নিষ্পাপ সত্তায় পরিণত করার এ অপূর্ব আয়োজন বিশ্বের আর কোনো সভ্যতায় দেখা যায় না।
পৃথিবীর সব মুসলিম জনপদে সর্বোচ্চ ত্যাগের আহ্বান নিয়ে উপস্থিত হয় ঈদুল আজহা। সমাজের অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর সাথে সচ্ছল গোষ্ঠীর আনন্দে একাকার হয়ে যাওয়ার শিক্ষাই দেয় ঈদুল আজহা। বিত্তহীন, যারা কোরবানি দিতে অপারগ তাদের সাথে বিত্তশালীদের কোরবানির গোশত ভাগ করে নেয়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার এক নতুন মাত্রা যোগ করার অনুপম ব্যবস্থা ঈদুল আজহা। কিন্তু ইদানীং কোরবানির এ বৈশিষ্ট্য ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। কোরবানি এখন ত্যাগের মহিমার চেয়ে মর্যাদা এবং আভিজাত্যের লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের বিত্তবানদের অর্থবিত্তের প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। কে কত বড় কোরবানির পশু সর্বোচ্চ দামে কিনছেন তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং প্রচারণা চলছে।
ফলে স্বর্গীয় আহ্বান, অশুভ প্রবণতায় হারিয়ে যাচ্ছে। কল্যাণকামিতা-পরাজিত হচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কাছে। শুধু কি তা-ই! কোরবানির গোশত বিতরণের সময় প্রায়ই দেখা যায় নিজেদের কাছে গ্রহণীয় নয়, এমন গোশত বিতরণ করা হচ্ছে। অনেক সময় প্রায় সম্পূর্ণ গোশত চালান করে দেয়া হচ্ছে ডিপ ফ্রিজে। যার কদর্য্য বহিঃপ্রকাশ কোরবানির সময় নতুন ফ্রিজ কেনার ধুম। ফ্রিজ ব্যবসায়ীদের মতে, সারা বছরের তুলনায় এ সময় সবচেয়ে বেশি ফ্রিজ বিক্রি হয়। এভাবে বিত্তহীনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে সামাজিক সমতা ও ভ্রাতৃত্বের যে অনুপম শিক্ষা কোরবানির, তা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।
কোরবানির সময় সারা দেশের অসংখ্য এতিমখানা ও মাদরাসা কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করার মাধ্যমে তাদের বার্ষিক খরচের বেশির ভাগ ব্যয় নির্বাহ করত; কিন্তু কোরবানির পশুর চামড়া এখন রাজনৈতিক পক্ষদুষ্টে এক ধরনের দুর্বৃত্তায়নে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্রেণীর যুবকের দাপটে কেউ মাদরাসা বা এতিমখানায় কোরবানির চামড়া দান পর্যন্ত করতে পারেন না। তারা ‘আমরা পাড়ার ছেলে’ বা ‘অমুক সংগঠনের কর্মী’ দাবি করে চামড়া লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। ফলে দেশের অসংখ্য এতিম শিশুর নির্ভরতার খুঁটিটুকু দুর্বৃত্তায়নের দাপটে হারিয়ে যাওয়ার পথে। ‘ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর’ ঈদুল আজহা নামের আড়ালে চলে অবাধ লুণ্ঠনের মহোৎসব। যখন কোরবানির পশুর গাড়িতে চাঁদাবাজি চলে তখন ত্যাগ নামক শব্দটি লজ্জায় মুখ ঢাকে। সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ, অপরিসীম ধৈর্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার যে মৌলিক শিক্ষা ঈদুল আজহার; তা হারিয়ে যাচ্ছে। ঈদুল আজহা ক্রমে সামষ্টিক থেকে ব্যাষ্টিক আয়োজনে পরিণত হচ্ছে। সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিকতা ও মানবিক আবেদন পরাজিত হচ্ছে বিত্তবৈভবের প্রতিযোগিতার নগ্ন প্রকাশে। নিছক ব্যবসায়িক লাভ ও লোভের প্রতিযোগিতায় আজ মূল্যবোধ পরাজিত হচ্ছে মনের অজান্তে।
ত্যাগ এবং তিতিক্ষার ঐশী প্রেরণার প্রকাশ কোরবানি। ব্যানার, পোস্টার ঈদবাণী সর্বত্র এই ত্যাগের আহ্বান। কিন্তু বাস্তবে সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যা ছাড়া আর কোথাও ত্যাগের প্রতিফলনের ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। আয়োজন দেখা যায় না কোরবানির উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য নিয়ে। সবচেয়ে দৈন্যদশা ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যমে। পবিত্র হজের দিন একদিকে সারা পৃথিবীর হাজীরা যখন আরাফাতের ময়দানে প্রচণ্ড তাপে নিজের, দেশের এবং পৃথিবীর কল্যাণ কামনায় আল্লাহর কাছে আকুলভাবে মুনাজাতরত, তাদের সমবেত কণ্ঠের ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (আমি হাজির আমি হাজির) ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত, যারা হজের মাঠে উপস্থিত নেই- কিন্তু রোজা পালন করছেন, তখন দেশের ইলেকট্র্রনিক মিডিয়াগুলো নাচ, গান আর চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। ঈদ আনন্দের নামে কোরবানির মহান শিক্ষা উপেক্ষা করে প্রচার করা হচ্ছে নাচ-গান ভাঁড়ামো আর উচ্চবিত্তের রেসিপি প্রদর্শনীর অনুষ্ঠানমালা। কোরবানির ইতিহাস, এর তাৎপর্য ও শিক্ষাবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠান এখানে যেন সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। অথচ বাংলাদেশকে বিশে^র দ্বিতীয় মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বলা হয়। এখানকার ঈদ উৎসবের আয়োজনে এর প্রতিচ্ছবি হচ্ছে প্রত্যাশিত। কোনো অজানা কারণে এর ব্যত্যয় দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান।
ব্যবসায়ীরা ত্যাগের এ মাসে হঠাৎ করে যেন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তেল, মসলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদার দাম চলে যায় সাধারণের নাগালের বাইরে। মনে হয় রকেট গতিতে পণ্যের দাম আকাশের দিকে ছুটছে। এ বিষয়গুলো যাদের দেখাশোনার দায়িত্ব তারাও কিছু গৎবাধা বাক্য উচ্চারণ করে দায়িত্ব শেষ করেন। ত্যাগের মহিমা তাদের কাছে ভোগের, লুণ্ঠনের অপূর্ব সুযোগে পরিণত হয়। এভাবে কোরবানির শিক্ষা, অসাধারণ ত্যাগ ও অপরিসীম ধৈর্যের অতুলনীয় শিক্ষা এবং বহিঃপ্রকাশ ক্রমে হারিয়ে গিয়ে বস্তুবাদী প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতায় পরিণত হচ্ছে ঈদুল আজহার সামাজিকতা।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা