শিক্ষা ও শিক্ষক
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ১১ জুন ২০২৪, ০৫:৪৮
সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর আদলে নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর প্রথম সারির দেশগুলোর তালিকায় স্থান করে নেবে- এ প্রত্যাশা দেশের প্রতিটি নাগরিকের। এ ব্যাপারে প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর একটি পরামর্শ, ‘প্রকল্প নির্বাচনে স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের কথা মনে রাখা প্রয়োজন’- এর বাস্তবতা অনস্বীকার্য। শিক্ষা কার্যক্রম তৈরির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর এ পরামর্শ গুরুত্বের সাথে প্রতিফলিত হয়নি।
আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জীবনাচার, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সবকিছ্ইু পশ্চিমা দুনিয়া এবং জাপান, চীন, কোরিয়া থেকে ভিন্নতর। তাদের ক্ষেত্রে যা সম্ভব এবং শোভনীয়, পরিশীলিত, আমাদের বেলায় তা নাও হতে পারে। এ ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের ভৌত অবকাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা-সবকিছুই আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। আমাদের দেশে যেভাবে খুপড়ির মতো ছোট ছোট শ্রেণীকক্ষে গাদা গাদা করে শিশুদের পাঠদান করা হয়; শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে একাধিক শিফটে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়; ছাত্রছাত্রীদের বিনোদনের কোনো বিবেচনা না করে যেখানে সেখানে স্কুলের অনুমোদন দেয়া হয়, সেখানে বিশে^র প্রথম সারির দেশগুলোর ধারণা ধারণ করা কতটুকু বাস্তবসম্মত? নতুন শিক্ষাক্রমকে যারা বাস্তব রূপ দেবেন- অর্থাৎ শিক্ষক সমাজ, তাদের মেধা, যোগ্যতা ও প্রাক প্রস্তুতির ব্যাপারে কতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে?
ভবিষ্যতের সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী ও সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে জীবনমুখী করে গড়ে তুলবে। দেশ, জাতি, ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সামাজিক দায়বোধের সাথে পরিচিত করবে। নতুন নতুন গবেষণার জন্য জাতির মন ও মনন তৈরি করবে। নিপুণ শিল্পীর মতো পরবর্তী প্রজন্মের মনে এই চিন্তা-চেতনা ফুটিয়ে তোলেন শিক্ষকেরাই। তাদের মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে জাতির ভবিষ্যৎ এবং নতুন শিক্ষাক্রমের সফলতা।
পৃথিবীর প্রথম সারির দেশগুলোতে যখন প্রাথমিক শিক্ষকদের মেধা যোগ্যতা এবং আর্থিক সুবিধার কথা সর্বাগ্রে ভাবা হয়, সেখানে আমাদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের সুবিধা বৈশি^ক প্রেক্ষিত দূরে থাক এশিয়ার একেবারে তলানীতে। এখানে একজন প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন গড়ে ১৭০.০২ ডলারের সমপরিমাণ, যা দেশের মানুষের গড় আয়ের চাইতে ৬২ ডলার কম (বণিক বার্তা.২৬ শে মে ২০২৪) মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
একজন এমপিওভুক্ত প্রবেশনার মাধ্যমিক শিক্ষকের বেতন আরো মর্মন্তুদ এবং দুঃখজনক। একজন এমপিওভুক্ত প্রবেশনার মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকের সাকুল্য বেতন প্রায় ১১৯.৩২ ডলার বা ১৪ হাজার টাকা। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, সারা দেশে মাধ্যমিক শিক্ষক সংখ্যা দুই লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৪ জন। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাত্র ১৩ হাজার ৯৮০ জন। পক্ষান্তরে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সংখ্যা দুই লাখ ৩২ হাজার ৮০৪ জন। অর্থাৎ মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমে বলতে গেলে বেসরকারি শিক্ষকদের অবদানই মুখ্য। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তথ্যানুসারে, মাধ্যমিক শিক্ষকদের ৮০ হাজার ৮০৬ জন এমপিওভুক্ত। (বণিক বার্তা-১লা জুন ২০২৪) মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক শাখা) অধ্যাপক সৈয়দ জাফর আলীর মতে, ‘বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম- এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।’ (বণিকবার্তা ১লা জুন ২০২৪) এশিয়ার কয়েকটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন সবচাইতে কম। বিশ^ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকের বেতন ১২৫ ডলারের সমান; যা উন্নয়নশীল বাংলাদেশের চেয়েও বেশি!
বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করলেও শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। শিক্ষকদের যথাযথ সামাজিক মূল্যায়ন ও আর্থিক সক্ষমতা বাড়েনি। বরং প্রায়শই বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকদের অপমানিত, দৈহিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ছত্রছায়ায়। বাংলাদেশের মত শিক্ষক বঞ্চনার ঘটনা দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও দৃশ্যমান নয়। দেশে যেখানে জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হওয়ার কথা সেখানে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমতে কমতে গত বছর ১ দশমিক ৭৯ শতাংশে নেমে এসেছে। আবার এ বরাদ্দের বেশির ভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো নির্মাণে। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের আর্থিক দৈন্য তাদেরকে কোচিং বাণিজ্যের দিকে ঠেলে দেয় যা আজ এক জাতীয় ব্যাধি। শিক্ষকদের, বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে গত ৩১ মার্চ ৯৬ হাজার ৭৩৬টি পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে আবেদনপত্র জমা পড়েছে ২৩ হাজার ৯৩২টি। অথচ দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের কাছাকাছি। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদার অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক দুরবস্থার কথা ভেবে শিক্ষিত তরুণেরা শিক্ষকতা পেশাকে গ্রহণ করতে চাইছে না।
এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে হয়তো শিক্ষাক্রম চালু রাখার জন্য বাইরে থেকে শিক্ষক আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। বস্তুত শিক্ষা খাতের ব্যয় মূলত একটি বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগে সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। কিন্তু এসব দেশ আজ বিশ্ব অর্থনীতি এবং সভ্যতার প্রথম কাতারে। এটা সম্ভব হয়েছে শিক্ষায় তাদের বিনিয়োগের মাধ্যমে। আমরা হাঁটছি উল্টো পথে। সর্বনিম্ন বরাদ্দ নিয়ে স্মার্ট দেশ গড়ার কথা বলছি, স্বপ্ন দেখছি। অথচ এর মৌলিক শর্ত মেধাবী ও নিবেদিত শিক্ষক, শিক্ষকের সুবিধা ও মর্যাদার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। দেশকে সমৃদ্ধির পথে, উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষা বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নাই। যত দ্রুত এ সত্য অনুধাবন করা হবে, ততই মঙ্গল; নতুবা স্মার্ট জাতি গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। শিক্ষককে যদি সারাক্ষণ পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহেরর চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হয় তাহলে তিনি কখন ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্ন দেখাবেন দেশ গড়ার?
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা