পরিবার ও পারিবারিক ঐতিহ্য
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ০৩ জুন ২০২৪, ০৬:০১
মানব সভ্যতার মূল কেন্দ্রবিন্দু পরিবার। জীবনের অভিযাত্রায় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধ, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ও দায়বদ্ধতার উপলব্ধি তৈরিতে পরিবার মুখ্য ভূমিকা রাখে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে একটি জাতি বেড়ে ওঠে। জাতির ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক ধারার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে। পরিবারের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক বলয় এবং পরিবারের অনুসৃত বিশ্বাসবোধে সমৃদ্ধ হয় জাতি। পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের মাঝে গড়ে ওঠা ভালোবাসা, আদর, স্নেহ, আনুগত্য, ত্যাগ, শ্রদ্ধা এবং বিনয় ও দায়বদ্ধতা যেন একটি রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি।
পরিবারের গড়ে ওঠা পারস্পরিক সম্পর্ক, সম্মান ও মর্যাদাবোধ; ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেখায় সুখে-দুঃখে প্রয়োজনে ইস্পাতকঠিন প্রাচীর গড়তে, যা রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের প্রয়োজনে অন্যতম প্রধান শর্ত।
বাবা-মা ঘিরে পরিচালিত পরিবার তাই স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা পরস্পরের অধিকার ও দায়বোধ দেশপ্রেম ও নাগরিক চেতনায় উদ্ধুদ্ধ এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান ঘিরে সামাজিক মূল্যবোধ, দায়বোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ব্যক্তি অধিকার ও পরামর্শকেন্দ্রিক সহযোগিতার আদর্শিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। পরিবারের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্মাণ করেন অতীতের সাথে বর্তমান সেতুবন্ধ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক যেমন ভবিষ্যৎ সমাজ জীবনের পথ আলোকিত করে, তেমনি তাদের মধ্যকার সম্পর্কের ঘাটতি পরিবারের ছোটদের প্রভাবিত করে ভবিষ্যতে সৃষ্টি করে সামাজিক অনাচার ও অশান্তি। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনায় শিশুরা গড়ে ওঠে পরিবার ঘিরে। মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির সূচনায় পরিবার পালন করে কাণ্ডারির ভূমিকা।
পরিবারে বিয়ে প্রথা এক দিকে যেমন পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর করে, তেমনি অনৈতিক সম্পর্কের পথ রুদ্ধ করে। ফলে গড়ে ওঠে একটি পরিশীলিত সমাজ। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক সমাজকে কলুষিত করে অনৈতিকতার প্রসার ঘটায়। পরিবার প্রথায় পরিবারের সদস্যরা বিয়েযোগ্য হলে তাদের বিয়ের দায়িত্ব বর্তায় অভিভাবকদের ওপর। ছেলেমেয়ের বিয়ের মাধ্যমে সূচিত হয় নতুন সম্পর্কের মাত্রা। রাসূল সা: বিয়েকে তাঁর সুন্নাহ হিসেবে উল্লেখ করার মাধ্যমে সমাজকাঠামো গড়ায় এর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, বিনয়-সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা-দয়া, ক্ষমা-পাস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা- এসব মৌলিক মানবীয় গুণাবলির প্রকাশ ঘটে একটি সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে।
মায়ের আঁচল অথবা বুক শিশুর ভরসার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল, নিরাপত্তার জায়গা। এখান থেকে গড়ে ওঠে পরিবারের বন্ধনসূত্র। শিশুদের প্রতি উদাসীনতা-বয়স্কদের প্রতি অবহেলা-শিশুদের চেতনাকে প্রভাবিত করে তীব্রভাবে। পরিণাম পারিবারিক বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক অশান্তি। বর্তমানের কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে খুঁজলে দেখা যাবে এ ধরনের পারিবারিক পরিবেশ মূলত দায়ী। শিশুদের প্রতি অমনোযোগিতা, তাদের সময় না দেয়ায় প্রায়ই তারা হয়ে পড়ে আত্মকেন্দ্রিক। পিতা-মাতা, আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী এবং সামাজিকতা তাদের কাছে হয়ে ওঠে গৌণ। এর সাথে উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি তাকে হাতছানি দেয় অন্য এক ধূসর মায়াবী জগতের। এ অবস্থায় শিশুদের প্রতি সজাগ এবং সহমর্মিতার হাত না বাড়ালে পারিবারিক ভাঙনের হাত থেকে পরিবারকে রক্ষা করা কঠিন। প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতাসহ মানবিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করা। পরিবারে যত বেশি সম্ভব সময় দেয়া এবং ধর্মীয় ও নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। পরিবার প্রথার বিরুদ্ধবাদীরা এটাই চাইছে।
ইদানীং একান্নবর্তী পরিবার খুব একটা দেখা যায় না। দাদা, দাদী, চাচা, চাচী, ফুফু মিলে ৩০-৪০ জনের পরিবার এখন ভাবাই যায় না। এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরিবারে দাদী অমাবস্যার চাঁদ। বাবা-মা-ভাইবোন মিলে পরিবার। শহুরে পরিবারগুলোর পরিসর আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে টোনাটুনির সংসার। স্বামী-স্ত্রীর সংসারে বেশির ভাগ চাকরিজীবী। বিপদ-আপদে, সুখে-দুঃখে সাহায্য করার কেউ নেই। সহানুভূতি দেখাবার, সাহায্য করার পরিসর এখন ঘরের চার দেয়ালে বন্দী। বাড়ির নবজাতক শিশুটিকে দেখবার কেউ না থাকায় জীবন গৃহকর্মীনির্ভর। গৃহকর্মীর জিম্মায় অবুঝ শিশু রেখে স্বামী-স্ত্রী অফিসমুখী। ফলে এর একটি বিরূপ প্রভাব বাড়ন্ত শিশুটির ওপর পড়ছে। বাবা-মায়ের সাহচর্যের অভাব তাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। আজকাল এসব শিশুর হাতে সময় কাটানোর জন্য তুলে দেয়া হচ্ছে আপাত নির্দোষ মোবাইল ফোন বা ট্যাব। এসবের ব্যবহার আধিক্যে শিশুদের মানসিক বিকাশ দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। ফলে এরা নিজেদের মতো করে বড় হতে থাকে পরিবার ও সমাজবিমুখ হয়ে। এর প্রভাব যখন পরিবারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন আর ফেরানোর সুযোগ থাকে না।
পরিবার সংস্কৃতি বেসামাল হওয়ায় বাড়ছে লিভ টুগেদার, সিঙ্গেল মাদার বা বৃদ্ধাশ্রম নামক সামাজিক যন্ত্রণা। পরিবার প্রথার এ সঙ্কট আরো উসকে দিচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত আকাশ সংস্কৃতি। এর প্রভাবে বাড়ছে আন্তঃপারিবারিক বিরোধ, বাড়ছে বিয়েবিচ্ছেদ ও সিঙ্গেল মাদারের সংখ্যা। নিজেদের ইতিহাস ঐহিত্য, সাংস্কৃতিক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মে সঞ্চারিত করতে চাইলে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিকে যেকোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা