প্রসঙ্গ তাপদাহ : কার পাপ, কে করে প্রায়শ্চিত্ত
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ১২ মে ২০২৪, ০৬:০৭
মাত্র ক’দিন আগে দেশ অভূতপূর্ব তাপদাহে দগ্ধ হচ্ছিল। সাহারা মরুতে যেমন তপ্ত লু হাওয়া বয়, বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশি তাপ নিয়ে দিন ও রাতের বায়ুতে আগুন ঝরেছে। ভয়াবহ এই দুর্যোগে মানুষের দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। যারা ভাগ্যের বরপুত্র, সেই অসাধারণ মানুষ, যাদের বাড়িতে, গাড়িতে ও দফতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে; তারা হয়তো তাপদাহের কিছুটা বাইরে ছিলেন। তবে এমন অসাধারণ মানুষের সংখ্যা দেশে খুব বেশি নয়। ফলে কোটি কোটি মানুষ তখন তাপদাহে যেন প্রজ্বলিত চুল্লিতে পড়েছিল। এই জনপদের বহু ক্ষেত্রেই মানুষ এমন বৈষম্যের শিকার হয়ে পড়েছে। এই বৈষম্য এখন সর্বত্র বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। পক্ষান্তরে, যারা সেই অসাধারণ তাদের বিত্তবৈভব কেবলই বিস্তৃত হচ্ছে। যাই হোক, কেউ কেউ এখন এমনও বলছেন, এই প্রচণ্ড তাপদাহের কারণ প্রকৃতির প্রতিশোধ। যদি তাই হয়, তবে প্রকৃতির এমন বৈরিতা বা বিরূপ হয়ে ওঠা কি খুবই অস্বাভাবিক। তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে গাছ-গাছালি বন-বনানী খাল-বিল নদী জলাশয়। এখন বনখেকোরা গাছ কেটে বন উজাড় করছে। মাটিখেকোরা পাহাড় কেটে মাটি বালু নিয়ে বাণিজ্য করছে। সবই হচ্ছে প্রকাশ্যে, দিবালোকে। কর্তৃপক্ষ তথা যাদের দায়িত্ব এসবের দেখভালের। তারা এখন সেলামি পেয়ে রক্ষক থেকে ভক্ষকের সহযোগী হয়ে উঠেছে।
আর দোষ চাপানো হচ্ছে প্রকৃতির ঘাড়ে। এমন উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো কোনোক্রমেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। এটি অবিচার নয় অনাচার। তবে মানতেই হবে, এমন অবিচার অনাচার এখন এই জনপদে বিচার হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। কেউ একে মন্দ বললে বা বিকৃতি বলে অভিহিত করলে তখন সেটা হবে বিকল মস্তিষ্কের প্রলাপ। আর নদী-নালা, খাল-বিলে পানি নেই। সে কথা বললে কর্তৃপক্ষ হয় বেজার। কেননা এমন কথা বললে যে বন্ধু হয়ে পড়েন মনোক্ষুণ্ন। এই জনপদের বক্ষ ভেদ করে বহু শতাব্দী ধরে বহু অভিন্ন নদ-নদী টইটম্বুর হয়ে প্রবহমান ছিল। কিন্তু আমাদের কথিত সেই ‘অকৃত্রিম’ বন্ধুদেশ তার নিজের স্বার্থের প্রাধান্য দিতে আমাদের মতো অনুগত বন্ধুর প্রয়োজন উপেক্ষা করে। একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। শুকিয়ে মারতে চাচ্ছে আমাদের সেই অকৃত্রিম বন্ধু। এতে আমরা সবাই নীরব। কেননা ‘বন্ধু’র কাছে নিজেদের নিঃস্বার্থ বলে প্রমাণ দিতে হবে। পানি পাই বা না পাই। এভাবে নিজেদের শুকিয়ে আর কত দিন চলা যায়। একসময় প্রচণ্ড প্রতিবাদ হবেই। সেটা বোধ হয় অঙ্কুরিত হচ্ছে।
যাই হোক, এই তো দিন কয়েক আগে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, কুমিল্লায় সড়ক প্রশস্ত করার জন্য সাড়ে চার হাজার গাছ কাটা হয়েছে। অন্য এক খবরে প্রকাশ, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালিতে ৬ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করতে দুই পাশের ১৩৭৫টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এমন হাজার হাজার গাছ কাটার খবর প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তেই আসছে। পরিকল্পনা করে যদি রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য গাছ কাটা হয়; তবে সেই পরিকল্পনার সাথে বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি কেন সম্পৃক্ত করা হয় না? এ প্রশ্নের জবাব অবশ্য চাইবে তাপদাহে দগ্ধ প্রায় দেশবাসী।
ঢাকার অদূরে ছায়া সুনিবিড় শান্তির চাদরে ঢাকা এক অনাবিল পরিবেশে নির্মিত হয়েছিল সর্বোচ্চ শিক্ষার এক বিদ্যাপীঠ। মাঝে মধ্যে শোনা যায় সেখানে বৃক্ষনিধনের করুণ রাগিণী। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন সেখানে লালমাই পাহাড়-টিলা কাটছে। তা হলে গাছখেকো ও মাটিখেকোদের আর এককভাবে অভিযুক্ত করা কি ঠিক। ওই সব খেকো দল কখনো উচ্চ বিদ্যাপীঠের ত্রিসীমানায় পা রাখেনি। তাদের কাছে পরিবেশ নিয়ে কোনো বোধ কি আশা করা যায়।
এ কথা বলা হয়তো খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দায়িত্বের পরিধি মহানগরীর অর্ধেকটায়। সেটা বহু বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এই বিরাট এলাকায় তারা এ পর্যন্ত মহানগরীর তাপ শোষণের জন্য ক’টি বৃক্ষরোপণ করেছে করপোরেশন; যা প্রকৃত অর্থে প্রকৃতিকে শান্ত শীতল করতে পারে? মাত্র কয়েক গ্যালন পানি সিঞ্চন করে তাপদাহে ভস্মীভূত হওয়া মানুষকে নিয়ে মশকরা করা ঠিক নয়। যেমন ‘শ্যাওলা দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।’ নিশ্চয়ই বহু মূল্যে উত্তর সিটি পানি সিঞ্চনের যন্ত্রটি কিনেছেন। কিন্তু কী কারণে কিনেছেন?
এর ভেদটা কোথায় জানি না। এমন একটি ছবি সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে পানিবাহী গাড়ির ওপরে বসানো একটি যন্ত্র দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে। তাতে দু’জন গা জুড়িয়ে নিচ্ছে। উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় কোটির উপরে মানুষের বাস। প্রতিদিন তাদের ক’জনের গায়ে পানি ছিটিয়ে শান্ত শীতল করতে পারবেন তারা। এভাবে হাসি-তামাশার পাত্র হওয়াটা ঠিক নয়। এ খবর সবার জানা যে, ঢাকা রমনা থানা এলাকা পরিবেশগত বিবেচনায় সবচেয়ে অনুকূল একটি এলাকা। এখানকার পরিবেশ ভারসাম্যপূর্ণ। গরম কম, বৃষ্টি বেশি হয়, বায়ুদূষণের মাত্রা ঢাকার অন্যান্য এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত কম। এর একমাত্র কারণ রমনা পার্কের সবুজের সমারোহ। ঢাকায় যেখানে যতটুকু খোলা জায়গা পাওয়া যায়, সেখানে বৃক্ষরোপণ করা হলেই ঢাকার তাপ কিছুটা অন্তত শুষে নিত সেসব বৃক্ষ। এমন বৃক্ষ রোপণের ভাবনা কোথায়। গরম থেকে কিভাবে বাঁচা যায়। সে বিষয় নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, সারা দেশে এবং রাজধানীতে গরমের তীব্রতা ক্রমাগত বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন নির্বিচারে গাছ কাটার বিষয়টি। গাছ কেটে ফেলার জন্যই গরম মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
এ দিকে পরিবেশ নিয়ে কোনো ভাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ছিল বা আছে তা কেউ জানেন ও মন্ত্রণালয় সূত্রে শুনেছেন এমন কথা বলা যাবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যার যতটুকু দায়িত্ব সেটি না করায় এর জের বা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গোটা দেশের মানুষকে। আসলে গাছ কেটে তাপ সৃষ্টির যে পাপ তা করেছে বস্তুত হাতেগোনা মাত্র গুটিকতক মানুষরূপী লোভী তস্কর। আর সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে গোটা দেশবাসী। এ দিকে পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে দেশে ১.৫ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সেটি কেবল ২০২২ সালের পরিসংখ্যান। ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট-২০২৪-এ এই তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে। এই বাস্তুচ্যুতদের প্রশাসন কী করেছে। সেটা কি কেউ জানতে পারবে।
যাই হোক, মোদ্দা কথাটা হচ্ছে সবুজায়নের পথ ধরা ব্যতিরেকে ভিন্ন কোনো পথ নেই তাপদাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার। তবে অবাক হতে হয়, পরিবেশের এমন বিপর্যয়কালে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা দফতরের নবনিযুক্ত মন্ত্রী এ পর্যন্ত টুঁ শব্দটি কিন্তু করেননি। তিনি তার মন্ত্রণালয়ের পূর্বসূরির তথা প্রধান রাজনৈতিক নির্বাহীর কাছ থেকে দফতরের যে দলিলপত্র পেয়েছেন, সেটি দেখে তিনি বোধ হয় হতভম্ব। কেননা বিগত দিনে পরিবেশ মন্ত্রণালয় তেমন কিছু তো করেনি। এ ব্যাপারে করণীয় কী হতে পারে; তারও হয়তো বিশদ বর্ণনা নেই। তবে গোটা দেশের মানুষ এ ব্যাপারে দ্রুত অনেক কিছু আশা করে। আর এটা সবাই জানেন যে, পরিবেশগত বিপর্যয়ের সব চেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় বাংলাদেশ রয়েছে।
ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে দেশ ও দেশের তাপদাহ থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ নেই, কেবল সবুজায়নের পথ ধরা ছাড়া। আজকের উষ্ণতার প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে শুধু সরকারের পক্ষে একা সব কাজ করা সম্ভব নয়। সবুজায়ন কর্মসূচির সাথে প্রতিটি নাগরিককে সম্পৃক্ত করা জরুরি। বাংলাদেশে পরিবেশগত দূষণে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। তাই পরিবেশকে উল্টো পথে ফেরানোর কাজ এখন কতটা জরুরি তা আর বলার আদৌ কোনো প্রয়োজন পড়ে না। আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে বিলম্বে কিছু করার কোনো সুযোগ নেই।
দেশের সংবিধানেও পরিবেশ সংরক্ষণের তাগিদ রয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ জলাভূমি বন সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। অথচ এ নিয়ে গাফিলতির শেষ নেই। সেটা সবার কাছে স্পষ্ট।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা