১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অর্জনের যোগ্যতা নেই, রেকর্ডের মালিক বনতে চায়

অর্জনের যোগ্যতা নেই, রেকর্ডের মালিক বনতে চায় - নয়া দিগন্ত

উন্নত-সমৃদ্ধ জাতিগুলো যখন শিক্ষা-সাহিত্য-বিজ্ঞান ও মহাকাশ গবেষণায় মনোযোগ দিচ্ছে, আমাদের দেশে শুরু হয়েছে কলাবিজ্ঞানীদের উৎপাত। বাঘ ভল্লুক হুতোম পেঁচার বিকট মুখোশ প্রদর্শন করে তারা কিছু একটা করতে চায়। এরা রাস্তায় তথাকথিত আল্পনা আঁকতে চায়। হাসি ঠাট্টা মশকরার আইটেম নিয়ে জাতিকে বেকুব বানাতে চায়। এরা দেখাতে চায়, মহাকাশবিজ্ঞান তোমার বিষয় নয়, তুমি এতই খর্ব যে, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি চর্চার উপযুক্ত তুমি নও। তাই এরা গিনেস বুকে নাম লেখানোর মোটাবুদ্ধির তামাশায় নেমেছে।

আমাদের জাতির মাথার ওপর ভর করে থাকা লোকেরা জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে এক রেকর্ড গড়েছে। ২০১৪ সালে আড়াই লাখ মানুষ একসাথে গেয়ে ‘এই ঐতিহাসিক অর্জন করেছে’। কতগুলো মানুষ একত্রিত হয়ে মাথাগুনে কিছু একটা করা যদি ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় তাহলে সেটি চীন ও ভারতের চেয়ে কে বেশি করে দেখাতে পারে? দেশ দু’টি দেড় শ’ কোটি জনসংখ্যার দেশ। দেশ দু’টি নিজেদের জাতীয় কর্মকাণ্ডে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে। তারা চাইলে জাতীয় সঙ্গীতের লাইনে ১০০ কোটি মানুষ দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। এরপর অন্য কেউ সেই রেকর্ড ভাঙতে পারবে না তা জেনেও তারা রেকর্ডটি অর্জন করতে চায় না। পৃথিবীতে আরো বহু দেশ আছে যারা চাইলে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে আমাদের করা রেকর্ড যেকোনো সময় ভেঙে দিতে পারে। আমাদের চেয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন এসব দেশ তা করতে কোনো ধরনের উৎসাহ পায় না। তাহলে এ ধরনের একটি রেকর্ড যা কোনো মূল্যবোধ যুক্ত করে না তার উদ্দেশ্য কী, আবার এসব নিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ ও হইচই কেন?

রমজান মাসের শেষে হাওরাঞ্চলে সম্প্রতি আরেক অদ্ভুত রেকর্ড অর্জনের ভীমরতি দেখা গেল। ওই অঞ্চলে সড়ক উন্নয়ন নিয়ে পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে আগেই প্রশ্ন উঠেছে। মাছ ও শস্যের ভাণ্ডারকে এলোপাতাড়ি রাস্তা বানিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন সেই রাস্তায় পৃথিবীর দীর্ঘ আল্পনা আঁকা হয়েছে এমন সব রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে, যা প্রাণ-প্রকৃতির বারোটা বাজাবে। এতে ব্যবহৃত রঙে রয়েছে ভারী ধাতু- পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা। এ ছাড়া এতে ব্যবহৃত হয়েছে বিসফেনল যা মাছের ডিমপাড়ার প্রক্রিয়া ভয়াবহ ক্ষতি করবে। হাওর একটি উচ্চমাত্রার পরিবেশ-স্পর্শকাতর এলাকা। এ ধরনের ক্ষতিকর বিষ পানিতে মিশে মানুষের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়বে। অতি উৎসাহী কিছু কোম্পানি যারা এগুলো করতে চাইছে, নিশ্চয় বাংলাদেশী নয়। ঢাকার রাস্তাতেও আল্পনা আঁকা হচ্ছে। এগুলোতে মেজর করা হচ্ছে মাছ পাখি মানুষ। তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রতিমাও রয়েছে। তারা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, একসময় মূর্তির ছবি প্রাধান্য পাবে। প্রথমে তারা আল্পনার নামে এর সূত্রপাত করেছে, পরে মূর্তি ঢুকিয়ে দেবে। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদের যে আগ্রাসন শুরু হয়েছে- এটি কি তার একটি অংশ, সে প্রশ্ন দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়।

হাওরের ১৫ কিলোমিটার রাস্তায় এমন ভারী রঙ দিয়ে লেপ্টে দেয়া হয়েছে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিকেটর লুপ্ত হয়েছে। এ রাস্তায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। তার আগে ফ্লাইওভারগুলোতে এ আল্পনা এমনভাবে আঁকা হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে। এতে কোনো ফাটল দেখা দিলে সেটি কথিত আল্পনার কারণে চোখে পড়বে না। কেবল দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে রাস্তার চলাচলরত মানুষ ও গাড়ির ওপর ধসে পড়লে বোঝা যাবে- ফ্লাইওভারে ফাটল ছিল।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৈশ্বিক র্যাংকিং প্রকাশিত হয়েছে। তাতে এশিয়ার ৩০০টির মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পড়েনি। প্রতিবেশী ভারতের কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এমনকি আমরা যে ব্যর্থ হওয়া পাকিস্তানের কথা বলি, তাদেরও এক ডজনের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ৩০০-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ভিসি দাবি করেছিলেন, উন্নত মানের চা, সমুচা, শিঙ্গাড়া এখানে কম দামে পাওয়া যায়! একটি জাতি উন্নত সমৃদ্ধ হচ্ছে কি না সেটি গিনেস বুকে নাম উঠিয়ে পরিমাপ করার দরকার হয় না। এ জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সরকার ব্যবস্থাপনা, খেলাধুলার পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে দেশটির প্রকৃত তাকত বা হেডম কতটুকু। খেলার উদাহরণ দিলে আমরা কিছু বোঝতে পারব। ফিফা র্যাংকিংয়ে ফুটবলে আমরা ২০৪টি দেশের মধ্যে ১৯২তম। জনসংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ দেশ।

এমন সব দেশ বাংলাদেশকে পেছনে ফেলেছে, তাদের জনসংখ্যা কয়েক লাখ মাত্র। মেসি যখন ইউরোপীয় ক্লাবে এক বছরে গোলের আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে, আমরা তখন তার দেশের পতাকা বানিয়ে আনন্দিত হচ্ছি। আমাদের দেশের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা এ ধরনের মূল্যহীন কাজে নিরুৎসাহিত করার জন্য এগিয়ে আসেন না। তারা আর্জেন্টিনার বড় একটি পতাকা তৈরি করে রেকর্ড করতে চান। এক বছরে মেসির সর্বাধিক গোল করা রেকর্ডকে অর্জন বলা যায়। আমরা জাতি হিসেবে এতটা নিচে নামতে চাচ্ছি- কেবল লম্বা-চওড়া আর্জেন্টিনার একটি পতাকা বানিয়ে রেকর্ড করতে চাচ্ছি। এ নিয়ে হইচই করে নিজেদের বাহবা দিচ্ছি। শিক্ষায় আমরা ১৩৭টি দেশের মধ্যে ১২৪, স্বাস্থ্যসেবায় ১৬৭টি দেশের মধ্যে ১০৬, সুখী মানুষের তালিকায় ১৩৭ দেশের মধ্যে ১১৮তম।

সরকার পরিচালনার দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে নিচে আর কেউ হওয়ার সম্ভাবনা কম। আমাদের পুরো ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে রয়েছে ভুলের ওপর। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রতিদিন জাতির সামনে দাঁড়িয়ে ডাহা মিথ্যা বলতে সামান্য লজ্জাও পান না।

৯ হাজার লিটার রঙ ব্যবহার করে আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করলাম। বিপুল অঙ্কের এ অর্থ দিয়ে অনেক ভালো কাজ করা যেত। বার্জার ও তার সাথে মিলে কয়েকটি বিদেশী কোম্পানি সেসব ভালো কাজে কেন উৎসাহ পায় না, এ প্রশ্ন ও সন্দেহ মানুষের মনে ঢোকা স্বাভাবিক। এরা আমাদের দেশে ব্যবসার দারুণ অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে। চুটিয়ে ব্যবসায় করার পর এমন কিছু উপহার দিচ্ছে যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement