নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৪
রজনীকান্ত সেনের কবিতা ‘স্বাধীনতার সুখ’ পড়েছিলাম শৈশবে। সম্ভবত তৃতীয় শ্রেণীতে। বাবুই পাখি আর চড়ুয়ের কথোপকথন-কবিতার ছন্দে। স্বাধীনতার আনন্দ এবং দেশপ্রেমের এমন সরল সুন্দর প্রকাশ খুব কম দেখা যায়। এখন যেমন হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি, সুপারি তাল আর নারকেল গাছের মাথায় তার অপূর্ব নকশি ঠাস বুননে গড়া বাসা; তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার গৌরব আর অহঙ্কারের প্রতীক আমাদের দেশীয় পণ্য। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে গাড়ি তৈরির কারখানা- আমাদের অহঙ্কার প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ হারিয়ে গেছে। বেকো সাইকেলের নাম স্মৃতি হাতড়ে খুঁজতে হয়। অথচ বিদেশী সাইকেলের রমরমা ব্যবসায়। আমাদের অহঙ্কার সোনালি আঁশ আজ কৃষকের গলার ফাঁস। প্রসিদ্ধ পাটকল আদমজী জুটমিল এখন কাক-চড়ুইয়ের আস্তানা।
মিশুক কিছু দিন আগের কথা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ধোলাইখালের সৃষ্টি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ বিশাল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র; যা দেশের বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারত; হতে পারত অর্থনৈতিক মাইলফলক, তাও আজ হারিয়ে গেছে। মিশুকের জায়গা দখল করে সারা দেশের গ্রামগঞ্জে, শহরে, শহরতলিতে একই ধরনের উন্নত মানের অসংখ্য বিদেশী যান রাস্তাঘাটে সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে এক দিকে যেমন মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বিদেশে; তেমনি এ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিতে লাখো সম্ভাবনাময় তরুণকে বিদেশে রাস্তা ঝাড়ুদারের, গাড়ি মোছার এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে দিন-রাত অমানবিক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অনেকে হারিয়ে যাচ্ছে মরুভূমির বালিয়াড়িতে, সমুদ্রের গহিন অতলে; অথবা বিদেশের জেলখানায়। তারা নিজেরা যেমন প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন দেশে, দেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে পারতেন; তাদের অনেকে আজ বেওয়ারিশ লাশ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছেন বিদেশ বিভূঁইয়ে। রাজশাহী সিল্ক, টাঙ্গাইলের তাঁতের বাহারি নকশার জামদানি ছেড়ে অনেককে দেখি বিয়ের সওদা করতে যান বিদেশে। যা নিয়ে আসেন, তার চেয়ে উন্নতমানের কাপড় দেশে তৈরি হয়। অথচ তাদের বিদেশী জিনিস চাই-ই চাই। নিজেদের এ আত্মধ্বংসী মানসিকতা আর কোনো জাতির আছে বলে জানা নেই। বিদেশে দীর্ঘসময় থাকার সুবাদে দেখেছি অনেক দেশের নাগরিক দেশ থেকে আসার সময় পোস্ট অফিসের পোস্টকার্ড, খাম, টিকিট সাথে নিয়ে আসতেন। কেউ দেশে গেলে তার হাতে ধরিয়ে দিতেন, তিনি যেন দেশে গিয়ে চিঠিটি পোস্ট করে দেন। সিকদার মেডিক্যাল কলেজে যখন কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ খোলা হয় তখন যে হৃদশল্যবিদ প্রথম এ বিভাগে যোগ দেন তার প্রধান শর্ত ছিল অস্ত্রোপচার কক্ষের ঝাড়–দার থেকে শুরু করে সব জনশক্তি দেশীয় হতে হবে। অভিবাদন জানাই এমন মানসিকতা-সম্পন্ন ব্যক্তিদের।
আমাদের দেশে মিষ্টি, চানাচুর, সেমাই, চা-পাতা এসবের অভাব আছে বা ছিল তা কোনো দিন শোনা যায়নি। দেশীয় প্রস্তুতকারকরা এসব তৈরিতে অপারগ তাও শোনা যায়নি। অথচ দেশের বড় বড় শপিংমলে আমদানি করা এসব দ্রব্যের ছড়াছড়ি। এক সময় হয়তো দেখা যাবে এসবের পুরোটা আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়েছে। পরিণামে দেশীয় প্রস্তুতকারকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন। অথচ এরা প্রান্তিক অর্থনীতির কারিগর। তারা হেরে যাওয়া মানে দেশ হেরে যাওয়া। এদের জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন হয় সেগুলোর আমদানি দেশের স্বার্থে অবিলম্বে বন্ধ করে অথবা সীমিত করা প্রয়োজন। আমাদের প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু দেশে আমদানি নীতিমালার এটি একটি অন্যতম শর্ত। অথচ আমরা হাঁটছি উল্টো পথে। পরিণতিতে আমরা ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছি একটি শতভাগ আমদানিকারক দেশে।
ঈদ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের সময় হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় ব্যবসার মাধ্যমে। দেশী-বিদেশী সব ধরনের ব্যবসায়ীর চোখ থাকে এসব অনুষ্ঠানের দিকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দেশজ পণ্যের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা যেমন দরকার; তেমনি জনসাধারণেরও সচেতনতার প্রয়োজন। ইদানীং বিদেশী পণ্যের প্রতি মোহাবিষ্ট হওয়ায় নিবু নিবু হয়ে গেছে দেশীয় কাঁসাশিল্প। অথচ এক সময় দেশের প্রতিটি ঘরে ছিল এর সদর্প অবস্থান। আজ কাঁসার তৈজসপত্র খুঁজে পাওয়া ভার। তেমনি আমদানি করা স্বর্ণালঙ্কারে চোখে অন্ধকার দেখছেন স্বর্ণকার সম্প্রদায়। উৎপাদক এবং ক্রেতারা চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। আর তৃপ্তির হাসি হাসছেন আমদানিকারকরা। এখন দেশে বিদেশী পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন, তেল, চিনি, লবণ, চাল-ডালে বাজার সয়লাব। দেশীয় পণ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুনেছি শজনে ডাঁটা ও কচুর লতিও আমদানি হচ্ছে। মাছে ভাতে বাঙালি আজ মাছ এবং ভাতের জন্য পরমুখাপেক্ষী। আমদানিকারক গোষ্ঠীর করুণায় নির্ভরশীল। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। চললে দেশের অর্থনীতি বলতে কিছু থাকবে না। দেশীয় বণিকদের ব্যক্তিগত লোভে এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নবাব মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদদৌলাহকে বরণ করতে হয়েছিল করুণ পরিণতি। জাতির কাঁধে চেপে বসেছিল ২০০ বছরের পরাধীনতা। দেশীয় তাঁতীদের পঙ্গু করে গড়ে উঠেছিল বিলেতের বস্ত্রশিল্প। বিদেশী পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছিল এক সময়ের সোনার বাংলা। সবশেষে সবার প্রতি, সরকারি নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং ভোক্তা সাধারণের উদ্দেশে সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,
‘পাকা হোক, তবু ভাই পরের ও বাসা
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।
’
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা