প্রসঙ্গ বুয়েট : কেন অনাকাঙ্ক্ষিত এই তর্ক
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৬
চর্বিতচর্বণ অর্থাৎ আলোচিত বিষয়েরই পুনরুক্তি করা কখনোই উপাদেয় হতে পারে না। এটি কর্ণসুখেরও বিষয় নয়; বরং কর্ণকে ক্লান্ত করে বিরক্তিও উৎপাদন করতে পারে। আসলে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই সে বিষয়ে বিজ্ঞ ও গুণীজন ও বিদগ্ধ ব্যক্তিদের অনেকেই অনেক কথা বলে ফেলেছেন। পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। তারপরও সে প্রসঙ্গের জের কেটে গেছে বলে মনে হয় না। এ প্রসঙ্গ নিয়ে পক্ষ-প্রতিপক্ষ তৈরি হয়ে গেছে। পক্ষের ধারাটি ক্ষীণ হলেও অর্থাৎ যারা প্রসঙ্গটি অনাবশ্যক তৈরি করেছে তাদের সৃষ্ট ধারাটি ক্ষীণ হলেও সেটি এখনো শুকিয়ে যায়নি। আর বিপক্ষের ধারাটি প্রবল বেগবান। হয়তো সেখান থেকে আরো কথা প্রয়োজনে আসতে পারে।
বলে রাখি, প্রসঙ্গটি দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বুয়েটকে কেন্দ্র করে। প্রথম পক্ষ হচ্ছে শাসক দলের অঙ্গ ছাত্র সংগঠন ও তাদের ঊর্ধ্বতনরা। যারা অনাবশ্যক বুয়েটকে নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত এক বিতর্ক তৈরি করেছে। তার সূচনা এবং এখন সে বিতর্ক কোথায় ও কোন পর্যায়ে রয়েছে, সেটা প্রায় কারোই অজানা নয়। যারা পায়ে পাড়া দিয়ে বিবাদ তৈরি করতে চায় তারা কিন্তু সহজে হটে যাওয়ার পাত্র নয়। তাদের পক্ষে কোনো যুক্তি না থাকলেও, তারা মাথা খাটিয়ে না পারলেও গায়ের জোর খাটায়। তাদের সে শক্তিটি অনেক বেশি। সবসময় সর্বত্র সেটি দেখা গেছে। দেশের বাইরে থেকে যারা বুয়েটে একসময় শিক্ষার্থী ছিলেন, এখন তারা বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। সেসব প্রথিতযশা ব্যক্তিও নানা যুক্তি উদাহরণ পেশ করে বুয়েটের বর্তমান স্বতন্ত্র সত্তা অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে কথা বলছেন।
তারা মনে করেন, এই স্বাতন্ত্র্য হারালে বুয়েট আর স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থাকবে না। তাতে শুধু আজকের শিক্ষার্থীরাই নয় গোটা জাতি একসময় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন হাজারও বিলাপ করে কোনো লাভ হবে না। ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পাশাপাশি বিজ্ঞজনের দূরদৃষ্টি সব কিছু উপেক্ষা করে কর্তৃপক্ষ লাগাতারভাবে উল্টো পথেই চলছে। যার একমাত্র পরিণতি হতে পারে বুয়েটকে অসুস্থ করে তোলা। বুয়েটে এখন পর্যন্ত উচ্চমানের শিক্ষা দেয়া নেয়া হয়। তার মান বজায় রাখতে উপযোগী পরিবেশ অপরিহার্য। তাকে বিষাক্ত করার যে উদ্যোগ-আয়োজন তাকে জাতি সবিস্ময়ে লক্ষ করছে। বোদ্ধাজনদেরও এ নিয়ে শোকতাপের শেষ নেই। অথচ কর্তৃপক্ষ তাদের এই অপপ্রয়াস জায়েজ করার জন্য নানা খোঁড়াযুক্তি এবং নানান জুজুর ভয় দেখাচ্ছে। তাদের এই খোঁড়া যুক্তি ও জুজুর ভয় এমনই হাওয়ার বেলুনের মতো যে, একটু টোকা দিলেই মুহূর্তে চুপসে যাবে। অতীতে এমন অনেক কিছু ক্ষণকালের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুধু অপূর্বই নয়। যারা জাতিসত্তাকে উচ্চকিত করতে এখানে সেখানে কাজ করছেন, তাদেরও বুয়েটের আন্দোলন উদ্বুুদ্ধ উদ্দীপ্ত করবে সন্দেহ নেই। এই পরিস্থিতি লক্ষ করে অত্যন্ত ভগ্ন মন নিয়ে বলতে হয়, বুয়েটের এই বিপদের সময় প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনের মধ্যে যে চরম উদ্বেগ, অস্থিরতা দেখা দেয়ার কথা ছিল তেমনটা লক্ষ করা যায়নি। বরং তাদের ভূমিকা এতটাই শীতল ন্যুব্জ যে, সবাইকে সেটি হতবাক করেছে। অনেকটা যেন লড়াকু সৈন্য দলের দুর্বল চিত্তের সেনাপতির মতো। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যারাই যখন থেকেছেন, তাদের দায়িত্ববোধ কর্তব্যপরায়ণতা থাকা উচিত হিমালয় চূড়ার সমতুল্য। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের এক সময়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক এম এ রশিদের কথা অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের ভিসি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যেতে পারে।
বুয়েট ‘দখলের’ প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে ছাত্রলীগ নেতারা উল্লেখ করেছেন, তারা বুয়েটে সৃষ্টিশীল ছাত্ররাজনীতি চালু করতে চান। এই বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে অনেকে বলছেন, ছাত্রলীগ নিজের ঘর থেকে এমন সৃষ্টিশীল ছাত্ররাজনীতিটা শুরু করুক না প্রথমে। তাদের সংগঠনের আনাচে-কানাচে এবং সর্বত্রই নিজেদের ভেতর সংঘর্ষ-সঙ্ঘাত প্রতিনিয়ত চলছে। কর্মীরা পরস্পর মারছে, মরছে। সেখানেই সৃষ্টিশীলতার সংস্কৃতির পরিচর্যা শুরু করাটাই এখন বেশি প্রয়োজন নয় কি? কথায় আছে, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও। নিজের ঘর সাজিয়ে উদাহরণ তৈরি করুক তারা। তারপর না হয় বুয়েটে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সেটি অনুসরণ করতে বলা যাবে অনায়াসে। তার আগে কোন যুক্তিতে এমন কথা বলা?
আজ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বলতে কেবল ছাত্রলীগের ছড়ি ঘোরানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর কোনো সংগঠনের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। তবে কেন ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এত অনাচার-অবিচার। কেন তবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বারবার ধ্বংস হচ্ছে, সেশনজট খুলছে না। ছাত্রলীগের ভেতরকার দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের জেরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয় বারবার। ওখানে সৃষ্টিশীলতার ন্যূনতম কোনো চর্চা কেন নেই। কিছুকাল আগে আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা বলেছিলেন, বুয়েটে ছাত্রদের মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। তাহলে দেখা যেতে পারে, বুয়েট শিক্ষার্থীদের মতামতটা কেমন। অতি সম্প্রতি বুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে- ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে মত দিয়েছেন। একই সাথে আরেকটি বিষয়ের দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করছেন এবং সব ধরনের পরীক্ষাও বর্জন করছেন।
তবে একটি ক্লাস টেস্টে মাত্র কয়েকজন ছাত্র অংশ নিলেও আর সব ছাত্রছাত্রী একযোগে পরীক্ষা বর্জন করেন। এই দুই উদাহরণ সামনে রাখলে এটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়, শিক্ষার্থীরা কী চান, সে আলোকে সিদ্ধান্ত হওয়াটাই উচিত। আওয়ামী লীগ ও তাদের সব অনুগামী তাকে গ্রহণ করে নিক। দেখা গেছে, বুয়েটের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের মত দিয়েছেন। এখন বিষয়টি খুব সহজ হয়ে পড়েছে। সিদ্ধান্ত কী হতে পারে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বরাবর সোচ্চার কণ্ঠে বলে, তারা গণতন্ত্রের প্রথম কাতারের সৈনিক। বুয়েটে তাদের এখন গণতন্ত্রের পক্ষেই দাঁড়ানোটাই বিবেচনায় একনম্বরে রাখতে হবে। ভিন্ন আর কিছু নয়। এদিকে বিজ্ঞজনদের অভিমত, গত শতাব্দীর ষাট দশকে ছাত্রনেতারা অত্যন্ত সম্মানীয় বরণীয় ছিলেন। তারা নীতিবোধ ও নীতিবোধের চর্চা করতেন। কিন্তু এখন মানুষের শ্রদ্ধাবোধ দিনে দিনে ছাত্রনেতাদের ব্যাপারে তলানিতে পৌঁছে গেছে।
আগে ছাত্রনেতাদের মন জুড়েছিল দেশ ও দশের কল্যাণ চিন্তা। কিন্তু আজ নেতাদের চিন্তায় শুধু ঘুরপাক খায় নিজ ও গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। এ ক্ষেত্রে এখনো আগের চিন্তার দূরত্ব আকাশ আর পাতালের সমতুল্য। আরো যোগ হয়েছে ছাত্ররাজনীতির সাথে ক্ষমতার দাপট। আরো অনেক অপকর্ম একাকার হয়ে গেছে। এর আগে সেটি দেখা যেত না।
সবাই চান বুয়েটের চলমান অস্থিরতা ও উদ্বেগের সুষ্ঠু সমাধান। কিন্তু মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও সরকার এখন অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু করাই তাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বুয়েটের বাইরে বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিও কি ছাত্ররাজনীতি নিয়ে স্বাভাবিক বা ভালো অবস্থায় আছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যসহ শিক্ষকদের একাংশ ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিস্তর অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একই সাথে শাসক দলের অঙ্গ ছাত্র সংগঠনের অনুচিত কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের নানা সমাচার নিয়ত লাগাতারভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ্রেণীর ছাত্র ও কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানিরও খবর প্রকাশ পাচ্ছে একের পর এক।
বিজ্ঞ পাঠকরা পর্যন্ত বোধ হয় বুয়েটের বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের একটি পথ ভেবে রেখেছেন। কারণ বিজ্ঞ পাঠকদের কেউ কেউ এই ঐতিহ্যবাহী স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একসময়ের গর্বিত ছাত্র বা তার সন্তান এখন বুয়েটে ছাত্র বা ছাত্রী। তাদের একমাত্র কামনা, বুয়েট তার ঐতিহ্য বজায় রেখে চলুক। সব কর্তৃপক্ষ যদি বুয়েটের সঙ্কট নিরসনের সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায়- সেটি এখন ‘জলবৎ তরলং’। কেননা, বুয়েটের সমস্যার নিরসন নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশনে বহু বক্তব্য এসেছে, জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞজন লিখে মত প্রকাশ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু কথা বলা হয়েছে। সেসব বক্তব্যের প্রতিটি কথায় ও লেখার প্রতিটি ছত্রে বুয়েটের সঙ্কট কারণ এবং তা থেকে উত্তরণের পথনির্দেশও রয়েছে। সেসব বক্তব্য থেকে সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা খুব সহজ। যদি না তাদের মনে অন্য কিছু লুকিয়ে থাকে।
তবে কর্তৃপক্ষের মনে যা লুকিয়ে রয়েছে তাকে যদি তারা অনুসরণ করতেই চায় তবে যা ইতোমধ্যে ঘটেছে। যেমন- গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত, নীতিনৈতিকতার অন্তর্ধান, শিক্ষাব্যবস্থায় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে বিষবাষ্প, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ধসে গেছে। এসব দেখে যারা আনন্দে আহলাদে আটখানা, আর বুয়েট শেষ হয়ে গেলে তারা তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে। আর আমাদের কোরাস হবে- ‘হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ’।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা