১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
দেশ জাতি রাষ্ট্র

বুয়েট দখল : ‘গড়ার মুরোদ নেই নষ্টের গুরু’

বুয়েট দখল : ‘গড়ার মুরোদ নেই নষ্টের গুরু’ - নয়া দিগন্ত

বঙ্কিমের ভাষায়- ‘লতায় কণ্টক আছে, কুসুমে কীট আছে, গন্ধে বিষ আছে, স্ত্রী জাতি বঞ্চনা জানে।’ সব কিছুতে নেতিবাচক মনোভাব। সব কিছুতে দোষ খোঁজা যাদের অভ্যাস, নিজের দখলে না রাখতে পারলে সুখ নেই। সব কিছুই তাদের করায়ত্ত থাকতে হবে। জুতা সেলাই থেকে পবিত্র পাঠ- সবই তাদের করতে হবে। সবাই মীরজাফর। তারাই একমাত্র সিরাজউদদৌলা- এই মনোভাব তাদের। ভালো তাদের সয়না। নষ্ট না করা পর্যন্ত তৃপ্তি নেই। শাসক আওয়ামী লীগ বিগত ১৭ বছর ধরে এই মনোভাব পোষণ করে আসছে। বলাবাহুল্য, এটি ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যকে সহ্য করতে না পারা। অন্যের ভালো দেখে জ্বলেপুড়ে মরা তাদের বৈশিষ্ট্য।

মনে পড়ে ১৯৯৬ সালে যখন তারা ক্ষমতাসীন হয় তখন থেকে এ পর্যন্ত ভালো কিছু স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম এমনকি ব্যাংক- যেটি সবচেয়ে ভালো সেটি তাদের দখলে নিতেই হবে। উলটপালট করে লুটেপুটে খাবে তারা। এই মনোভাবের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বুয়েট। এটি একটি স্বতন্ত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। বহির্বিশ্বে এখনো এদের একটু সুনাম অবশিষ্ট আছে। সেটি নষ্ট না করতে পারলে তাদের কৃতিত্ব কোথায়? তাই তাদের সোনার ছেলেদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে সেটি দখলে নিতে। সেখানে দখল স্বত্ব জায়েজ করার জন্য জঙ্গি আবিষ্কার করছেন কর্তাব্যক্তিরা। একযোগে শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও দখলের মহিমা কীর্তন করছেন। ছাত্রলীগের হয়ে ওবায়দুল কাদের সাফাই গেয়েছেন, ছাত্রলীগ দখলদারত্বে বিশ্বাস করে না। তবে এটি কী? এমনিতেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সব অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানকে দলীয় শাখায় পরিণত করেছেন, এবার বিচারালয়ের কাঁধে বন্দুক রেখে চাতুর্জের সাথে জবরদখল বুঝে নিলেন। বুয়েটের বশংবদ উপাচার্য তা ‘শিরোধার্য’ করলেন। লোকজন বলল ‘বাহ বা বাহ বা বাহ বা বেশ!’

গত সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে যেসব ঘটনা ঘটছে তা শিক্ষাঙ্গনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ ঘটিয়েছে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর থেকে ছাত্রদের দাবির মুখে সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সিদ্ধান্তের পর ভালোই চলছিল দেশের প্রসিদ্ধ এ প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এই ভালোত্ব শাসক গোষ্ঠীর কাম্য নয়। গত মাসের শেষ দিকে ছাত্রলীগ দখলদারিত্বের মহড়া দিতে শুরু করে। ছাত্রলীগ নেতারা মধ্যরাতে বুয়েট দখলের পাঁয়তারা শুরু করে। রাত সাড়ে ১০টার পর বুয়েট শিক্ষার্থীদেরই যেখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে সেখানে দলীয় রাজনীতি তথা বুয়েট দখলের জন্য তারা এ অন্যায় জবরদখল কেন করবে?

ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এহেন জবরদখলের প্রতিবাদে এবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীরা তখন থেকেই আন্দোলন করছেন। তারা দলবাজ বুয়েট শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সাধারণ দাবির সাথে একমত না হয়ে বিচারালয়ের আদেশকে শিরোধার্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আদালত যেটি বলবেন আমাকে সেটি মানতে হবে। আদালতের আদেশ শিরোধার্য, আমরা আদালত অবমাননা করতে পারব না। ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের পর তিনি এসব কথা বলেন। উল্লেখ্য, বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন ও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেয়া জরুরি বিজ্ঞপ্তির বৈধতা নিয়ে ছাত্রলীগ হাইকোর্টে একটি রিট করে। রিটটি করেন বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন। তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে বুয়েট ভিসি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু ভিসির ভাষা ও ব্যবহার ছাত্রদের অনুকূল বলে মনে হয়নি। ভাষার মারপ্যাঁচে তিনি প্রকারান্তরে সরকারের বয়ানে কথা বলেন। ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চালুর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৯ আবরার ফাহাদ হত্যায় যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সেই পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, সেটি যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে তাদের আবার উদ্যোগী হতে হবে। উপাচার্য বলেন, দেশের জন্য কাজ করতে হলে রাজনীতি শিখতে হবে। এ বিষয়গুলো যদি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন তখন ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত হতে পারে। তিনি বলেন, আমার একার পক্ষে বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোর করে রাজনীতি করতেই হবে- এটি বলতে পারব না কিন্তু তারা যদি নিজ থেকে উদ্যোগ নেয় রাজনীতি শিখতে চায়, করতে চায়, প্র্যাকটিস করতে চায়- অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় আছে আমাদের এখানেও তারা তা করতে পারে। এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। উপাচার্য কায়দা করে বলেন, শিক্ষার্থীরা যে দাবি করেছেন সেটি সঠিক না বেঠিক সত্য কি না তা যাচাই করতে হবে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে- তারা যাচাই করবে, তথ্য সংগ্রহ করবে ঘটনা সত্য কি না। যদি কেউ অপরাধ করে থাকে তা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রায়-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান ও আস্থা রাখি। বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ২৮ মার্চ মধ্যরাতে বহিরাগত রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আগমন এবং শোডাউনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালার লঙ্ঘন বলে মনে করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর আবরার ফাহাদ হত্যার পর ৯ অক্টোবর বেলা সাড়ে ৩টায় গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেক প্রতিষ্ঠানেই তো সংগঠন করা নিষিদ্ধ আছে। বুয়েট যদি মনে করে তারা সেটি নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। এটি তাদের ওপর। এরই ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট প্রশাসন সব প্রকার সাংগঠনিক রাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করে। শিক্ষার্থীরা বলেন, বুয়েট প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি, এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত বিচার বিভাগে যথাযথভাবে তুলে ধরা হোক। ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি না থাকার যে দাবি তার যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ ও অটল। যেই ছাত্র রাজনীতি র্যাগিং কালচারকে প্রশ্রয় দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দেয়, যার বলি হতে হয় নিরীহ ছাত্রদের তা আমাদের জন্য ভালো কিছু কখনোই বয়ে আনেনি, আনবেও না। এর চরমতম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল ৯৯-এর সাবেকুন্নাহার সনি, যন্ত্রকৌশল ৯-এর আরিফ রায়হান দ্বীপ এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল ১৭-এর আবরার ফাহাদকে হারিয়েছি।

ছাত্র রাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। তারা বলেন, মৌলবাদী শক্তিকেও আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দিতে পারি। দেশ ও বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আমাদের বুয়েটের অ্যালামনাইরাও ইতোমধ্যে আমাদের ক্যাম্পাস ছাত্র রাজনীতিমুক্ত রাখার পক্ষে দৃঢ়ভাবে একাত্মতা পোষণ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজ নিজ জায়গা থেকে তারা আমাদের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করছেন। শিক্ষকদের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ ভরসা ও আস্থা রাখি। তাদের কাছ থেকেই আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি, তারাই আমাদের প্রতিটি ক্লাসরুম প্রতিটি ল্যাবের নায়ক। প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, লেকচারার- যারাই আমাদের ক্লাস নিয়েছেন, আমরা গত চার বছরে শিক্ষার্থীরা এমনটি কখনো অনুভব করিনি যে তারাও চান, আবার ছাত্র রাজনীতি প্রবেশ করে সেই অন্ধকার দিনগুলো ফিরে আসুক। তারা কখনোই আমাদের অকল্যাণ চাননি এবং কখনো চাইবেনও না। তারা সবসময়ই আমাদের সব শিক্ষার্থীর পক্ষেই ছিলেন। আজ এই প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে আমরা বুয়েটের সব শিক্ষকের কাছে আরজি জানাচ্ছি, তারা যাতে এমন সঙ্কটের মুহূর্তে আমাদের পাশে দাঁড়ান। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, আমরা উপাচার্যের ওপর আস্থা পোষণ করি। তার সদিচ্ছা সবসময় আমাদের পক্ষে ছিল বলেই আমরা বিশ্বাস করি। আমরা তার কাছে এই আরজি জানাচ্ছি, আপামর বুয়েট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের যে আকাক্সক্ষা তা সব আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাতে তিনি পূরণ করেন।

সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের বিপরীত অবস্থান বুয়েটের শিক্ষাকার্যক্রম তথা পরিবেশকে ভীতিকর করে তুলেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাদের ওপর সরকার ও ছাত্রলীগ নানা ধরনের চাপ ও হুমকির সৃষ্টি করেছে। ওবায়দুল কাদের এর আগে বুয়েটে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ করেছিলেন। এবার তিনি বললেন, বুয়েটে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে। বুয়েটের ঘটনার তদন্ত চলছে। আমরা খতিয়ে দেখছি। সেখানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে একটি অপরাজনীতি-জঙ্গিবাদের কারখানায় পরিণত করা হবে- এটি যাতে না হয় আমরা তদন্ত করে দেখছি। এরকম কিছু পাওয়া গেলে সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হবে। এ দিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেছেন, বুয়েটে যারা ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে কথা বলে তারা গণতান্ত্রিক শক্তি নয়, এরা সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী শক্তি। দৃশ্যত সরকারের অনুকূলে অবস্থান নেয়া ভিসি প্রফেসর সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেছেন, ছাত্র শিক্ষকরা চাইলে বুয়েটে আবার ছাত্র রাজনীতি শুরু হবে। সাধারণ ছাত্রদের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করেই তিনি সরকারের অনুকূলে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন। মনে হয় বুয়েট দখল না করতে পারলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সিংহাসন নড়ে উঠবে।

একসময়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র রাজনীতি কিভাবে এই কুৎসিত অবস্থায় পৌঁছেছে, বুয়েট শিক্ষার্থীদের বয়ানে তার খানিকটা বর্ণনা আছে। আধা-ঔপনিবেশিক আমলে ছাত্র রাজনীতি অত্যন্ত সম্মানীয় ছিল। তাদের নীতিবোধ ছিল। এখন ছাত্র রাজনীতি অপরাধের রাজনীতির সমরূপ হয়ে উঠেছে। গোটা দেশে ছাত্রলীগ যে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে তা ছাত্র রাজনীতিকে অপাঙ্ক্তেয় করে তুলেছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য এবং প্রশাসনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তারা এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ধর্ষণের মতো কুৎসিত কার্যক্রমে তাদের সংশ্লিষ্টতা বারবার সংবাদপত্রে আসছে। সাধারণ মানুষের কাছে তারা এখন আর কোনো সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ দাবি করতে পারে না। তারা এখন সাধারণ মানুষের কাছে ভীতির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ছাত্র রাজনীতি না করে ‘সরকারি রাজনীতি’ করছে। সরকারে তাদেরকে ক্ষমতা আরোহণের এবং ক্ষমতা সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সরকারের বিরুদ্ধে যখনই কোনো আন্দোলনের সূচনা হচ্ছে তখন তাদেরকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পিছু পিছু অংশ নিতে দেখা যায়। ছাত্র আন্দোলনে তথা ছাত্রদের যেকোনো ন্যায্য দাবি দাওয়া পূরণে যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা অগ্রসরমান তখন ছাত্রলীগ তাদের আক্রমণ করছে। কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলন- সব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছে। তৃতীয়বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আধিপত্যের প্রতিযোগিতার অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রক্ত ঝরছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। কাউকে কোনো কথা বলতে দিচ্ছে না। সংগঠন করতে দিচ্ছে না। এমনকি বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর সাধারণ ছাত্রদের মিছিলেও তারা হামলা করছে। তারা দুর্নীতি ও লুণ্ঠনে এতটাই সুনাম! অর্জন করেছে যে- কোটি কোটি টাকা উপার্জন ও পাচারের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালের ভিসির অভিযোগের কারণে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে।

একসময় ছাত্র রাজনীতির একটি আদর্শিক ভিত্তি ছিল। বাম ঘরানার সংগঠনগুলো পড়ালেখা ও আদর্শের কথা বলত। ইসলামী ঘরানার ছাত্র সংগঠনগুলো নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের কথা বলত। তখনকার ছাত্রলীগ ন্যূনতম সৌজন্য ও সভ্যতা মেনে চলত। আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও স্বীকার করছেন যে, ‘আমাদের দেশের মতো ছাত্র রাজনীতি পৃথিবীর কোথাও নেই। বড় দলগুলোর হাত ধরে এগুলো বিকশিত হচ্ছে। ছাত্রলীগেরও আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক থাকলেও এর নেতারা যথেষ্ট আদর্শবাদী রাজনীতি করতেন, মূল দলের লেজুড়বৃত্তি ছিল না। এখনকার ছাত্র নেতৃত্ব তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য হারিয়েছে’। আদর্শিক ছাত্র রাজনীতির স্পেসও খুবই সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে। এক দিকে লোভ লালসা ও ক্ষমতার মোহ ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করছে। অন্য দিকে এসব নেতিবাচক কারণে সাধারণ ছাত্ররা ছাত্র আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। রাজনীতিতে যেমন নিস্পৃহবাদ দেখা দিয়েছে, সেই প্রভাব পড়েছে ছাত্র রাজনীতিতে। ছাত্র সংগঠনগুলো এখন ছাত্রদের কল্যাণের কথা বলে না; বরং রাজনীতিকদের এজেন্সির কথা বলে। এ অবস্থায় বিবেকবান মানুষ ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলছেন।

১৯৯১ সালের দিকে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলেছিলেন। দুই নেত্রী রাজি না হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। উভয় দলেই ছাত্র রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ২০২২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ বুয়েট স্টাইলে দখল শুরু করলে কর্তৃপক্ষ তা রুখে দেয়। সেই সময় আবারো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা আসে। এখন এই সময়ে ভাববার সময় এসেছে যে, একটি স্বাধীন দেশে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আছে কি না। ঔপনিবেশিক আমলে ও পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা অনিবার্য ছিল। এখন ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তার কথা যা বলা হয় তা রাজনৈতিক। আদর্শিক লক্ষ্যের কথা যা হয় তাও আপেক্ষিক। তবে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নীতিবোধের দীক্ষা নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি নিয়ে শিক্ষক সমাজ ও সিভিল সোসাইটির আবার ভাবা উচিত। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা যে উপলব্ধি থেকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বলছে তা সর্বত্র।

শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যদি গ্যাংগ্রিন হয়-ক্যান্সার হয় তা কেটে ফেলতে হয়। সেরূপ ছাত্র রাজনীতি সাময়িকভাবে হলেও নিষিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। অনেক মতলববাজ লোক বড় বড় কথা বলে বড় ক্ষতি করছেন শিক্ষাঙ্গনের। কোনো কোনো শিক্ষাবিদ সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু আমার মনে হয় সংস্কারের বা মলম লাগানোর অবস্থায় আমরা আর নেই। কঠিন ও কঠোর সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে এ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবে ক্ষমতাসীন দল ও গোষ্ঠীদের দিয়ে ভালো কিছু চিন্তা করা অসম্ভব। যাদের দেশপ্রেম নেই, শিক্ষা নেই, দীক্ষা নেই- আছে শুধু ক্ষমতার মোহ তাদের কর্তৃত্বের সীমা অতিক্রম করতে না পারলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ যেমন অনিশ্চিত তেমনি অনিশ্চিত দেশের ভবিষ্যৎ। মনীষী প্লেটোর ভাষায় সম্ভবত তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে ‘এবার তারা দম্ভ, অনাচার, অমিতব্যয় ও নির্লজ্জতাকে মশাল শোভাযাত্রাসহকারে পুষ্পমাল্যে ভূষিত করে এবং প্রশংসার মধুর বাণী উচ্চারণ করে বরণ করে এনে আত্মশূন্য ঘরে তাদের প্রতিষ্ঠা করে। তারা ঔদ্ধত্যকে অভিহিত করে আভিজাত্য বলে, অরাজকতাকে বলে স্বাধীনতা এবং অপব্যয়কে মহানুভবতা, আর মূর্খতাকে বলে বিক্রম।’ (রিপাবলিক : ৮ : ৫৬০)

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement