০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাজল কিরে ভোরের সানাই

বাজল কিরে ভোরের সানাই - নয়া দিগন্ত

শৈশবে ভোরে ঘুম ভাঙত আব্বার
দরাজ গলায় জাতীয় কবির লেখা গানের আওয়াজে-
‘বাজলো কিরে ভোরের সানাই
নিদ মহলার আঁধার পুরে, শুনছি আজান গগনতলে
অতীত রাতের মিনার চূড়ে।’
আব্বা এর তাৎপর্য বুঝতেন কি না জানি না। পরিবারের সবার ঘুম ভাঙিয়ে নামাজের জন্য প্রস্তুত করার, নতুন দিনের কাজের কথা স্মরণ করার তার আন্তরিক চেষ্টার কথা মনে পড়লে চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ফজরের জামাতে নামাজ পড়ানোর তার যে ঐকান্তিক চেষ্টা তার ধারেকাছে যাওয়ার চেষ্টা আমাদের বেশির ভাগের নেই।

শৈশবে আব্বার গলায় এ গান উপভোগ করতাম, আনন্দ পেতাম, তাৎপর্য বুঝতাম না। জাতিকে জাগানোর জন্য, অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার মুক্ত আলো বাতাসে নতুন সম্ভাবনা বরণ করার এ ডাক জাগরণের, নিজেকে নতুন করে চেনার এই কালজয়ী আহ্বান ছিল জাতীয় কবির। অতীতের ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন দিনের নতুন ভবিষ্যতের সম্ভাবনার স্বপ্ন জাগানিয়া এ আহ্বান।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর জেলা শহরে পাড়ি দেয়া। ছোট্ট ছিমছাম দিনাজপুর জেলা শহর। হাতেগোনা কয়েকটি মহুল্লা বা পাড়া। এ পাড়া ও পাড়ার সব ছেলেমেয়ে বিকেলে খেলার মাঠে। এ সময় আমার সংশ্লিষ্টতা হয় ছোটমনিদের সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’-এর সাথে। কেন্দ্রীয় পরিচালক ছিলেন সারা দেশে সবার পরিচিত প্রিয় মুখ দাদা ভাই। মুকুল ফৌজের সাধারণ মুকুল সেনাদের ইউনিট পরিচালক সেনা ভাইয়ে উত্তরণ ঘটতে আমার বেশি দেরি হয়নি। মুকুল ফৌজের কার্যক্রম বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরত এবং সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। তখন জাতীয়ভাবে দেশের সর্বত্র পালিত হতো পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। এ দিন জেলা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিশু সংগঠন, বয়স্কাউট, গার্লস গাইড এসবের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ হতো দিনাজপুর বড় ময়দানে (যা এখন গোরা শহীদ ময়দান হিসেবে পরিচিত)। এ দিন মুকুল ফৌজের বিশেষ পরিবেশনা ছিল প্রভাত ফেরি। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রাস্তা হয়ে ঠিক সময়ে ফেরি শেষ করতে হতো। নইলে সকাল ৮টার কুচকাওয়াজে যোগ দেয়া হতো না। ভোর ৪টা থেকে প্রতিটি মুকুল সেনার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা, সবাইকে একত্র করা এবং আজানের পরপর ফেরি শুরু করা এ এক অপূর্ব দৃশ্য ছিল। ড্রাম বাজিয়ে সবাই এক তালে এক সুরে প্রভাত ফেরির গান গাইতে গাইতে নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে আবার নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরে আসা সূর্য ওঠার আগে। কষ্টসাধ্য হলেও আনন্দ ও উদ্যমের অভাব ছিল না। এত ভোরে প্রভাত ফেরি করার উদ্দেশ্য ছিল ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলা।
মুকুল ফৌজের প্রভাত ফেরি সঙ্গীত ছিল-

‘ওরে নতুন যুগের ভোরে/ দিসনে সময় কাটিয়ে বৃথা/ সময় বিচার করে।’
দুটো গানের মৌলিক প্রেক্ষিত ঘুমের অলসতা ছেড়ে নতুন ভোরের নতুন দিনের নতুন সময়কে আলিঙ্গন করা; নতুন উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া।

এখন ভোরের আজান শোনা যায় কিন্তু ঘুমের ঘোর কাটে না জনপদের, জাতির। ভোরের সানাই এখন মাথাকুটে মরে অসহায় ব্যর্থতায়। এখন আর প্রভাত ফেরির ঘুম ভাঙানিয়া সুর জনপদকে জাগায় না; নতুন দিনকে নতুন সময়কে বরণ করার ডাক এখন শোনা যায় না। পরিবর্তে আমরা, আমাদের উত্তর প্রজন্ম এখন ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে গগনবিদারি উল্লাসে মেতে উঠি। অহেতুক এ আনন্দে আর্তনাদ করে ওঠে ঘুমন্ত শিশু, বয়স্ক, অসুস্থরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ উল্লাসের কোনো সৃষ্টি চেতনা নেই। নেই গত বছরের সালতামামির আলোকে নতুন বছরের কর্ম পরিকল্পনার যোগ। অথচ আমরা অত্যন্ত আনন্দে উচ্ছ্বাসে আবেগে ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পালন করছি আমাদের জীবনাচারের সাথে সম্পর্কহীন এক উদ্যোগকে। ৩১ চৈত্রের মাঝরাতে আমরা তো এমন উদ্বেলিত হই না। এ ধরনের কোনো আনন্দ আবেগে আমরা তো আপ্লুত হই না।

উপরে যে দু’টি প্রসঙ্গ ছিল তা নতুন সম্ভাবনা, নতুন সময়কে বরণ করে নেয়ার আহ্বান। এবার দেখা যাক এবারের ইংরেজি নববর্ষ সূচনালগ্নের কথায়। কর্তৃপক্ষের সাবধানবাণী উচ্চারণ সত্ত্বেও রাত ১১-৩০ থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকা ছিল শব্দ দূষণের নগরী। এর সবচেয়ে উত্তুঙ্গ মুহূর্ত ছিল রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। এ সময় ঢাকার শব্দদূষণ স্বাভাবিকের চেয়ে ৪২ শতাংশ বেশি ছিল। শব্দমাত্রা ছিল ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবেল। সাধারণত ৭০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা মানুষ এবং পশুর চিরস্থায়ী বধিরতা ছাড়াও গর্ভপাত, শিশুমৃত্যু ও বয়স্কদের হৃদরোগের কারণ হতে পারে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ঢাকা মহানগর এলাকায় শব্দদূষণ সম্পর্কিত ২৩৭টি অভিযোগ জরুরি সেবা বিভাগ ৯৯৯ পেয়েছে। এগুলো বিভিন্ন জায়গায় লাউডস্পিকার ব্যবহার করে স্থানীয় নাগরিকদের স্বাভাবিক রাতের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। অসুস্থ এবং শিশুদের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এ দিন একদিকে শব্দদূষণ, অন্যদিকে, বায়ুদূষণের কবলে পড়েছিল ঢাকা মহানগরী। বায়ুদূষণের কারণ বায়ুতে পটাশিয়াম পারক্লোরেট, বিষাক্ত বেরিয়াম নাইট্রেট, পার্লাইট পাউডার, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, মাটি ও পাথরের কণার উপস্থিতি। যা আতশবাজি বা পটকা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বায়ুর মধ্যে এ দূষিত পদার্থগুলোর উপস্থিতিতে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিসসহ রোগীদের যন্ত্রণা বেড়ে যায়। শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ পরিবেশ দূষণের দুটো প্রধান দিক, পরিবেশ অধিদফতর এ ব্যাপারে এ দিন সচেতন ছিল কি না বোঝা যায়নি।

বর্ষবরণের দুটো পরিপ্রেক্ষিত আমাদের সামনে আছে। আমরা কোন পথে যাবো? নতুন দিনের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশ গড়ার পথে; নাকি শব্দদূষণ বায়ুদূষণের মাধ্যমে জনজীবন বিপর্যস্ত করে আমাদের জীবনের সাথে খাপ খায় না এমন জীবনাচারের স্রোতধারায়? জাতীয় রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী, সংস্কৃতিসেবীদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা দরকার। সতর্ক হওয়া দরকার অভিভাবক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং পরিবেশ অধিদফতরের। প্রয়োজনে শহরের নির্দিষ্ট কোনো স্থান নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে, যেন শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ সর্বত্র ছড়িয়ে না যায়।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement