১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইবরাহিম

জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইবরাহিম - ফাইল ছবি

সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়ানো কোভিড-১৯ নামের যে মহামারী তা নিয়ন্ত্রণ নিরাময়ে দেশে দেশে যে পদ্ধতি প্রক্রিয়ার অনুশীলন ছিল; তাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা দক্ষতার দুর্বল দিকগুলো বেরিয়ে আসছিল। প্রকৃতপ্রস্তাবে যে দেশ ও সমাজে সীমাহীন সার্বিক (অর্থনৈতিক, চিন্তা-চেতনার, সহনশীলতার, সাধনার) দারিদ্র্যের কারণে বড় কিছু করা যায় না, মহৎ কিছু গড়ে ওঠে না এবং যেখানে চিন্তার দৈন্যতা, উদ্যম উদ্যোগের অভাব এবং ত্যাগ স্বীকারের অনীহা অন্যতম প্রতিবন্ধকতা; সে দেশে জাতীয় অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ ইবরাহিম (১৯১১-১৯৮৯) প্রমাণ করে দিয়েছেন- উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, লক্ষ্য যদি স্থির থাকে, প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, তবে স্বল্পোন্নত দেশেও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি তথা বারডেমের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়।

গত ৬ সেপ্টেম্বর ছিল এই মহৎপ্রাণ মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসা কার্যক্রমকে তিনি সেবার আদর্শে উদ্ভাসিত করেছিলেন, সেই স্মরণে দিনটি ডায়াবেটিস সেবা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৫৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত ডায়াবেটিস চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রথম বছরে মাত্র ৩৯ রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছিল। সেখানে এখন শুধু বারডেমই চিকিৎসাধীন নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছাকাছি। শুধু ঢাকা শহর ও এর উপকণ্ঠে নয়, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ডায়াবেটিস চিকিৎসাকেন্দ্র এখন দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে।

উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সততা থাকলে অঙ্কুর কি করে মহা মহিরুহের রূপ লাভ করতে পারে, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠান শাহবাগের বারডেম এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বারডেম এখন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বিস্ময়করভাবে সমাদৃত, এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এর একটি সহযোগী কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন বাংলাদেশের ডায়াবেটিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক চিকিৎসার মডেল বা অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য করে। ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার সাথে আমেরিকার জসলিন, ইংল্যান্ডের লরেন্স ও বাংলাদেশের ইবরাহিমের নাম জড়িয়ে রয়েছে।

রোগীর পরীক্ষা ও রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তার ইবরাহিম ছিলেন নৈপুণ্য ও সূক্ষ্মতার প্রতি অচঞ্চল; এর মধ্যে তিনি তার শিক্ষার্থী সহকর্মীদের শিখিয়ে ও বুঝিয়ে দিতেন রোগীর রোগ পরীক্ষণ ও নির্ণয় বিষয়টি কত নিখুঁত ও সূক্ষ্ম হওয়া উচিত এবং তিনি কিভাবে তা চান। তিনি ছিলেন একজন হাতে-কলমে শিক্ষাদাতা এবং একাধারে তার চিকিৎসা দর্শনের মর্মসাধক। ‘আমি নিজে একটি কথা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি এবং আমার সহকর্মীদের কথাটি আমি সবসময় বলি যে, আমরা জনগণের খাদেম, এ মনোভাব নিয়ে সেবা করব; তাদের প্রভু- এ মানসিকতা নিয়ে নয়। কারণ নিজেকে খাদেম মনে করলে সেবাটি আন্তরিক হয়, মনের মধ্যে বিনয় আসে আর মানুষের প্রতি একটি মানবিক সহমর্মিতা জেগে ওঠে। আর একটি কথা আমাদের ভুললে চলবে না, তা হলো আমাদের এই জনগণ হলো স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জনগণ। এরা ১৯৪৭ সালের আগের ব্রিটিশদের গোলাম জনগণ নয়। এরা ১৯৭১ সালের আগের জনগণ নয়। যখন এ দেশকে বলা হতো কলোনি। এরা স্বাধীন সার্বভৈৗম একটি দেশের জনগণ।’

ডা: ইবরাহিম চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘ইম্পেথি’ শব্দটির ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করতেন। ইংরেজি ‘ইম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বীয় সত্তা অন্যের সত্তায় বিলীন করে দিয়ে, অন্যের শোক, দুঃখ ও ব্যথার অভিজ্ঞতা কল্পনায় নিজে অনুভব করার শক্তি। আর ‘সিম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের শোক-দুঃখের সাথে সমবেদনা বা সমব্যথিত হওয়া। অন্যের শোক, দুঃখ ও অন্যান্য অভিজ্ঞতা মনে না করলে যেমন দুঃখী বা আর্তপীড়িতের গভীরে যাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনি তিনি তার প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী সব ডাক্তার, সেবাকর্মী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সব সময়ে বলতেন ‘ইম্পেথি’ শব্দটির অন্তনির্হিত ভাব নিজের মনে প্রতিফলিত করে সেবা দানে মনোনিবেশ করতে। এরূপ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যখন কোনো সেবাদানকারী কোনো আর্তপীড়িতের সেবায় নিজেকে নিয়োগ করবেন ওই সেবাদানকারী আর্তপীড়িতের সত্তার সাথে বিলীন হতে পারবেন। তার সেবাদান তখন পূর্ণাঙ্গ হবে । এভাবে কোনো সেবাদানকারী সেবা গ্রহণকারীর গভীরে প্রবেশ করতে পারবেন, আর যখন সেবাদানকারী মনে করবেন আমি যদি এই আর্তপীড়িত লোকটির মতো হতাম, যে আমার কাছে তার আর্তপীড়ার উপশম চাইতে আসছেন এবং আর্তপীড়িতটি যদি আমার জায়গায় হতেন, যার কাছ থেকে আমি পীড়িত হয়ে সেবা গ্রহণ করতে এসেছি। এই মানবীয় গুণ আয়ত্ত করতে সবাইকে সব সময় অনুপ্রাণিত করতে তিনি বলতেন : ‘আপনাদের সেবা করতে আমাদের সুযোগ দেয়ার জন্য আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ রোগীদের সেবা প্রদানকারীর এরূপ ধারণা থাকা উচিত যে, তারা বিনা পয়সায় সেবা গ্রহণ করতে এসেছেন এবং এর জন্য তাদের সেবা প্রদানকারীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার চেতনাবোধ থাকতে হবে। পক্ষান্তরে ডা: ইবরাহিম তার সেবাদানকারী সহকর্মীদের বলতেন, তারা যেন রোগীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এ জন্য যে, তারা (রোগীরা) এখানে আমাদের সেবা গ্রহণ করতে এসেছেন এবং তারা না এলে আমাদের কাজ থাকত না।

ডা: মোহাম্মদ ইবরাহিম ডায়াবেটিক রোগীর পুনর্বাসনের বিষয়ে তার চিন্তা-ভাবনাকে জাগ্রত রেখেছিলেন। তিনি জুরাইনে নিজের পারিবারিক সম্পত্তি সমিতিকে দান করে সেখানে ডায়াবেটিক রোগীদের পুনর্বাসন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেন। ডায়াবেটিক রোগীরা যাতে সংসারে ও সমাজে বোঝা হয়ে না দাঁড়ান-কর্মজীবনে অকেজো না হয়ে পড়েন সে জন্য তাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগী তাদের সংসারের এবং সমাজের যাতে বোঝা হয়ে না দাঁড়াতে হয় সে জন্য সমিতির সিডিআইসি প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে ২০-২১ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের বিনামূল্যে ইনসুলিন সরবরাহসহ মানসিক, শারীরিক বিকাশে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে।

নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপসহীন প্রফেসর ইবরাহিম মনে করতেন, ডাক্তারের প্রতি রোগীর আস্থা একটি বড় অনুষঙ্গ। ডাক্তার ইবরাহিম John Ruskin (8 February 1819-20 January 1900)-এর অর্থনৈতিক দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধাবলি Unto This Last (1860) বইটির ছাঁচে তার সেবাদর্শন স্থির করেছিলেন এবং সেভাবে পুরো কর্মজীবন গড়ে নিয়েছিলেন, যে বইয়ে রাসকিন দেখিয়েছেন ‘অর্থ ও বিত্ত মানুষের সত্যিকারের মূল্যায়ন করে না, মানুষের মূল্যায়ন হয় অন্য মানুষের তার ওপর আস্থার ভিত্তিতে।’

১৯৫৬ সালে মাত্র ২৩ রোগী নিয়ে সেগুনবাগিচার টিনশেডে অধ্যাপক মোহাম্মদ ইবরাহিম যখন ডায়াবেটিক চিকিৎসা শুরু করেন; তখন থেকে রোগীর ওপর পরিচালিত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় লব্ধ প্রাইমারি ডাটা সোর্সকে গবেষণার উৎকৃষ্ট উপাদান বিবেচনার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। সে সময় পরীক্ষার জন্য রোগীর সন্ধানে নামতে হতো তাকে। রাস্তায় চলার পথে কোনো রোগাক্রান্ত অসহায় অসুস্থ মানুষ ভিখারি বেশে বসে থাকলে তাকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতেন, তাকে খাইয়ে দাইয়ে ভালো পোশাক-আশাক পরিয়ে উৎফুল্ল করে তারপর তার থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করতেন। সেই পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে তার গবেষণা এগিয়ে চলত। বিলেতের বিখ্যাত বিদ্যায়তনে অধ্যয়ন ও বড় বড় হাসপাতালে চাকরি সূত্রে অর্জিত অভিজ্ঞানের আলোকে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন বিশ্লেষণ এবং উপসংহারে পর্যবেক্ষণ প্রক্ষেপণের মেথডোলজি অনুসরণ করতেন তিনি। তার প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধগুলোতে বাস্তব অনুসন্ধান উৎসারিত পরিসংখ্যান তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণের উপান্তে এসে একটি পরিশীলন পর্যায়ে পৌঁছাত। আধুনিক গবেষণা রীতিতে-ডাটা বিশ্লেষণ এবং একটি রেশনাল কনক্লুশানে উপনীত হতেন। তার ভিত্তিতে টেকসই ও লাগসই চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পথে যেতেন। এসব দেখে বোঝা যেত তিনি একাধারে সফল ক্লিনিশিয়ান যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন খ্যাতনামা চিকিৎসক, শিক্ষক, হাসপাতাল প্রশাসক, সমাজ সংগঠক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, গবেষক শুধু গবেষণায়, ক্লিনিশিয়ান কেবল ক্লিনিক্যাল চিকিৎসায়, আবার সমাজসংগঠক শুধু তার এলাকাতে সীমাবদ্ধ ও নিবেদিত।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির কাউন্সিল সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
শিগগিরই মাগুরায় রেললাইন চালু হবে : রেলমন্ত্রী সংসদ ভবনের সামনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগকর্মী নিহত জুজুৎসুর সম্পাদকের যৌন নিপীড়নের তথ্য দিলো র্যা ব পানচাষীদের পরিশ্রমের ফসল জিআই স্বীকৃতি : প্রতিমন্ত্রী বগুড়ায় অবৈধ মজুদকৃত ১ লাখ ডিম উদ্ধার তথ্যের জন্য সাংবাদিকরা শতবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেতে পারেন : ডেপুটি গভর্নর ইসরাইলি হামলায় ৪০ ফিলিস্তিনি নিহত আফগানিস্তানে গুলিতে ৩ স্প্যানিশ ও ৩ আফগান নিহত বিভিন্ন অপরাধে সাতজনের ফাঁসি কার্যকর করল ইরান কিরগিস্তানে আতঙ্কে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা ‘প্রাচীন হিব্রুদের সাথে ইসরাইলি ইহুদিদের জেনেটিক সংযোগ নেই’

সকল