০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুশাসন

প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন ও গণতন্ত্র

প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন ও গণতন্ত্র - প্রতীকী ছবি

আমাদের চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম একটি হচ্ছে গণতন্ত্র। সংবিধান প্রণয়ন অবধি এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংবিধানে ১৬টি সংশোধনী আনা হলেও এ মূলনীতিটি কখনো কোনো সংশোধনীর আওতায় আসেনি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয় এমন সব দেশে গণতন্ত্র বলতে যা বুঝায় তা হলো- প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাভুটির ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতিফলনে সরকার গঠন। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে একজন ভোটার ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে স্বীয় বুদ্ধি ও বিবেকে তাড়িত হন। এ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ গোপন ব্যালটের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় একজন ভোটার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগুলোর মধ্যে কাকে ভোট দিলেন এটি তার একান্ত গোপনীয় বিষয় এবং তিনি ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করতে চাইলে তা আইনে সুরক্ষিত।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একজন ভোটার সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থী নির্বাচনে ভোট প্রদানে যে স্বাধীনতা ভোগ করে তার দ্বারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যও সংসদে আইন প্রণয়নসহ অপর যেকোনো বিষয়ে ভোট প্রদানে একই স্বাধীনতা ভোগ করে। সচরাচর একজন সংসদ সদস্য ভোট প্রদানে নিজ দলের পক্ষাবলম্বন করে থাকলেও নিজ দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান আইনে বারিত নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো আমাদের বাংলাদেশের সংবিধান।

আমাদের সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোটদানের কারণে আসন শূন্য হওয়া-বিষয়ক। এ অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি- ক. ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন, অথবা খ. সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে, তবে তিনি সে কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন না।

আমাদের সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদটি একজন সংসদ সদস্যের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত। এটি গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। নাগরিক হিসেবে একজন ভোটার ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা ভোগ করেন সে একই ভোটার সংসদে ভোটদানের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবেন না তা কোনোভাবেই গণতন্ত্র চর্চা ও বিকাশে সহায়ক নয়। তা ছাড়া দলের অগণতান্ত্রিক আচরণে সংক্ষুব্ধ বা ব্যথিত হয়ে দল থেকে পদত্যাগ করলে সংসদ সদস্য পদ হারাতে হবে এটি তো গণতন্ত্রের অনুশীলন নয়। একজন সংসদ সদস্যের নির্বাচনে বিজয়ের ক্ষেত্রে দলের অবদান ও নিজের যোগ্যতা উভয়টিই বিবেচ্য। সুতরাং দল থেকে পদত্যাগের কারণে সংসদে আসন শূন্য হওয়া একজন সংসদ সদস্যের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখার নামান্তর। এর পরও কথা থাকে, যে দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম একটি মূলনীতি হলো গণতন্ত্র সে দেশে কী করে একজন সংসদ সদস্যের স্বাধীনভাবে ভোট প্রদান বা মতপ্রকাশের অধিকার হরণের পরও দাবি করার অবকাশ থাকে- গণতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।

দশম সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এ যে বিধানাবলি রয়েছে তাতে বলা হয়েছে, যখন মনোনয়নপত্র বাছাই পরবর্তী দেখা যায়, একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনের জন্য শুধু একজন বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থী রয়েছেন অথবা যখন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে শুধু একজন অবশিষ্ট থাকে, তখন রিটার্নিং অফিসার গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ওইরূপ প্রার্থীকে নির্বাচনী এলাকা থেকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন এবং নির্বাচন কমিশনের বরাবরে তদমর্মে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবেন। অতঃপর নির্বাচন কমিশন সে মোতাবেক বিজয়ী প্রার্থীদের গেজেট বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করবে।

এ সামগ্রিক পর্বটি আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণের আগেই সমাপ্ত হয়। যদিও এ ধরনের নির্বাচন বেআইনি নয় তবে নৈতিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য। অতীত সংসদ নির্বাচনগুলোর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সংক্রান্ত ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচন ও বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১ জন করে প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতঃপর ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের সময় এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ১৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বশেষ বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে ৪৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তা ছাড়া ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নবম সংসদ নির্বাচনে ১৭ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ নির্বাচনটির কার্যক্রম চলাকালীন বিএনপি ক্ষমতাসীন ছিল, যদিও আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণ পর্বের আগে এ নির্বাচনটি বাতিল হওয়ায় এটিকে সংসদ নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ নেই। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদের কোনোটিই নির্ধারিত পাঁচ বছর পূর্ণ করতে পারেনি।

সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ৩০০ জন প্রার্থী ৩০০টি পৃথক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। তা ছাড়া কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম সংসদ নির্বাচন ও ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচন ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ায় এ সব নির্বাচনের কোনোটিতেই কোনো প্রার্থীর কোনো নির্বাচনী এলাকা থেকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হয়নি।

দশম সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৪ জন প্রার্থীর সবাই তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের সাথে সম্পৃক্ত দলগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত। এ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৪ জনের দলগত যে অবস্থান তা হলো- আওয়ামী লীগ-১২৭, জাতীয় পার্টি (এরশাদ/রওশন)-২১, জাসদ (ইনু)-তিন, ওয়ার্কার্স পার্টি-দুই ও জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)-এক।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসের দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৪টি আসনে বিভিন্ন দলের একক প্রার্থীর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেয়া বিভিন্ন দলের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতেই এটি হয়েছে। বিএনপি সর্বদলীয় সরকারে এলে তাদের সাথে এমন সমঝোতা করতাম। এ বিষয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা বলেন, এভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে সংসদে আসন সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি আসনে যদি প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন সে ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এ নির্বাচনটিকে কি গণতান্ত্রিক বলা যায়? তারা আরো বলেন, এভাবে সমঝোতার মাধ্যমে প্রার্থিতা প্রত্যাহারপূর্বক একক প্রার্থী হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিচায়ক নয়। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা যখন জানতে পারলেন তাদের নির্বাচনী এলাকা থেকে একক প্রার্থী হিসেবে একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তখন তাদের অনেককে আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেছে- এরা কেউই আমাদের ভোটে নির্বাচিত নন। তাই কী করে বলি, তারা আমাদের সংসদ সদস্য। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের অভিমত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত অনেকেই পুলিশ প্রহরা ব্যতিরেকে নির্বাচনী এলাকায় গেলে জনগণের হাতে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার উপক্রম হতে পারে।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জনের নির্বাচন-পরবর্তী যে ১৪৬টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এ সব আসনেও প্রার্থীর সংখ্যা ও সমঝোতার ভিত্তিতে যে সব প্রার্থীকে নির্বাচিত করে আনা হয়েছিল তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী অপরাপর প্রার্থীর কার্যকলাপ অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, এ সব আসনের নির্বাচন নেহায়েত লোকদেখানো ও পাতানো ছিল। আর তাই কোনো অবস্থায়ই এ সব আসনের নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন বলার সুযোগ নেই। একাদশ সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণের নির্ধারিত তারিখের পূর্ববর্তী রাতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় সম্পন্ন করায় যেকোনো মানদণ্ডের বিচারে এটিকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলার অবকাশ আছে কি!

আন্তর্জাতিকভাবে জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে যে নীতি অনুসৃত হয় তা হলো- যেকোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য মর্মে বিবেচিত হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণের আবশ্যকতা রয়েছে, যথা- ক. নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে হবে; খ. নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হতে হবে এবং গ. সর্বশেষ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে। দশম সংসদ নির্বাচনের সার্বিক কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, এ তিনটি শর্তের কোনোটিই পূরণ হওয়ার মতো পরিস্থিতি বিদ্যমান নেই। তাই এ নির্বাচনটি আন্তর্জাতিকভাবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে যে স্বীকৃত হবে না সেটি ঘটনাপ্রবাহ দৃষ্টে স্পষ্ট।

দশম সংসদ নির্বাচনে এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি আদৌ অংশগ্রহণ করেছিল কি না তা স্পষ্ট নয়। আর অংশগ্রহণ করে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, তার দল সর্বদলীয় সরকারের অংশ হয়ে থাকলে এবং তার দলের প্রার্থীদের সমঝোতার ভিত্তিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়ে থাকলে এ দলটিকে কি বিরোধী দল বলার সুযোগ আছে? সুতরাং দশম সংসদ নির্বাচনের পর সংসদ অধিবেশন বসার অবকাশ সৃষ্টি হলেও সে সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল ছিল না এ বিষয়টি স্পষ্ট।

যেকোনো দেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং সত্যিকার অর্থে গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা অবলোকন করে থাকেন। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দেশীয় পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠক করে নিজেদের নিরাপত্তা বিঘিত হবে এ আশঙ্কায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখার সিদ্ধান্ত কমিশনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। দেশীয় পর্যবেক্ষকরা যখন নিরাপত্তার আশঙ্কায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অনীহ তখন বিদেশী পর্যবেক্ষকরা যে পর্যবেক্ষণে আসবেন এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ ছিল কি!

এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সঙ্ঘাতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাসহ অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট ও শারীরিকভাবে আঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বিধায় এর প্রতিবিধানে নির্বাচন কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে- দেশের জনগণ এমনটিই প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সঙ্ঘাত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এবং সঙ্ঘাতের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির দায় নির্বাচন কমিশন নেবে না। নির্বাচন কমিশনের এহেন বক্তব্যে দেশবাসী হতভম্ব ও বিস্মিত। দেশবাসীর অভিমত- সঙ্ঘাত নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বিধায় এর মাধ্যমে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির দায় নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আর আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশনের উচিত সরকারকে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন কি সরকারকে সে ধরনের কোনো নির্দেশনা আদৌ দিয়েছিল?

বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানি ও রফতানিনির্ভর। নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সঙ্ঘাত ও সহিংসতা অভ্যন্তরীণ শিল্প ও কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছিল। অবরোধের কারণে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনসহ আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে বিঘœ ঘটছিল। এ ধরনের অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকায় তা দেশের ভবিষ্যৎকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।

সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক ভোটপর্ব হয়েছে কি হয়নি সে বিতর্কে না গেলেও নির্বাচনটি যে সাজানো ও পাতানো এবং সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকলেও তারা যে সমঝোতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীর আকাক্সক্ষায় তথাকথিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছিল সে বিষয়ে দেশের সচেতন ও বিবেকবান মানুষের মধ্যে কোনো সংশয় নেই। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন হলেও সে সংসদ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আইনটি পাসপূর্বক অবলুপ্ত হয়েছিল।

দশম জাতীয় সংসদের কাছে চিরস্থায়ীভাবে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কী হবে এমন প্রশ্নের সুরাহা যদি পাওয়া যেত সে ক্ষেত্রে হয়তো দশম সংসদ নিয়ন্ত্রণকারী আওয়ামী লীগ ক্রমনিমজ্জমান গণতন্ত্রের উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা রেখে নিজের অপবাদ লাঘবের কিছুটা হলেও সুযোগ পেত। অন্যথায় গণতন্ত্রের মুখে কালিমা লেপনকারী প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন সাজানো ও পাতানো নির্বাচনটি যে আওয়ামী লীগসহ নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট দলগুলোর বিপর্যয়ের অশনিসঙ্কেতের আগমন বার্তা তা অতীত ঘটনা অবলোকনে স্পষ্ট প্রতিভাত। একাদশ সংসদ নির্বাচনটিও আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণের তারিখের আগের রাতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় সম্পন্ন করায় সেটিও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ছিল, এটি আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement