০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হলে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়

নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হলে গণতন্ত্র ব্যাহত হয় - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী কখনো সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা আবার কখনো রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় শাসিত হয়েছে; তবে বছরের হিসেবে দীর্ঘ সময় সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বহাল ছিল যা এখনো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশে এ যাবৎকাল জাতীয় সংসদের ১১টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনগুলোর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ সাতটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অপর দিকে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম চারটি নির্বাচনের মধ্যে প্রথম ও শেষোক্তটি অস্থায়ী ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হয়েছিল পক্ষান্তরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে অব্যবহিত পূর্ববর্তী দল পরাভূত হয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম সংসদের সাধারণ নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল ছিল। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রযুক্ত হয়। এ কারণে সংসদের গুরুত্ব তেমন একটা অনুভূত হয় না। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনটি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল থাকাকালীন অনুষ্ঠিত হলেও সে সময়কার রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন কর্মরত প্রধান বিচারপতি। শুধু সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তখন তাকে অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনকালীন যারা রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন নির্বাচনে তাদের দল বিজয়ী হয়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ নির্বাচনে উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে বিজয়ী হয়। ওই নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য ১৬২টি আসন নির্ধারিত ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও দলটির কাছে পাকিস্তানের শাসনভার হস্তান্তর করা হয়নি। এর ফলে পরবর্তীতে বাঙালিদের রাজনৈতিক লড়াই স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটায়।

পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পূর্ব-পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী দল আওয়ামী লীগ পশ্চিম-পাকিস্তানে কোনো আসন পায়নি। অনুরূপভাবে পশ্চিম-পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পূর্ব-পাকিস্তানে কোনো আসন পায়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় লাভকারী আওয়ামী লীগকে পাকিস্তান শাসনের দায়িত্ব দেয়া হলে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ না ঘটে হয়তো শিথিল কনফেডারেশন হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আরো কিছুকাল টিকে থাকত কি না সে প্রশ্ন থেকে যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা না পাওয়ার পিছনে সামরিক শাসকদের চেয়ে নেপথ্যে তৎকালীন পশ্চিম-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন। ভুট্টো চেয়েছিলেন পশ্চিম-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পশ্চিম-পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা তার ওপর ন্যস্ত হোক। আর পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে এখানকার শাসনক্ষমতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ন্যস্ত হোক।

১৯৪৭ সালের ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভাজিত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হলেও ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ধর্মীয় জাতিসত্তার চেয়ে জাতিগত জাতিসত্তার বিষয়টি মুখ্য ছিল। এ কারণে একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম-পাকিস্তানে যেমন পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ কোনো আসন পায়নি; ঠিক তেমনি পশ্চিম-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপিপিও পূর্ব-পাকিস্তানে কোনো আসনে বিজয়ী হয়নি। পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোয় অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের নিরপেক্ষতা তেমনভাবে ক্ষুণ্ন না হলেও সে নির্বাচনের ফলকে কার্যকর হতে না দেয়ায় গণতন্ত্র ব্যাহত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির বিভাজন ঘটেছিল।

বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। সে সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন। এ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৩টিতে বিজয়ী হয়। তৎকালীন বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে ৭টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। যদিও তখনকার নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ওই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে জাসদের প্রার্থীরা আরো আসনে জয়ী হতেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিজয়-পরবর্তী সরকার গঠনের এক বছরের কিছুকাল পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে কী কারণে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার রূপান্তর ঘটালেন এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করলেন এর পিছনের উদ্দেশ্য বিষয়ে দেশবাসী এখনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। একদলীয় শাসনব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভিতমূলে যে আঘাত হানা হয়েছিল তার জন্য আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হয়।

বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা না হলে ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনার অবকাশ সৃষ্টি হতো কি-না সে বিষয়ে বিতর্কের চেয়ে ঘটনাটি না ঘটার সম্ভাবনা যে বেশি ছিল এটি অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনার পেছনের কলকাঠি যারা নেড়েছিলেন তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ক্ষণকাল ক্ষমতায় থাকার পর ওই শাসকগোষ্ঠীকে বিদায় নিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব অনেকটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু-পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় গণভোটের মাধ্যমে তার রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার বিষয়টির নিষ্পত্তিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তা ছাড়া তার শাসনকালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে তার প্রতিষ্ঠিত দলের প্রার্থী হিসাবে তিনি নিজে এবং তার দল বিজয়ী হয়েছিল। উভয় নির্বাচনে তার নিজের ও দলের বিজয় প্রত্যাশিত হলেও যে ব্যবধানে তিনি নিজে ও তার দল বিজয়ী হয়েছিল তা প্রত্যাশিত ছিল না। অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক ঘটনার মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের মৃত্যু-পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি আব্দুস ছাত্তার যে ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন তা যে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে হয়নি এমনটি বিশ্বাস করার মতো সঙ্গত কারণ রয়েছে। যা হোক, বিচারপতি আব্দুস ছাত্তারকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া পরবর্তী এক বছরের কিছুকাল পর সাময়িক শাসক এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য করেন। জিয়াউর রহমানের অনুরূপ এরশাদও গণভোটের মাধ্যমে তার রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার বিষয়টির বৈধতা দেয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকে। অপর দিকে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত এই তিন দল অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকে। চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জাসদকে (রব) নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ করিয়ে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে দেয়া হয়। কথাটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রকৃত ফল প্রকাশ করা হলে দেখা যেত এরশাদের দল জাতীয় পার্টি পরাভূত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী ফল এমনভাবে প্রকাশ করা হয়- পরাভূত হওয়া দূরে থাক, তার দলকে দু-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী দেখানো হয়। তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ন্যায় আওয়ামী লীগও অংশগ্রহণ করা হতে বিরত থাকলে ১৯৮৬ সাল-পরবর্তী সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামল দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল।

১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত যে চারটি সংসদ নির্বাচন এবং এ সময়ের মধ্যে যেসব গণভোট ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; সেগুলোতে কে জয়ী এবং কে পরাভূত হন সে প্রশ্নে না গিয়ে সেগুলোর কোনোটি যে, মানদণ্ডের বিচারে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানার চেষ্টা করা হলে এ দেশে বারবার গণতন্ত্র হোঁচট খেত না।

বিগত তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দু’টি দল দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃত। সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় সৃষ্ট তার দল জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হলেও সে নির্বাচনগুলোর নিরপেক্ষতা তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় তার দলকে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ন্যায় প্রধান রাজনৈতিক দল আখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দল হিসেবে দ্বিতীয় সংসদ পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে জামায়াতের ফল মিশ্র হলেও প্রধান দু’টি দলের যেকোনো একটির সাথে জামায়াতের ভোট যুক্ত হলে ওই দলের বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা যে উজ্জ্বল; এটি বর্তমানে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সচেতন দেশবাসীর কাছে অনেকটা পরিষ্কার।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরের ওপর আস্থাশীল নয়। আস্থাহীনতার কারণে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন তুলনামূলক বিচারে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের চেয়ে স্বচ্ছ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তবু বিজীতদের কাছে সেগুলোও গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ দেশে দলীয় ও নির্দলীয় উভয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিজীত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় গণতন্ত্র এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পথে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি।

অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসান পরবর্তী যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল; সেটি যে সংবিধান অনুসৃত সব বিকল্প নিঃশেষ না করে গঠন করা হয়েছিল এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবসান ঘটিয়ে যে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন ঘটেছিল সেটিও যে সংবিধান অনুযায়ী গঠিত হয়নি; এই বিষয়ও অবিতর্কিত।
দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিএনপির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি বাস্তবায়নে পেছন থেকে শক্তি জুগিয়েছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি; তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সাংবিধানিক রূপ যে জামায়াতের মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল এ কথার ব্যাপক ভিত্তি রয়েছে। যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক আন্দোলন করেছিল; সেই আওয়ামী লীগ কেন একতরফাভাবে ব্যবস্থাটির অবসান ঘটিয়েছে এটি রহস্যাবৃত।

আমাদের দেশ দু’বার সামরিক শাসনের কবলে এবং একবার সেনা সমর্থিত বেসামরিক শাসনের কবলে পড়েছিল। প্রথমোক্ত দু’টি সামরিক শাসনকে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী দ্বারা বৈধতা দেয়া হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে উচ্চাদালতের সিদ্ধান্তে সে বৈধতাকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো- ২০০৮-২০০৯ সাল পর্যন্ত সেনাসমর্থিত বেসামরিক শাসনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল মামলার আপিল শুনানিকালে বিষয়টির হাইকোর্ট বিভাগে মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়া পরবর্তী উদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও আপিল নিষ্পত্তিকালে বৈধতা দেয়া হয়। সংসদের বৈধতার অনুপস্থিতিতে মামলার বিষয়বস্তু না হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের বৈধতার অবকাশ কতটুকু এর সুরাহা হওয়া জরুরি।

আমাদের বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের পরস্পরের প্রতি যেমন আস্থার অভাব অনুরূপ অপর কোনো রাজনৈতিক দলও এ দু’টির বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। তাই বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের যেকোনো একটির প্রতি জনগণ বিরূপ হলেও দ্বিতীয়টি ছাড়া তৃতীয়টিকে সমর্থনের সুযোগ এখনো উন্মোচিত হয়নি। এতে দেখা যায়, নেতিবাচক ভোটে বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের যে কোনো একটির বিজয় ঘটছে। এ ধারাটি ১৯৯০ সাল-পরবর্তী এখনো অব্যাহত আছে।

দেশে একটি সরকার সংসদ নির্বাচনে বিজয় পরবর্তী পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হতে পারে না। তাই নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্ববর্তী সরকার সংবিধানকে উপেক্ষা করে নিজের মতো করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে অথবা নিজে ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগ্রহী। এ ধরনের মানসিকতা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্তরায়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গেলে বড় দু’টি রাজনৈতিক দলকে পরস্পরের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে। এ আস্থাশীলতার ব্যাপারে উভয়কে খোলা মনে এগিয়ে এসে সমান ছাড় দিতে হবে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় একটি দলের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বিভিন্নমুখী অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ কারণে একই দল কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। কখনো বিপক্ষে। অনুরূপভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কখনো পক্ষে। কখনো বিপক্ষে। আমরা যদি এভাবে চলতে থাকি; তবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সুদূর পরাহত।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement