পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সেনাসমর্থিত বর্তমান জোট সরকার শেষ পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে ইমরানকে দোষী সাব্যস্ত করতে পেরেছে। লাহোরের একটি আদালত বিতর্কিত তোষাখানা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ইমরানকে তিন বছরের সাজা দিয়েছে। সরকার তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে ভরেছে। সাজার ফলে পরের পাঁচ বছর ইমরান কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
দৃশ্যত সরকারের সাফল্য হলেও এ সাফল্য যে মূলত সেনাবাহিনী ও তার প্রধান অসিম মুনিরের তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, ইমরান তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চেয়েও আসলে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন সেনাবাহিনীর। তাই সঙ্কটের আবর্তে পাক খেতে থাকা দেশটির রাজনীতিতে আপাত দৃষ্টিতে সেনাবাহিনীই জয়ী হলো। শুধু তাই নয়, চূড়ান্তভাবে জয়ী হলো যুক্তরাষ্ট্র। এটি অজানা নয় যে, ইমরানের ক্ষমতা হারানোর পেছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল আমেরিকার। বিশেষ করে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের দিন মস্কো সফরে যাওয়ার ঘটনাসহ বহুল আলোচিত নানা কারণেই তিনি আমেরিকার বিরাগভাজন হন। আর আমেরিকা রেজিম চেঞ্জের পুরনো খেলাটা শেষবারের মতো খেলে দেয় ইমরানকে হটিয়ে। ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব এনে এবং সম্পূর্ণ অনৈতিক প্রক্রিয়ায় তা পাস করে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কিন্তু ইমরান আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সরকারকে অবিরাম চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকেন। এতে করে দেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। গত জুলাই মাসের এক জরিপে তার জনপ্রিয়তা ৮৫ শতাংশ ছিল বলে জানা যায়। ইমরানের আন্দোলনের প্রধানতম দাবি ছিল অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু তার জনপ্রিয়তার এই জোয়ারের সময় নির্বাচন দিলে ক্ষমতাসীন জোটের যে শোচনীয় ভরাডুবি হবে সেটি তাদের চেয়ে ভালো আর কে জানত! তাই ছলে-বলে-কৌশলে ইমরানকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। একের পর এক মামলা দিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার এবং কারান্তরীণ রাখার চেষ্টা চলে। এক পর্যায়ে আততায়ী পাঠিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করা হয়। ভাগ্যক্রমে ইমরান আহত অবস্থায় বেঁচে যান। গত মে মাসে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা হলে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিছু সামরিক স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর করে ক্ষুব্ধ জনতা। ওই ঘটনায় সেনাবাহিনী ইমরানের ওপর চরম আঘাত হানার চেষ্টা করে। গণমাধ্যমে ইমরানের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার দূরের কথা, এমনকি তার নাম উচ্চারণেও নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পিটিআই নিষ্ক্রিয় করে ফেলা এবং একপর্যায়ে ভেঙে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। ইমরানের দলের নেতাদেরই আলাদা দল ঘোষণা করে পিটিআই থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়। সমস্ত শীর্ষ নেতাদের বন্দী করে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।
শেষ পর্যন্ত গত ৫ আগস্ট শনিবার বাঘবন্দী করতে পেরে প্রধানমন্ত্রী ও তার জোটের মিত্ররা বড়ই স্বস্তি বোধ করছেন। এতটাই যে, ওই রাতেই শাহবাজ শরিফ নিজ বাসায় বন্ধুদের ভূরিভোজে আপ্যায়ন করেন। দৈনিক ডনের খবরে বলা হয়, ওই ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ ৯ আগস্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেবেন বলে মিত্রদের জানান। সেখানে তারা পরম আনন্দে আগামী নির্বাচন আয়োজনের জন্য একজন পছন্দের কেয়ারটেকার সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী কাকে করা যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেন। আগের দিনও এ বিষয়ে আলোচনা করেন তারা। ফাঁকা মাঠে গোল করার এমন চমৎকার সুযোগ তারা পাবেন- এ তো ক’দিন আগেও কল্পনার বাইরে ছিল।
ইমরানকে যে তোষাখানা মামলায় সাজা দেয়া হলো সেটি ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর দায়ের করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। অভিযোগ করা হয়, প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় বিদেশ থেকে পাওয়া উপহারসামগ্রী যথাযথ ঘোষণা না দিয়ে ইমরান খান সেগুলো তোষাখানা থেকে কিনেছেন। এতে তিনি বেআইনিভাবে ১৪ কোটি রুপির সুবিধা নিয়েছেন। ওই মামলার লক্ষ ছিল একটিই পার্টির নেতৃত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া। এর আগে দুর্নীতির দায়ে নির্বাচন কমিশন ইমরানকে এমপি পদে অযোগ্য ঘোষণা করে।
তোষাখানা মামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ আগের অনেক প্রধানমন্ত্রীই বিদেশী উপহার প্রায় বিনামূল্যেই নিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত নাকি প্রচুর। আর বড় বড় দুর্নীতি ও সংবিধান লঙ্ঘনের ঘটনা তো আছেই, যেগুলো সরকার উপেক্ষা করেছে। মজার বিষয় হলো- আগে তোষাখানার কোনো সামগ্রী কিনতে জিনিসটির বাজারমূল্যের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হতো। ইমরানের সরকারই ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ পরিশোধের বিধান করে। তিনি সেই দামেই জিনিসগুলো কেনেন।
পাকিস্তানের সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামিদ মির বলেন, ‘আদালত যেভাবে মামলাটি পরিচালনা করেছেন সেটি এবং নেতৃত্বদানকারী বিচারকের আচরণ পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ওই রায় উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হবে এবং সম্ভবত ইমরান খান রেহাই পাবেন।’
এ ছাড়া, সন্ত্রাসবাদ, দেশদ্রোহিতা, খুনের চেষ্টার মতো নানা অভিযোগে অন্তত দেড় শতাধিক মামলা দিয়ে তাকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূলের চেষ্টা চালানো হচ্ছিল। কাজেই সরকার ও সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সারা দেশবাসী জ্ঞাত ও সচেতন। যেমনটি হামিদ মির বলেন, ‘আজকের (শনিবার) এ রায় অপ্রত্যাশিত ছিল না। প্রত্যেক পাকিস্তানি জানত, রায় এটিই হতে পারে। মনে হচ্ছে, বিচারক রায় আগেই লিখে রেখেছিলেন, সকালে কেবল পড়ে শুনিয়েছেন।’
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরার এক বিশ্লেষণে ইমরান খানের আইনজীবীর বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, আদালতে ইমরানের অনুপস্থিতিতে তাকে সাজা দেয়া হয়। এ মামলায় আসামির অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ পরিচালনা ও রায় দেয়া পাকিস্তানে আইনসম্মত নয় বলে দাবি করছেন ওই আইনজীবী। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করেছেন উচ্চ আদালতে। আশা করছেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় নিম্ন আদালতের ‘হাস্যকর’ রায় স্থগিত হয়ে যাবে।
তবে এটি ঠিক, নিম্ন আদালতের রায় যদি স্থগিত না হয় তাহলে ইমরান আগামী পাঁচ বছর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। পাকিস্তানের বিখ্যাত দৈনিক ডনের খবর, শাহবাজ সরকার ৯ আগস্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেবে। মেয়াদ ফুরানোর মাত্র তিন দিন আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার পেছনেও দুরভিসন্ধি আছে। সংবিধান অনুযায়ী, মেয়াদ শেষে পার্লামেন্ট আপনাআপনি ভেঙে গেলে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। আর মেয়াদ পুরো হওয়ার আগে ভেঙে গেলে নির্বাচন হতে হবে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। নিজেদের মতো করে নির্বাচন সাজানোর বাড়তি সুযোগ নেয়ার উদ্দেশ্যেই সরকার এই পদক্ষেপ নিচ্ছে।
পিটিআই এই ফরমায়েশি রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। গ্রেফতার হওয়ার আগে রেকর্ড করা এক ভিডিও বার্তায় ইমরান সমর্থকদের দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এখন কারাগারে থাকার কারণে তিনি আর নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। তবে তার দল থেমে যাবে এমন কোনো আশঙ্কা নেই।
স্বল্পকালীন ক্ষমতার মেয়াদে ইমরান যেসব কাজ করেছেন সেগুলো সমাজের একেবারে তৃণমূলের গরিব মানুষের সরাসরি উপকার করেছে। এ সবের মধ্যে নানা ধরনের সামাজিক কর্মসূচি ছাড়াও ছিল মহামারী-পরবর্তী নগদ অর্থ সহায়তা। এর ফলে বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষ কোভিড-পরবর্তী দুর্বিষহ পরিস্থিতির শিকার হওয়া থেকে রেহাই পায়। তার নেতৃত্বে পাকিস্তানে কোভিডে মৃত্যুও ছিল উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোর তুলনায় কম। ইমরান খান লাহোরে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল করেছেন, যেখানে রোগীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।
পাকিস্তানের অর্থনীতি চরম দুর্দশায় পড়েছে বলেই আমরা জানি। কিন্তু জানি না, ইমরান খান ক্ষমতায় থাকতে বৈদেশিক ঋণের বড় অংশ পরিশোধ করেছেন। সম্প্রতি আইএমএফ পাকিস্তানকে ঋণ দেবে কি না সে বিষয়ে আলোচনা করে ইমরানের সাথে। সরকারের প্রতি সংস্থাটির আস্থা নেই। ইমরান ঋণ দিতে বলেছেন। এমন উদার হৃদয়ের খাঁটি দেশপ্রেমিক নেতাকে অনির্দিষ্টকাল জেলে আটকে রাখা যায় না।
mujta42@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা