সম্পপ্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমেরিকা সফর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর তারা সংবাদ সম্মেলন করেন। মোদিকে ভারতের গণতন্ত্র ও মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘গণতন্ত্র আমাদের চেতনা। আমাদের সংবিধান, আমাদের সরকার ধর্ম, বর্ণ, জাতের ভিত্তিতে কোনো বিভেদ করে না।’ (প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০২৩)। এই উত্তর কি ঠিক? তিনি কি সত্য বলেছেন?
সংবিধানে অনেক ভালো কথা লেখা থাকে। কিন্তু মোদি সরকার কি সংবিধান মেনে চলছে? ভারতের সংখ্যালঘু সম্পপ্রদায় কি ভালো আছে? ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র কি সংখ্যালঘুদের সাথে মানবিক আচরণ করছে? ভারতের সা¤প্রতিক সংবাদগুলোয় চোখ বুলালেই বোঝা যাবে, হোয়াইট হাউজে নরেন্দ্র মোদি সত্য বলেননি। এই কলামের প্রথম পর্বে ভারতে সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের অবস্থার একটি আংশিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। আজ অতি সা¤প্রতিক কিছু ঘটনা তুলে ধরবো।
মুসলিম মহিলাদের ‘হিজাব’ হলো বিজেপি সরকারের টার্গেট। কর্নাটকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরার নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় ম্যাঙ্গালোর বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে ১৬ শতাংশ মুসলিম ছাত্রী ‘টিসি’ নিয়েছেন। অনেকেই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছেন। অন্য দিকে, গত ২ জুন মধ্যপ্রদেশে ‘দামাহোর গঙ্গা যমুনা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল’ কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের শুধু মাথা ঢেকে ক্যাম্পাসে ঢোকার নোটিশ দিলে স্কুলের স্বীকৃতি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আবার কাশ্মিরে একটি কো-এডুকেশন স্কুলের প্রিন্সিপাল মুসলিম ছাত্রীদের বোরকা পরতে নিষেধ করে দিয়েছিল। ছাত্রীদের প্রতিবাদের মুখে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার ‘ধুলিগড় আদর্শ বিদ্যালয়’-এর দ্বাদশ শ্রেণীর কিছু ছাত্র হঠাৎ করেই দশম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীদের হিজাব পরে আসা নিয়ে আপত্তি তোলে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসার নির্দেশ দেয়। পক্ষপাতদুষ্ট ভারতের উচ্চ আদালত বলেছে, শিক্ষাঙ্গনে হিজাব পরা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে তা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। (নয়া দিগন্ত, ২৬ নভেম্বর ২০২২) এদিকে মুসলিম নারীদেরকে বিতর্কিত করার জন্য ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নামের সিনেমা তৈরি করা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে কেরালা থেকে ৩২ হাজার নারী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা ‘আইএসে’ যোগ দিয়েছে। এতে দাবি করা হয়েছে, হাজার হাজার নারীকে ধর্মান্তরিত করে সন্ত্রাসী তৈরি করা হচ্ছে (প্রথম আলো, ৪ মে ২০০৩)। এর আগে গত বছর ১১ মার্চ ভারতের ৬০০ সিনেমা হলে ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ নামে আরো একটি সিনেমা প্রচার করা হয়েছিল। যাতে দেখানে হয়েছে, কাশ্মির রাজ্যে সংখ্যালঘু ‘পণ্ডিত’ স¤প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগুরু মুসলিমদের নির্যাতনের কাহিনী। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিজেপির সংসদীয় দলের সভায় সবাইকে এ ছবিটি দেখার নির্দেশ দেন (আল-জাজিরা, ১৩ এপ্রিল ২০২২)।
২০০২ সালে গুজরাট হত্যাকাণ্ড ছিল মোদির উগ্র মুসলিম বিদ্বেষের উদাহরণ। ভারতের প্রাক্তন আইপিএস অফিসার সঞ্জিব ভাট ছিলেন গুজরাট দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি আদালতে হলফনামায় লিখেছেন, দাঙ্গা চলাকালে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বাসস্থানে সভা ডেকে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, মুসলমানদের ওপর হিন্দুদের সহিংসতা ও হামলা চালানোতে যেন বাধা দেয়া না হয়। (নয়া দিগন্ত, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। পরবর্তীতে নরেন্দ্র মোদি দাঙ্গাবাজদের ‘অব্যাহতি’ দেন। আরেক আইপিএস অফিসার আর. বি শ্রী কুমার তার চোখের সামনে ঘটা গুজরাট দাঙ্গার সত্য ঘটনা বইয়ে প্রকাশের দায়ে জেলে রয়েছেন। ‘বিবিসি’ এই দাঙ্গা নিয়ে দুই পর্বের একটি ‘ডকুমেন্টারি’ তৈরি করেছে। সেই দাঙ্গায় প্রায় এক হাজার মুসলমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গুজরাট দাঙ্গার সময় পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত¡া বিলকিস বানুকে গণধর্ষণ করে তার তিন বছরের মেয়েসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ আসামিকে আদালতের নির্দেশে সাজার মেয়াদ পূর্ণ না করেই মুক্তি দেয়া হয়েছে। (প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০২২)
গত বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আবার গত ২৫ নভেম্বর গুজরাটের এক নির্বাচনী জনসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, “২০০২ সালে গুজরাটে ‘ওদের’ (মুসলমানদের) উচিত শিক্ষা দেয়া হয়েছিল।” (প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর ২০২২)।
‘ওআইসি’ গত ৪ এপ্রিল এক বিবৃতিতে জানায়, সম্প্রতি ভারতে রাম নবমীর ৯ দিনের উৎসবের সময় মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো ভারতে ইসলামোফোবিয়ার কারণে পদ্ধতিগতভাবে ভারতে মুসলিম স¤প্রদায়কে লক্ষবস্তু করার একটি উদাহরণ (নয়া দিগন্ত, ৬ এপ্রিল ২০২৩)। গত ১ মে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ নামের একটি স্বাধীন কমিশন ভারতকে টানা চতুর্থবারের মতো ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্বের কারণে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছে (নয়া দিগন্ত, ৩ মে ২০২৩)। গত বছর জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক মার্কিন দূত রাশাদ হাসান ভারতে গণহত্যার ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, গণহত্যার ঝুঁকি রয়েছে, এমন দেশের তালিকায় ভারত ‘দ্বিতীয়’ স্থানে রয়েছে। গণহত্যার একটি ঘটনা ঘটে ২০২০ সালে দিল্লিøতে। সে বছর ২৩ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে দাঙ্গায় ৪০ জন মুসলমান ও ১৩ জন হিন্দু নিহত হয়। ভারতের ‘কনস্টিটিউশনাল কন্ডাক্ট গ্রæপ’ নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়, ২৬ তারিখের আগ পর্যন্ত কোনো পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজেপি ও অন্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতাদের ঘৃণা ভাষণ, কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে উগ্র প্রচার এবং পুলিশ ও সরকারের ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা ওই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার কারণ (প্রথম আলো, ৮ অক্টোবর ২০২২)।
গত বছর ৬ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সব নাগরিকের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। মুসলমান নির্যাতনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেখে সাধারণ হিন্দুরাও উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। গত ২১ জুলাই উত্তর প্রদেশের বাঘপত এলাকার একটি মসজিদের ইমামকে স্থানীয় তিন হিন্দু যুবক গেরুয়া চাদর পরিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ¯েøাগান দেয়ার জন্য জোর করে। কিন্তু ওই ইমাম তা না বলায় তাকে ওই যুবকরা বেদম প্রহার করে (নয়া দিগন্ত, ২২ জুলাই ২০২৩)। অতি স¤প্রতি গত ১ আগস্ট রাতে হরিয়ানা রাজ্যের গুরুগ্রাম জেলার একটি মসজিদে একদল হিন্দু আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মসজিদের ইমাম ‘সাদ’কে গুলি করে হত্যা করে। এর আগে পাশের নুহ জেলার হিন্দুদের একটি ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছিল। গুরুগ্রামে প্রায় ২০০ সশস্ত্র হিন্দু যুবক মাংস ও বিরিয়ানি বিক্রির ১৪টি দোকান ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় আগে থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করলেও পুলিশের নীরব ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে (প্রথম আলো, ২ আগস্ট ২০২৩)।
হোয়াইট হাউজের সংবাদ সম্মেলনে মোদিজির জবাব মানবাধিকারকর্মীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। গত ২২ জুন সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, মুসলিমদের অধিকারকে সম্মান দেয়া না হলে ভেঙে যেতে পারে ভারত। ‘হিন্দুত্ব ওয়াচ’-এর প্রতিষ্ঠাতা রাকিব হামিদ নায়িক বলেন, ‘মোদির মন্তব্য পুরোপুরি মিথ্যা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ভারত একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়েছে।’ (নয়া দিগন্ত, ২৪ জুন ২০২৩)
২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার নামে মুসলমান নিধন করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া লাগিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতার বন্দরে পৌঁছেন। ক্ষমতায় এসে তিনি সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে বাবরি মসজিদ মামলার নিষ্পত্তি ঘটিয়ে মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে জনপ্রিয়তা বাড়াতে ‘অভিন্ন দেওয়ানি’ বিধি চালুর টোপ হিন্দুদেরকে গেলাতে চাচ্ছেন। যে আইনে বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার ও দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে সব ধর্ম ও বর্ণের নাগরিককে একই আইন মেনে চলতে হবে। নয়াদিল্লির লেখক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় তাই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত তা স্রেফ ইসলামবিরোধিতার নতুন আখ্যান হবে না তো?’ (প্রথম আলো, ১৩ জুলাই ২০২৩)।
বাস্তবতা হলো, ভারতে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘু নির্যাতন পুরোদমেই চলছে। এই নির্যাতন প্রক্রিয়া দিন দিন বাড়ছে। ভারতে মুসলিম নির্যাতন বন্ধ হবে না। কারণ এটিই বিজেপির রাজনীতি।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
e-mail: maksud2648@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা