০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কুকি ও নাগা প্রসঙ্গ

-

কুকি ও নাগারা এখন ভারত ও বাংলাদেশের জন্য বিরাট আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বে ৩৩ লাখ জনসংখ্যার রাজ্য মনিপুরে ৪৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীই কুকি ও নাগা। বাকি ৫৭ শতাংশ মইতই সম্প্রদায়ভুক্ত; অর্থাৎ তারাই জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। গত তিন মাসে সেখানে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। মনিপুরে সঙ্কট বেশ বীভৎসভাবে উন্মোচিত হয়েছে। মনিপুরের এ জাতিগত বিবাদে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জন নিহত এবং আহত ৪০০ জনের মতো। তদুপরি ৬০ হাজার বাসিন্দাকে বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে। পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীই শুধু নয়; এমনকি সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও এই গৃহযুদ্ধ থামাতে কাজ করতে হয়েছে। তবু সেখানে শান্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। মইতইরা হিন্দুধর্মের অনুসারী এবং তাদের কিছু লোক অপরিচিত আনামাহি ধর্মমতের অনুসারী। অন্য দিকে কুকি ও নাগা উপজাতিরা প্রধানত খ্রিষ্টান। তাদের অভিযোগ তাদের গির্জা, বাড়িঘর ও জায়গা-সম্পত্তি ‘ধ্বংস করে দেয়া’ হচ্ছে।

বাংলাদেশে কেএনএলএফ অর্থাৎ কুকিচিন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান এলাকায় বেশ তৎপর। তারা জঙ্গিদের সংবিধানের সংশ্লিষ্টতায় প্রশিক্ষণ পাচ্ছে বলে সরকারিভাবে অভিযোগ উঠেছে। কুকিচিনদের তৎপরতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের কিছু স্মৃতি মনে উঁকি দেয়। তখন ওই এলাকায় মনিপুরীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে মৌদক মৌয়াল স্থানের নাম ছড়ায়। মনিপুর দিয়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদহিন্দ ফোর্স ঢুকে পড়েছিল। তাদের সৈন্যরা জাপানিদের সহায়তায় মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল দিয়ে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হয়। এই কুকিচিনরা নাগা-লুসাইদের ঘনিষ্ঠ। তারা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ও প্রধানত ইংরেজি ভালো জানে। বাংলাদেশে অষ্টাদশ শতকে কুকি ও লুসাইদের উৎপাত ছিল বিশেষত ফেনী অঞ্চলে। এখন তারা অনেক দক্ষিণে অর্থাৎ বান্দরবানের পূর্ব পাশে পালেত্তোয়া অঞ্চলে তৎপরতা চালালেও অতীতে ফেনীর পরশুরাম, ছাগলনাইয়ায় তৎপর ছিল। নূরলদীন যেমন উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামের ঐতিহাসিক চরিত্র, তেমনি গুণাইগাজী ফেনীর একজন ঐতিহাসিক চরিত্র। আমার মরহুমা মায়ের মুখে শুনেছি,
‘গুণাই গাজী আইল সাজি,
সঙ্গে সাথি করে;
তীরবা-কুকি তাড়াই দিলো,
বন্দুক আওয়াজ করে।”
এখানে কবিতার মিলের অভাব থাক্লেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। তীরবা অর্থ টিপরা উপজাতি এবং কুকি মানে নাগা বা লুসাই। পরবর্তীকালে এদের প্রতিহত করার জন্য অষ্টাদশ শতকে ছাগলনাইয়া থেকে পরশুরাম পর্যন্ত ইংরেজদের ‘ক্যাপ্টেন লিক রোড’ তৈরি হয়েছিল। বহু পরে বিএনপি আমলে কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) অলি আহমেদ যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আশ্বাস দিয়েছিলেন রোডটি চালু করার, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। উল্লেখ্য, গুনাই গাজী, সোনাগাজী, মনগাজী, ফুলগাজী, চাঁদগাজী-এরা ঐতিহাসিক চরিত্র।

কুকিচিন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকজন সেনা সদস্যকে হত্যা করেছে। এ দিক দিয়ে তারা আতঙ্কের কারণ। তারা অপহরণ, বোমা বিস্ফোরণ করে এবং মানুষ হত্যা করে। অত্যাধুনিক অস্ত্রের মালিক তারা।

কুকি বা নাগাদের মূল ভূমি এখন মিয়ানমারের চিন প্রদেশ। এটি বান্দরবানের পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর সংলগ্ন ভারতীয় প্রদেশ মিজোরাম রাজ্য, যার রাজধানী আইজোয়াল। দেমাগিরি ও লুংলে এর অপর দু’টি বিখ্যাত জায়গা। মিজোরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে লুসাই বা নাগা সম্প্রদায়ের বসবাস। এদেরই অন্তর্ভুক্ত ডনডন লুসাই, রামা লুসাই প্রমুখ ভাই, এমনকি মেয়েরাও জাতীয়পর্যায়ের খেলোয়াড়।

ভারতের মনিপুর রাজ্যে মোট ৪০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন রয়েছে। এ কথা শুনে এত কথা মনে পড়ল। গণমাধ্যম ‘দ্য ফ্রন্টিয়ার’ মনিপুরের সম্পাদক বলেছেন, মনিপুরে বর্তমান সঙ্ঘাত জাতিগত, যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হচ্ছে না। মনিপুর সঙ্ঘাতের প্রথম দিকে খবর প্রচারিত হয় যে, একদল উপজাতীয় কুকি সশস্ত্র যোদ্ধা এক মইতই নারীকে ধর্ষণ করেছে। তখন মইতই জনগোষ্ঠী প্রতিশোধ নেয়। বৃহত্তর সিলেটে অনেক মইতই লোকের বসবাস। এরা সাধারণত হিন্দু। মৌলভীবাজার জেলায় এরা মনিপুরী সাহিত্য সংস্কৃতি, নৃত্য, কবিতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গত ৪ মে মনিপুরী উপজাতি নারী মইতই জনতার হাতে অবমাননার কথিত ঘটনার এখনো প্রতিবাদ করেননি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি মনিপুর প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্যই করেননি। অবশেষে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিলেন। তিনি কেন এত সময় নিলেন?

নরেন্দ্র মোদির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির নেতৃত্বাধীন বীরেন সিংহ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মনিপুর শাসন করছেন। তিনি হিন্দু মইতই সম্প্রদায়ভুক্ত। মনিপুর রাজ্যে বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৪০টি মইতই সম্প্রদায়ের দখলে। বীরেন সিংহ কুকি উপজাতীয় এবং পপি চাষ করাকে বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী করছেন।

মনিপুরে সৈন্যবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ ৪০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন আছে। কিন্তু বিশেষ করে উপজাতিরা নিজেদেরকে নিরাপদবোধ করছে না এবং শান্তির কোনো লক্ষণ নেই। উপজাতিদের অভিযোগ, তফসিলি জাতি বা সিডিউলড্ ট্রাইব হিসেবে মইতইরা পাহাড়ে অনুপ্রবেশ করে। ওরা পাহাড়ি উপজাতিদের জমি দখল করতে চায়। এ জন্য উপজাতিরা মইতইদের তফসিলি জাতি বা এসটি হিসেবে গণ্য করার বিরুদ্ধে। কুকি নাগাসহ উপজাতি জনগোষ্ঠীর বক্তব্য, তফসিলি সম্প্রদায়যুক্ত হলে সমতলের অধিবাসী মইতইরা শক্তিশালী হবে। এমনিতেই মনিপুর প্রদেশের রাজনীতি, সরকার ও সমাজে মইতইরা প্রভাবশালী। উপজাতিদের বক্তব্য, মইতইরা পাহাড়ি নয়; সমতলবাসী। তারা তফসিলি হলে কুকি অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকায় জমি কিনে বসত গড়ার সুযোগ পাবে। বীরেন সিংহের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার মূলত মইতই প্রভাবিত এবং এ কারণে উপজাতিদের উচ্ছেদ করতে চায়। উল্লেখ্য, কুকিদের কোমরে একধরনের ধারালো ছোরা গোঁজা থাকে, যা ভোজালি নামে পরিচিত। মনিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল ছাড়াও চূড়া চাঁদপুর বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত এবং সেখানেও এবারের ঘটনা ঘটেছে। মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আলিমুদ্দীন নামের একজন মুসলমান। বাংলাদেশে বহুল আলোচিত টিপাইমুখবাঁধ বরাক নদীর উপরে মনিপুরের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত।

মিয়ানমার থেকে আসা অভিবাসীরাও মনিপুরের অসন্তুষ্টির কারণ। মনিপুরে অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে এবং তারা পরস্পর লড়ছে। কুকি ও মইতইরা পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত লড়াইয়ে ব্যস্ত। বর্তমান সঙ্কটের এটি অন্যতম প্রধান কারণ। নাগাদেরও সশস্ত্র দল রয়েছে যারা একটি খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠায় উদগ্র। মইতইরা বাংলাদেশে সাধারণত মনিপুরী নামে পরিচিত এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মনিপুরী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।


আরো সংবাদ



premium cement