কী কবিতা, কী গল্প, কী নাটক বা উপন্যাস, প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা অবদান রেখেছেন। বলছি (পাবনার) ‘হায়দার’ ভাইদের কথা। ছয়জন সহোদর হায়দারের কথা আমরা জানি।
চট্টগ্রামে প্রতি বছর বড় মেলা হতো বন্দরনগরীতে। একবার মেলায় গেছি। সেখানে পাবনার তাঁতের শাড়ির বিক্রেতা বলছিলেন, ‘আমাদের বাড়ি আপনাদের চিটাগং ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জিয়া হায়দারের বাড়ির পাশে।’ জিয়া হায়দার তখন বিখ্যাত ও আলোচিত নাট্যকার, ভাইদের মধ্যে সবার বড়। বাবা মুসলিম লীগের একসময়ের নেতা মোহাম্মদ হাকিমুদ্দীন শেখ; মায়ের নাম মোসাম্মৎ রহিমা খাতুন। বাড়ি পাবনা জেলা শহরের অদূরে বিখ্যাত দোহারপাড়ায়। পরে তারা পাবনা শহরে চলে আসেন। জিয়া হায়দার দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকের শিক্ষক ছিলেন। থাকতেন চাটগাঁ শহরের লাল খাঁ বাজারের ইস্পাহানি ভবনে। আমার সহপাঠীদের প্রায় সবাই নাটকের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়া সত্তে¡ও নাটক বিষয়ে তেমন পড়িনি। আমাদের ইংরেজি বিভাগের অদূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ভবনের উপরের তলায় ছিল তার অফিস ও নাটক বিষয়। জিয়া হায়দারের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ নভেম্বর। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জিয়া হায়দারের দু’টি নাটক খুব জনপ্রিয় ছিল : এলেবেলে (১৯৮১) এবং শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ (১৯৭০)। আমি একবার জিয়া হায়দারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিচারক হবার অনুরোধ করতে গিয়ে ধমক খেয়েছিলাম। সেটিই আমার প্রাপ্তির আনন্দ। কারণ তখন তিনি হয়তো ছিলেন খুব ব্যস্ত। জিয়া হায়দার ২০০৮ সালে মারা যান। তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান নাটকে এবং একুশে পদক পান ২০০০ সালে। জিয়া হায়দার বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে। মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে। এর আগে আমেরিকার হাওয়াই ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৮ সালে। ১৯৮২ সালে তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট ইন শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার অর্জন করেন। উল্লেখ্য, তার বড় গোঁফের অনুসরণ করেছেন অন্যান্য ভাই।
১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন তার ছোট ভাই রশীদ হায়দার। তিনি কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। থাকতেন মিরপুর মিল্কভিটা রোডে মল্লিকা আবাসিক এলাকায়। তার বাসার কাছাকাছি আমিও থাকতাম। রশীদ হায়দার স্নাতকোত্তর হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে। তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। রশীদ হায়দার বাংলা একাডেমিতে থাকাকালে এক দিন একুশের বইমেলায় গেছি। দেখি, তিনি বাংলা একাডেমির বটতলায় বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের ছবির কাছাকাছি অবস্থান করছেন। তখন দেখি, আমার প্রিয় কবি ফররুখ আহমদের ছবিটা উল্টো ঝুলছে। এ অবস্থায় রশীদ হায়দারকে অনুরোধ করায় তিনি তা ঠিক করে দেন। একুশের বইমেলায় তার সুন্দর ভরাট কণ্ঠস্বর এখনো কানে বাজে। স্কুলে পড়ার সময় তার ‘নানকুর বোধি’ (১৯৬৭) বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখেছি। তার আরেকটি বই বের হয় ১৯৮৬ সালে ‘মেয়েদের ঘরবাড়ি’ নামে। ১৯৮৫ সালে তিনি গ্রন্থনা করেন ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থ। এর আগের বছর তিনি বাংলা সাহিত্যে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে বের হয় তার রচিত কবি হাসান হাফিজুর রহমান জীবনীগ্রন্থ। ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ‘স্মৃতি ৭১’ নামে ১৩ খণ্ডে তার বিশাল বই বের হয় বাংলা একাডেমি থেকে। এটিই তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
তাদের আরেক ভাই কবি মাকিদ হায়দারের জন্ম ১৯৪৭ সালে। তিনি বিসিকের জিএম ছিলেন। ১৯৮১ ও ১৯৮৯ সালে ফিলিপিনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে গণসংযোগ ও গণমাধ্যমে তিনি ডিপ্লোমা লাভ করেন। তার সময়ে এক দিন বিসিক অফিসে গেছি। তখন বিসিকের ডিজাইন বিভাগের প্রধান ছিলেন আলাউদ্দীন আহমেদ, সে কক্ষে আগে বসতেন বিখ্যাত ‘পটুয়া’ কামরুল হাসান। মাকিদ হায়দার প্রথম দিনই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, কবিতার পঙ্ক্তি, ‘সংগ্রাম কবির কাহার সনে।’ উল্লেখ্য, আমি তখন দৈনিক সংগ্রামের স্টাফ রিপোর্টার। প্রথম দিনেই তিনি আমাকে এভাবে আপন করে নিলেন। তার লিখিত বিখ্যাত বই ‘রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা’ (১৯৭৬) এবং ‘প্রিয় রোকোনালী’ (২০০৩) নামের দু’টি কাব্যগ্রন্থ। তিনি গল্পের বইও লিখেছেন।
তাদের আরেক ভাই দাউদ হায়দারের জন্ম ১৯৪৮ সালে। দাউদ হায়দার আমাদের নবীজী সা:-এর প্রতি সমালোচনামূলক কবিতা লিখে জার্মানিতে স্বনির্বাসনে। তখন তিনি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক। তার কবিতাটির নাম ছিল ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যা’। দাউদ হায়দার একই কবিতায় যিশুখ্রিষ্ট ও মহামতি গৌতম বুদ্ধেরও সমালোচনা করেন। তাকে প্রথমে কলকাতা পাঠিয়ে দেয়া হয়। জনমনে এর তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ১৯৭৪-এর সেই দিনগুলোতে কবি ফররুখ আহমদ মারা গেলে তাকে নিয়ে দাউদ হায়দারের একটি লেখা বের হয় কলকাতার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ম্যাগাজিনে। লেখাটি ছিল চমৎকার। দাউদ হায়দার যে ফররুখের কিছুটা ভক্ত ছিলেন, তা অস্বীকার করা যাবে না।
তাদের ছোট ভাই কবি জাহিদ হায়দারের জন্ম ১৯৫৬ সালে। তিনি বাংলায় স্নাতকোত্তর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৭ সালে। তার লেখা কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ আছে। তাদের সবার ছোট ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনিও সাহিত্যচর্চা করে থাকেন। বাংলা একাডেমির প্রকাশিত কবি-সাহিত্যিকদের পরিচিতি গ্রন্থে একসঙ্গে এত ভাইয়ের উপস্থিতি আর নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা