০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ছাত্রের শ্রদ্ধাঞ্জলি

- ছবি : নয়া দিগন্ত

Half truth is more dangerous than lie (অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর) বলে প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর মতো গুরুগম্ভীর মানুষটি গর্জে উঠলেন। ঘটনা হলো, আমি তখন চাকসুর সাহিত্য সম্পাদক। তার কথা হচ্ছিল চাকসুর ম্যাগাজিন সেক্রেটারি বা সাময়িকী সম্পাদকের সাথে। তিনি দলের একনিষ্ঠ র্কর্ম বিশেষত সাহিত্য ফ্রন্টে। সে বয়সেই কবি ও সম্পাদক হিসেবে পরিচিত। চাকসুর মোট ২৭ জনের মধ্যে তারা একই দলের ছিলেন মাত্র পাঁচজন। অন্যদের পরিচয় ভিন্ন দলের। মোহাম্মদ আলী সাহেব তখন চাকসুর কোষাধ্যক্ষ, যা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। ম্যাগাজিন সেক্রেটারির সাথে কী নিয়ে যেন তর্ক বেঁধেছিল তার এবং সে সূত্রে উপরিউক্ত কথাটা। ইংরেজি ভাষার ছাত্র হিসেবে সে ভাষার একটি প্রবচন আমার শেখা হয়ে গেল। এটা পরে একাধিকবার প্রয়োগ করেছি।

সেই বিখ্যাত প্রফেসর মোহাম্মদ আলী আর নেই। প্রকৃতির নিয়মে তিনি সম্প্রতি চিরবিদায় নিয়েছেন পরিণত বয়সে। থাকতেন চাটগাঁর অভিজাত এলাকা চাঁদগাঁওতে। স্ত্রী ম্যাডাম খালেদা হানুমের মৃত্যু হয় তার মৃত্যুর মাত্র ১০ দিন পর। তিনি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষিকা ছিলেন। স্যার ও তার স্ত্রী ছিলেন যেন ‘মানিকজোড়’। এমন ভালোবাসার দম্পতি আর দেখিনি। তার স্ত্রীর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে অনেক কিছুই আছে পড়ার ও জানার মতো। এই ভদ্রমহিলা আর তার ভাই জাহাঙ্গীর চৌধুরী আমার সুপরিচিত।

আমরা যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন সেখানকার শিক্ষকদের প্রধানত দু’টি প্যানেল ছিল। একটির নেতৃত্ব দিতেন প্রফেসর আবদুল করিম ও প্রফেসর মোহাম্মদ আলী। প্রতিপক্ষের কাণ্ডারি ছিলেন প্রধানত প্রফেসর আনিসুজ্জামান। তবে উভয় তরফের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আজকের মতো নেমে যায়নি বলে শুনেছি।

যা হোক, একদিনের কথা ভুলিনি। আমাদের এক সহপাঠীর ভাই ছিলেন ভার্সিটি টিচার। সে সুবাদে তার পড়া সম্ভব ছিল ভার্সিটির লাইব্রেরির পাঠ্যবই। একদিন সে বলল একটা ঘটনা। তা হচ্ছে, বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়রের ওপর একটা প্রশ্নের জবাব তৈরি করতে গিয়ে তাকে পড়তে হলো A.C. Bradley iwPZ The Shakesperean tragedy বইটি। এটা এমন একটা কমন বই, যা সবাই পড়ে থাকে। এরপর আরো জ্ঞান অর্জনের জন্য সেই সহপাঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পত্রিকা অধ্যয়ন করেছিল। কিন্তু সেখানে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধ পড়তে গিয়ে তার মনে হলো, এটা আগেও কোথাও পড়েছে। মিলিয়ে দেখা গেল, পূর্বোক্ত বইটির একাংশ আর উল্লিখিত নিবন্ধটির বিরাট অংশই অভিন্ন। অথচ নিয়মমাফিক কোথাও এর রেফারেন্স কিংবা উদ্ধৃতিরও উল্লেখ ছিল না। ছাত্রটি বিস্মিত হয়ে দেখে যে, নিবন্ধের ‘লেখক’ একজন লেখক ও সিনিয়র প্রফেসর (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কর্মরত)। তদুপরি তিনি এক্সটার্নালরূপেও ইংরেজি বিষয়ের অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষা দিতেন। আমিও এটা শুনে হতভম্ব। অনেকের মতে, নিবন্ধকার বুদ্ধিবৃত্তিক সততার ‘পরিচয় দেননি’।

একদিন মোহাম্মদ আলী স্যারকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেম, কিন্তু ওই শিক্ষক ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ হলেও আলী স্যার ‘নিচে নামেননি’। আমি একজন ছাত্র। তাই তিনি সেই শিক্ষকের ব্যাপারে সংযমের ও পরিমিতির পরিচয় দিয়েছিলেন। কেবল পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, ‘তাই নাকি?’ তিনি তখন মুচকি হাসছিলেন যা অর্থবহ। কিন্তু নিজের একজন ছাত্রের কাছে অন্য শিক্ষকের (ভিন্নমতের হলেও) নিন্দামন্দ করেননি। আজকাল এটা দেখা যায় না। স্যার শিক্ষক রাজনীতি করতেন। তবে ছাত্রদের এ জন্য ব্যবহার করতেন না। বর্তমানে তার উল্টোটাই বেশি চোখে পড়ে। তাই বিশেষত ক্ষমতাসীন মহলের উৎপাত বেশি।

যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ইংরেজি বিভাগে, তখন ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ আলী। তার পরই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হারুন অর রশিদ স্যার। অনেকেই বলতেন, তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয় কিংবা দ্ব›দ্ব আছে- জানি না, এ অভিযোগ সত্য কতটা। এটা ঠিক যে, মোহাম্মদ আলী স্যার এবং হারুন স্যার ছিলেন দুই প্যানেলের লোক। তদুপরি প্রথমোক্ত শিক্ষক অক্সফোর্ডের এমএ এবং শেষোক্তজন ক্যান্টাব বা কেমব্রিজে পড়াশোনা করা ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মোহাম্মদ আলী সাহেব সাধারণত ছিলেন স্বল্পবাক, থাকতেন গম্ভীর এবং ছাত্রছাত্রীরা তার থেকে একটা দূরত্ব রেখে চলত। অন্য দিকে, হারুন স্যার ছিলেন অনেকটা ‘খোলামেলা’ আর শিক্ষার্থীদের ‘ঘনিষ্ঠ’। আলী স্যার যে বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে সর্বাধিক সিনিয়র ছিলেন, তা সবাই মানতেন। যখন ভর্তি হলাম, তখন মোহাম্মদ আলী স্যার পুরোদস্তুর প্রফেসর আর হারুন স্যার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। দু’জনই সরকারি কলেজ থেকে ভার্সিটিতে এসেছিলেন। শুনেছি, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ দীর্ঘকালীন অধ্যক্ষ এ এ রেজাউল করিম চৌধুরী অতীতে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী স্যারকে। আমি নিজে কিছু দিন পড়েছি মরহুম রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে। হারুন সাহেব পরে জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষকতা ছাড়াও বাংলা একডেমির মহাপরিচালক হন। তখন তিনি যে অভিধান বের করেছেন তাতে সম্পাদক হিসেবে মরহুম প্রফেসর মোহাম্মদ আলীর নাম দেখেছি। তার জ্ঞানবত্তার এই স্বীকৃতি স্বাভাবিক। স্মর্তব্য, মোহাম্মদ আলী সাহেব বলতেন কম; লিখতেন আরো কম।

মোহাম্মদ আলী সাহেব দেশের অন্তত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে কর্ণধার হয়েছিলেন। এগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (আইআইইউসি) এবং ঢাকার নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। এমন রেকর্ড দেশে আর কারো আছে বলে শুনিনি।

প্রফেসর মোহাম্মদ আলী রাজধানীতে থাকলে অনেক বেশি প্রচার পেতেন, যেমন অনেকেই পাচ্ছেন। তাই তার মৃত্যুর খবরটিও হয়তো সব মিডিয়া প্রচার করিনি। তবে আমরা যারা তার ছাত্র ছিলাম, তারা জানি যে, তিনি জ্ঞান ও প্রতিভা, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে কিংবদন্তিতুল্য, তার মৃত্যু সংবাদের সাথে সুশিক্ষিত স্ত্রীর বিয়োগবার্তাও পেয়েছি। ঢাকার পত্রিকায় হয়তো তেমন গুরুত্ব পায়নি। তার স্ত্রীর বাবা ডাক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন যেমনি তার নিজের পিতা ছিলেন আইনজীবী। আর জাতীয় অধ্যাপক ও প্রখ্যাত ডাক্তার, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন তার ভগ্নিপতি। একজন রোগী হিসেবে তার কাছে যাবার স্মৃতি ভোলার নয়। মোহাম্মদ আলী স্যারের পরিবার সম্পর্কে ছাত্রজীবনেই জানা ছিল।


আরো সংবাদ



premium cement