১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


শেক্সপিয়রের ওথেলো ও পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের ভাষা

লেখক : মুসা আল হাফিজ - ফাইল ছবি

সাইপ্রাস অবরোধে এগিয়ে আসছে উসমানী নৌবাহিনী। খবর পেয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হলেন মনটোনা, তিনি সাইপ্রাসের গভর্নর। চরম উদ্বেগ, অস্থিরতা আর ভীতির ভেতর দিয়ে প্রহর পার হচ্ছিল। সমস্যার মোকাবেলায় কী করণীয়, তা স্থির করার জন্য তিনি চিঠি লিখলেন ভেনিসের ডিউকের কাছে। চিঠি পেয়ে মধ্যরাতে সিনেটরদের সভা ডাকলেন ভেনিসের ডিউক। সবাইকে জানানো হলো সাইপ্রাস দখলে তুর্কি বাহিনী আসছে! তারা পৌঁছে গেছে রোডস দ্বীপের কাছে। খবর শুনে কম্পিত হলেন সিনেটের সদস্যরা। জলে-স্থলে একেবারে অপ্রতিরোধ্য তুর্কি যোদ্ধাদের অগ্রযাত্রার কোনো জবাব নেই তাদের কাছে। জলযুদ্ধে বিশ্বসেরা ব্রিটিশ নৌবাহিনীও যে তুর্কিদের সামনে টিকতে পারে না, তাদের বিরুদ্ধে কী করার আছে ভেনিসের!

সবাই যেন নিরুপায় প্লাটফর্মে স্তব্ধ। তখন ডিউক বললেন, এ বিপদে আমাদের একমাত্র আশা হচ্ছেন সেনাপতি ওথেলো। তিনি তুর্কিদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম। কথাটি শুনে সিনেটরদের প্রাণে পানি এলো। ওথেলোর সক্ষমতা তারা জানে। তাকেই পাঠানো যায় তুর্কিদের মোকাবেলায়। তার বীরত্বে সবার ভরসা । কিন্তু কে এই ওথেলো? তিনি ম্যুর অব ভেনিস। আফ্রিকার মরক্কো থেকে আসা স্যুরিস সেনাপতি। গায়ের রঙ কালো।

বোঝাই যাচ্ছে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বিখ্যাত নাঠক ‘ট্র্যাজেডি অব ওথেলো, দ্য ম্যুর অব ভেনিস-এর কথা বলছি। ওথেলো এই নাটকের প্রধান চরিত্র। তিনি যে ম্যুর, তা স্পষ্ট নাটকের শিরোনাম থেকেই। কিন্তু ম্যুরদের কী পরিচয়? মধ্যযুগীয় ইউরোপে বহুল ব্যবহৃত ম্যুর কথাটি মরক্কো, স্পেন, সিসিলি ও মাল্টার মুসলিম বাসিন্দাদের ব্যক্ত করত। ১২৮৫ সালে আলফোনসো এক্স তার দ্য বুক অব গেমস -এ খ্রিষ্টান ও ম্যুরের দাবা খেলার ছবিতে ম্যুর বলতে দেখিয়েছেন মুসলিমকে। আবার ১৮৮৬ স্টানলি লেইনপুল তার ঞযব ঝঃড়ৎু ড়ভ ঃযব গড়ড়ৎং রহ ঝঢ়ধরহ গ্রন্থে ম্যুরদের ইতিহাস বলতে লিখেছেন স্পেনে মুসলিমদের ইতিহাস। গোটা মধ্যযুগ কিংবা আধুনিক যুগে ম্যুর বলতে বোঝানো হয়েছে উত্তর আফ্রিকান বারবার ও আইবেরীয় মুসলিমদের। ১৯১১ সালে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা জানায়, ম্যুর কথাটির কোনো প্রকৃত জাতিগত মূল্য নেই। আমরা দেখেছি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অঞ্চলের বাইরেও মুসলিমদের ইউরোপীয়রা ম্যুর বলে আখ্যায়িত করেছে। দক্ষিণ এশিয়া ও শ্রীলঙ্কায় মুসলিমদের বোঝাতে সিলন ম্যুরস এবং ইন্ডিয়ান ম্যুরস পরিভাষা চালু করে পর্তুগিজরা। বাংলাদেশেও তারা মুসলিমদের ম্যুর বলে ডাকত। ফিলিপাইনে মুসলিমদের মরো নাম ইউরোপীয়দের প্রদত্ত। স্পেনে ম্যুর মুসলমানদের শাসন শুরু হয় ৭১১ সালে। ৮২৭ সালে সিসিলির মাজরায় প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যুর মুসলিমদের শাসন। ১২২৪ সালে মুসলিম সিসিলি এবং ১৫৯২ সালে মুসলিম স্পেনের পতন হয়। কিন্তু একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দ অবধি স্পেন-পর্তুগালে মুসলিমদের উপস্থিতি ছিল।

শেক্সপিয়রের সমকালীন ইংরেজি সাহিত্যে ম্যুর মুসলিমদের প্রসঙ্গ গৌণভাবে হলেও হাজির হয়েছে। তিনিও তার বিখ্যাত এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রাখেন একজন ম্যুর মুসলিম ওথেলোকে। ম্যুর চরিত্রের উপস্থিতি শেক্সপিয়রের আরো দুই নাটকে উপস্থিত রয়েছে। এই নাটকে ওসমানী নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে সক্ষম যোদ্ধা হিসেবে হাজির করা হয়েছে ভেনিসীয় ম্যুর ওথেলোকে। যিনি মরক্কো থেকে আগত অভিবাসী। নাটকে প্রথম দিকে ওথেলোর উপস্থিতি ও ভূমিকা প্রশংসনীয়। আদর্শ সেনাপতি ও ব্যক্তিত্বের অবস্থানে থাকে ওথেলো। দর্শকের আগ্রহ, প্রিয়তা ও সহানুভূতি তৈরি হয় তার প্রতি। এরপর ধীরে ধীরে ওথেলোকে দেয়া হয় ঈর্ষাপরায়ণ চরিত্র। সে জড়িত হয় বিবিধ পাপে। একের পর এক খারাপ কাজ করে ওথেলো। তবে এর পেছনে ভূমিকা রাখে তার সহকারী ইয়াগো। ওথেলো ভালোবাসে ভেনিসের সুন্দরী ডেসডিমোনাকে। উভয়ের বিয়ে ছিল মৃত্যুর সমান। অসচ্চরিত্র ভেনেসীয় রডরিগো ছিলেন ডেসডিমোনার ব্যর্থ প্রেমিক। তার সাথে মিলে ওথেলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকান তার সহকারী ইয়াগো। ওথেলোর বিশ্বস্ত ও সর্বাধিক প্রিয় ক্যাপ্টেন ক্যাসিওর সাথে ডেসডিমোনার মিথ্যা প্রেমের সন্দেহ তারা ঢুকিয়ে দেয় ওথেলোর মনে। ফলে ঘটনার ধারাবাহিকতায় ওথেলো নিজের প্রিয়তমাকে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং ভীষণভাবে গলা চেপে ধরে। ডেসডিমোনার মৃত্যুর সামান্য আগে ওথেলো বুঝতে পারে যে তিনি বিশ্বাসঘাতকিনী নন।

ডেসডিমোনার মৃত্যুতে ওথেলোর অনুতাপ সীমা অতিক্রম করে। হত্যার দায়ে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। তীব্র শোকে, বেদনা ও

মনস্তাপে ওথেলো আত্মহত্যা করেন। ট্র্যাজিক এই নাটকে শেক্সপিয়র পুরুষের কুৎসিততম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন। কৃষ্ণবর্ণ ওথেলোকে প্রেম দিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ ডেসডিমোনা, সে ওথেলোর প্রতি মুগ্ধ হয়েছিল তার অতীত জীবনের বেদনার গল্প শুনে। নিজের পিতা এবং অন্যান্য সিনেটরের বিরোধিতা উপেক্ষা করে সে সম্মত হয়েছিল ওথেলোকে বিয়ে করতে। তার সিনেটর পিতা ব্রাবানশিও বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে একটা ‘কালিমাখা বক্ষস্থল’ কামনা করা তার মেয়ের পক্ষে সম্ভব! কিন্তু ডেসডিমোনা কালিমাখা বুকের ওথেলোকেই কামনা করলেন। আর এর বিনিময়ে পেলেন নির্মম মৃত্যু। অপর দিকে নিজের বির্বোধ কর্মকাণ্ড ও ঈর্ষার ফলে ওথেলো সব হারান। নিজেকে নিজেই খুন করে ইহলীলা সাঙ্গ করেন।

নাটকে বিভিন্নজনের সংলাপে ওথেলো চিত্রিত হয়েছেন বার্বার ঘোড়া, কামুক ম্যুর, বুড়ো কালো ভেড়া ইত্যাদি বর্ণবাদী অভিধায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে বহু সমালোচক ওথেলো নাটককে দেখতে চেয়েছেন বর্ণবৈষম্যের প্রেক্ষাপটে। কেননা শেক্সপিয়রের সময়ে ইউরোপে আন্তঃবর্ণ বিয়েকে মনে করা হতো নীতিভ্রষ্টতা এবং তার পরিণাম ছিল ভয়াবহ। ইংল্যান্ডে তখন প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনের জোয়ার। তখনকার ইংরেজ সমাজ যাদেরকে ‘অন্য’ মনে করে, তাদের সাথে সম্পর্ককে দেখে ও দেখায় বিপজ্জনক ব্যাপার হিসেবে। তাদের ওপর আরোপ করে প্রতারণা, বর্বরতা, ঈর্ষা ও লাম্পট্যের কলঙ্ক। এই যে সামাজিক অনুমান, একে প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি রেনেসাঁও। বরং একে অঙ্গীভূত করেই সে এগিয়েছে। শেক্সপিয়রের ওথেলো চরিত্রের পরিণতির ভেতরেও এই মানসিকতার বিচরণ রয়েছে।


ওথেলোর বীরত্ব, পশ্চিমাদের জন্য তার যুদ্ধ, তুর্কিদের বিরুদ্ধে তার সাহসিকতা সত্তে¡ও সে বিপজ্জনক থেকে গেছে, যখন সে পশ্চিমা সুন্দরীকে নিজের স্ত্রী বানাতে চেয়েছে। সে পারেনি, ব্যর্থ হয়েছে। নিজস্ব কারণেই ব্যর্থ হয়েছে সে। সুন্দরী তাকে সবটুকু ভালোবাসা দিয়েও তার হাতে নিজের মৃত্যু এড়াতে পারেননি। নিজস্ব বোকামি এবং মানসিক তুচ্ছতা ওথেলোকে এই সংসারের যোগ্য হতে দেয়নি। এই যে উপসংহার ওথেলোর, তা ইউরোপীয় মনের এমন এক ধারাবাহিক ভাষা, শেক্সপিয়র যাকে তর্জমা করেছেন মাত্র। তার ভাষাও সেই ধারাবাহিক ভাষারই অংশ।

সেই ভাষা কি পরবর্তীতে বদলেছে? বদলালো কই? এখনো পশ্চিমাদের চোখে যারা ‘অন্য’, বিশেষত যারা ওথেলো, (ম্যুর বা মুসলিম) তারা বিপজ্জনক এবং ভিন্ন হয়েই আছে। অবাঞ্ছিত হয়েই আছে। যাদের গুণাবলী থাকলেও আপনি তাদের বিশ্বাস দিতে পারেন না, আপন ভাবতে পারেন না, ভালোবাসা দিতে পারেন না। তা দিতে পারেন না সেই লেভেলে, যেখানে আপনারা পরস্পরে বন্ধনের ঘর গড়ে তুলবেন। সা¤প্রতিক পশ্চিমা রাজনীতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদ কী এমনতরো ভাষার বিস্তার করছে না?

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল