০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কামরুল ইসলাম চৌধুরী

- ছবি : সংগৃহীত

Negotiation I Policing দু’টি পরিচিত পরিভাষা। Negotiation মানে আলাপ-আলোচনা, যাতে অনেকাংশে আর্থিক লেনদেনও জড়িত। আর Policing মানে কঠোর নজরদারি ও সতর্কতা। পরিবেশের ক্ষেত্রে এই দু’টি পরিভাষা বারবার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি কামরুল ইসলাম চৌধুরী এই দু’টি পরিভাষার ওপর জোর দিতেন খুব বেশি। তিনি আর নেই। ৩০ এপ্রিল রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৩ বছর।

মনে পড়ে ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে, আমরা তার নেতৃত্বে করাচি ও লাহোর সফর করেছি সরকারের বিদেশী অর্থায়নে। বড় শহরের বায়ুদূষণ রোধে এই সফরের আয়োজন করা হয়েছিল। তখন পরিবেশমন্ত্রী ছিলেন মরহুমা বেগম সাজেদা চৌধুরী। ক্ষমতায় ছিল আজকের মতো আওয়ামী লীগ। প্রথম দফায় দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। আমরা করাচি গিয়ে সেখানে বাতাসের মান লক্ষ করি, যা ঢাকার তুলনায় মন্দ ছিল না। করাচিতে আমরা একজন NGO বিশেষজ্ঞ Mrs. Dhunmai Kawasji এর সাথে বৈঠক করলাম। সঙ্গী সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই ঢাকাকে Gas chamber এর সাথে তুলনা করলেন। মনে পড়ে আমাদের সাথে ছিলেন পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার রানাও। আমরা গিয়েছিলাম Emirates এর বিমানে চড়ে। এরপর লাহোরে যাই সে দেশের পরিবেশ সাংবাদিকদের এবং আইইউসিএনের সাথে আলাপ করার জন্য। আমরা করাচি প্রেস ক্লাবও পরিদর্শন করি এবং দেশটির পরিবেশ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা হয়েছে। লাহোরে এক সাংবাদিকের সাথে পরিচয় হয়, যিনি ঢাকাতে এসেছিলেন। তার নাম উমর আফ্রিদি। তিনি তৎকালীন নব্য ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদির চাচাতো ভাই। তখন শহীদ আফ্রিদি নতুন খেলতে নেমেছেন। উমরের নৃতাত্তি¡ক অনুভূতি এত প্রখর ছিল যে, তিনি সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বহুলালোচিত ইমরান খানকে পাঠান হিসেবে স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। কারণ তার মতে, পাঠানদের একটি বৈশিষ্ট্য পশতুভাষী হওয়া। তিনি মনে করতেন ইমরান খান পশতু নয়, হাজারা ভাষী।

যা হোক, সমগ্র সফর কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন কামরুল ইসলাম চৌধুরী। কামরুল ইসলাম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায়। এই উপজেলায় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জন্ম। তাকে কবরস্থ করা হয়েছে নিজ গ্রামে। তিনি পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামকে ঘএঙ-এর মতো চালাতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। এ জন্য অনেকে তার বিরোধিতা করেন। তবে যে পদ্ধতিতে তিনি প্রেস ক্লাব সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তা গ্রহণীয় নয়। তার মৃত্যুর পরে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম টিকে থাকবে কি না, তা বড় প্রশ্ন।

একই সময়ে বাংলাদেশের পরিবেশ সাংবাদিকরা নেপাল, ভারত ও মালয়েশিয়া সফর করেন। ফোরামের সাংবাদিক হিসেবে কামরুল ইসলাম চৌধুরী এইসব সফর কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু এরপরও পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের নামে সরকারের বিরাট তদন্তের কার্যক্রম শুরু হয়। আমি নিজেও অহেতুক পুলিশের হয়রানির সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের পাকিস্তান সফরকালীন এক সহকর্মীর জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত থাকার পরও পুলিশ হানা দেয় এবং নানা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করেছিল। জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন উপলক্ষে কামরুল চৌধুরী সাধারণত বাংলায় নিবন্ধ লিখতেন বিভিন্ন পত্রিকায় এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর সালিম-উল-হক পত্রপত্রিকায় লিখে আসছেন ইংরেজিতে।

কামরুল ইসলাম চৌধুরীর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় দৈনিক সংবাদে। এরপর তিনি ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে ও বিএসএসে কাজ করেন। দৈনিক সংবাদ বামপন্থী পত্রিকা। এটা সবার জানা কথা। সাধারণত কমিউনিস্টরা বা সমাজতন্ত্রীরা ছাড়া অন্যরা এই পত্রিকা কমই কিনেন। দৈনিক সংবাদের প্রোডাক্ট-যারা ডানপন্থী রাজনীতিতে এসেছে, তাদের মধ্যে শওকত মাহমুদ ও কামরুল ইসলাম চৌধুরীর নাম প্রথমে উল্লেখ করতে হয়। দুইজন প্রায় সমসাময়িক। শওকত মাহমুদ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, কামরুল ইসলাম চৌধুরীও মূলত এই দলের লোক ছিলেন, যদিও জীবনের শেষ দিকে তার কর্মকাণ্ডের অন্যরকম মূল্যায়ন করা যায়। তিনি এক দিকে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে অবদান রেখেছেন; অন্য দিকে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামকে একপ্রকার এনজিওতে পরিণত করেছিলেন।

উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালের শেষ দিকে আমি নিজে যখন পেশাগতভাবে দৈনিক সংগ্রামে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করি, তখন পরিবেশ সাংবাদিকদের একটি সংগঠনের কথা কানে আসে। এতে জড়িত ছিলেন মরহুম গিয়াস কামাল চৌধুরীর মতো সিনিয়র সাংবাদিকও। তারা তখন সুন্দরবন থেকে শুরু করে দেশের পুরো উপকূল সফর করছিলেন। এতে সংগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুও শামিল হয়েছিলেন। অনেক পরে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম গঠিত হয় এবং এতে দায়িত্বশীল ছিলেন আহমেদ নূরে আলম (বর্তমানে প্রবাসী) ও মঈনুদ্দীন নাসেরের (বর্তমানে প্রবাসী) মতো সিনিয়র সাংবাদিকরা। কিন্তু তারা পরে আর জড়িত ছিলেন না- সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন। যাই হোক, কামরুল ইসলাম চৌধুরী দীর্ঘদিন পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের নেতৃত্ব দিয়েছেন- এটাও একটা বড় কথা। তার সময়ে মফিজুর রহমান দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কবি হাসান হাফিজও পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামে সংশ্লিষ্ট।

পরিবেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম ছাড়া এসব সাংবাদিকদের জাতীয় সংগঠন নেই- এটাও সত্য কথা। আমরা কামরুল ইসলাম চৌধুরীর রূহের মাগফিরাত কামনা করি এবং পরিবেশ সাংবাদিকদের সংগঠন এগিয়ে যাক, এটাই প্রত্যাশা করি। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ দেশের বন্যা, ঝড়, ভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, প্রভৃতির তীব্রতা এবং সংঘটন বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পরিবেশ দূষণ রোধ তথা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার গুরুত্ব এত বেশি। পরিবেশ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করা যায়। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।


আরো সংবাদ



premium cement