০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ফ্যাসিবাদের পতন ও গণতন্ত্রের বিজয় অনিবার্য

-

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিশ্বে সাম্য ও গণতন্ত্রের উজ্জ্বল উদাহরণ। ইতিহাসের এক পরম দুর্ভাগ্য যে, আমাদের সেই বহুলালিত স্বপ্ন আজ সুদূর পরাহত, কোনো এক অজ্ঞাত অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ গণতন্ত্রহীনতা। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গণতন্ত্র হচ্ছে উন্নয়ন ও অধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন; যার অনুপস্থিতি বা বিকৃতি একটি রাষ্ট্র বা সমাজের প্রকৃত বন্ধনমুক্তির সব পথ রুদ্ধ করে দেয়।

প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্য জাক রুশোর চিরস্মরণীয় সিদ্ধান্তের অমোঘ সত্য- মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীনভাবে, তবে সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত (Man is born free but everywhere he is in chain)। এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের সুষ্ঠু বিকাশ- যা রুশো প্রত্যাশা করেছিলেন নিপীড়িত ফরাসি জনগণের জন্য। রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, সামন্তবাদ, উপনিবেশবাদ এবং ফ্যাসিবাদের নিরন্তর নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটিয়ে মানবমুক্তির একমাত্র উপায় হলো গণতন্ত্র। দার্শনিক রুশো গণতন্ত্রের অনাবিল অভিযাত্রার মধ্যেই প্রত্যক্ষ করেন সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার এক আশ্চর্য এবং অপরিহার্য বাস্তবতা।

মানব ইতিহাসে একাধিকবার দেখা গেছে ফ্যাসিবাদের নির্মম ও নিষ্ঠুর পরিণতি। হিটলার, মুসোলিনি প্রভৃতি ফ্যাসিবাদীর একনায়কতান্ত্রিক দাম্ভিকতা এবং ক্ষমতার নিরঙ্কুশ আস্ফালন অচিরেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের নির্ধারিত আস্তাকুঁড়ে, তবে ইতিহাসেরই নির্মম পৃষ্ঠার দিকে দৃষ্টি পড়ে না অনেক ফ্যাসিবাদী শাসকের।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, ইতিহাসের এই শিক্ষা এখনো ফ্যাসিবাদী শাসকেরা গ্রহণ করেননি। তারা আজও ক্ষমতা-অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে দুর্দান্ত প্রতাপে শাসন ও শোষণের বল্গাহীন অশ্বের পিঠে সওয়ার হয়ে আছেন।

বাংলাদেশেও আজ আমরা প্রতি মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করছি ফ্যাসিবাদের বিলুপ্ত প্রেতাত্মার পুনরুত্থান। এক নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদের কবলে আজ আমাদের স্বদেশ; এর স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, জনগণের মৌলিক চাহিদা তথা সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক সুস্থতা। গত দেড় দশকে এই ধারা গণতন্ত্রের কবর রচনা করে জনগণের সর্বপ্রকার অধিকার হরণ করেছে। অপহরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে নির্বাচন চুরি।

তঙ্করবৃত্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং এই অবৈধ দখল কায়েম রাখার স্বার্থে গুম, হত্যা, বিনা বিচারে আটক, নির্বিচার গ্রেফতার তথা সব প্রকার রাষ্ট্রীয় ত্রাস ও সন্ত্রাসের এক বীভৎস রাজত্ব গড়ে তোলা হয়েছে। সীমাহীনভাবে অবিরাম লঙ্ঘন করা হচ্ছে মানবাধিকার।

এ সবের পাশাপাশি অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন। জাতীয় সম্পদ লুট করে এরা বিদেশে পাচার করছে, গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়। গণতন্ত্রহীনতার এমন এক দুর্বিষহ দুষ্কালে প্রতিবাদের কণ্ঠগুলো স্তব্ধ করার হীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

আমরা অবশ্যই ইতিহাসের অনিবার্য গতি ও পরিণতির শিক্ষা ভুলে যেতে পারি না। আমরা ইতিহাসের প্রতি উদাসীন থাকলেও ইতিহাস জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবনের পরতে পরতে।

বিশ্বের মুক্তিপাগল মানুষের মতোই বাংলাদেশের জনগণও স্বৈরাচারের শাসন থেকে মুক্তি চায়, গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চায়। সুতরাং আজ আমাদের একমাত্র জাতীয় কর্তব্য হচ্ছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দলমত নির্বিশেষে অবতীর্ণ হওয়া। সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের সাথে দেশের সুশীলসমাজ একযোগে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

অবস্থাদৃষ্টে আমার বহুবার মনে হয়েছে যে, আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ আজ শাসক এবং শোষক শ্রেণীর পদলেহনে ব্যস্ত। নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের জন্য তারা শুধু আত্মসমর্পণই করেননি, আত্মবিক্রি করেছেন। সত্যের সন্ধান করা, সত্য কথা বলা দূরে থাক, মিথ্যা বলা এবং চাটুকারিতাই তাদের প্রধান কাজ। শাসকের মনোরঞ্জন এবং শোষকের সন্তুষ্টি বিধান করেই তারা তৃপ্ত হন। অবশ্য এটা তাদের শ্রেণী চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ।

সমাজে দুটি মৌলিক শ্রেণী (Basic Class) থাকে- একটি উৎপাদনের উপায়ের মালিক শ্রেণী (Owners of the means of production) যারা শাসক, শোষক এবং নিপীড়ক। আরেকটি উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা থেকে বঞ্চিত শ্রেণী (Non-owners of the means of production) যারা প্রধানত উৎপাদন সংগঠনে শ্রম দিয়ে থাকে; তারা শাসিত, শোষিত এবং নির্যাতিত। আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের দুটি মৌলিক শ্রেণী হলো: ১. পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণী-এরা শাসক এবং শোষক শ্রেণী এবং ২. শ্রমিক শ্রেণী বা সর্বহারা শ্রেণী-এরা শাসিত এবং শোষিত শ্রেণী।

এ দুই মৌলিক শ্রেণীর বাইরে অমৌলিক শ্রেণীর (Non-Basic Class) অবস্থান। বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী তথা বুদ্ধিজীবী একটি অমৌলিক শ্রেণী। এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত; আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে সুবিধাবাদী এবং সুবিধাভোগী শ্রেণী তা এক প্রমাণিত সত্য। পুঁজিবাদী সমাজে তারা বুর্জোয়া শাসক শ্রেণীর সহযোগী। শাসক শ্রেণীর সর্ব প্রকার শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের সহযোগী শক্তি হিসেবে এরা কাজ করে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শাসকদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে এরা অনেক বেশি সক্রিয় ও সোচ্চার এবং অন্যায় অবিচারের শাসন কায়েমের ক্ষেত্রে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।

এ কথা সত্য যে, সমাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশাজীবী; এক কথায় যাদের বলা হয় বুদ্ধিজীবী। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমানে আমাদের সমাজের বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছে এবং তাদের স্বার্থে কাজ করার মধ্যে দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করে চলছে। শাসকের মনোরঞ্জন ও স্তুতিতে এরা দক্ষ ও পটু। পদ-পদবির লোভে তারা নানাভাবে ক্ষমতাবান ও শক্তিধরকে তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট। দালালি ও পদলেহনের প্রতিযোগিতায় যারা অগ্রগামী থাকেন তারা শাসক শোষকের নৈকট্য লাভ করেন এবং বড় বড় পদ পদবি ও পুরস্কার লাভ করেন। এ প্রতিযোগিতায় যারা পেছনে থাকেন তারাও ছিটেফোঁটা হালুয়া রুটি ও ছোটখাটো আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হন না। এরূপ পরিস্থিতিতেও ন্যায় ও সত্যের পূজারী স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে এর বিপক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়। শত নিপীড়ন ও নির্যাতন উপেক্ষা করে তারা তাদের বিশ্বাসে অবিচল থাকেন। সর্বকালের সর্বসমাজের এ ধরনের উদাহরণ দেখা যায়। মানব ইতিহাসের চাটুকার ও দালাল বুদ্ধিজীবীদের অনৈতিক কার্যকলাপের যেমন প্রমাণ পাওয়া যায় তেমনি নির্লোভ, ত্যাগী বুদ্ধিজীবীদের মত শুভশক্তির পক্ষে অবস্থানের কাহিনীও লিপিবদ্ধ আছে। যুগে যুগে দেশে দেশে সমাজ বদলের আন্দোলন সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণের বহু উদাহরণ আছে।

দার্শনিক কার্ল মার্কসের মতে, ‘Philosophers have hitherto interpreted history, now the task is to change it.’ ‘দার্শনিকেরা এ যাবৎকাল মানব ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেছেন, এখন কাজ হবে একে বদলে দেবার।’ মার্কসের এ উক্তির আলোকে এ কথা স্পষ্টত বলা যায় যে, দার্শনিক তথা লেখক, চিন্তাবিদ, পেশাজীবী এক কথায় বুদ্ধিজীবীদের কাজ শুধু সমাজ বিকাশের ইতিহাস ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা। এখন প্রয়োজন তাদের সমাজের মৌলিক পরিবর্তনে অংশগ্রহণ করা। বিদ্রোহ বিপ্লবে তথা সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যেমন বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণের উদাহরণ মেলে, অন্যদিকে এর বিপরীত স্রোতে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানেরও ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে।

১৯৭১ এ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করেছিলেন তখনকার বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ। মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবী যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৭১ সালে যারা গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন আজ আর তারা গণতন্ত্রের কথা বলেন না। তারা বলেন, উন্নয়নের কথা। কিন্তু গণতন্ত্র ছাড়া যে উন্নয়ন হয় না, তা তারা বুঝেও বোঝেন না। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানও এরূপ কথা বলেছিলেন। তিনিও শুনিয়েছিলেন উন্নয়নের এক দশকের কথা। তখনকার বুদ্ধিজীবীরা এবং জনগণ তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। আইয়ুব শাহীর নিপীড়ন, নির্যাতন যতই কঠোর হয়েছে, গণআন্দোলন, গণঅভ্যুথানে এবং সর্বোপরি আমাদের মুক্তি সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছেন। বুদ্ধিজীবীদের এ গৌরবময় অতীতের কথা আজকের দিনের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বেমালুম ভুলে গেছেন। আইয়ুবের এবং এরশাদের অনুগত বুদ্ধিজীবীদের মতোই তারা অন্ধ; দেখেও দেখেন না, শুনেও শুনেন না। লজ্জা, বিবেক সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শাসকের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গল্প ও গীত রচনা করাই তাদের মুখ্যকর্ম। সম্প্রতি এক তরুণ কলামিস্ট অনেকটা বিদ্রূপ করেই এদের বুদ্ধিজীবী বলার পরিবর্তে এদের নামকরণ করেছেন ‘বুদ্ধিযুক্ত জিহ্বাধারী’। দার্শনিক মার্কসের সমাজ বদলের মর্মবাণী এদের কর্ণকুহরে কখনো প্রবেশ করেছে কিনা জানি না; আর প্রবেশ করলেও তা তাদের গ্রাহ্য করার কথা নয়। সমাজ বদল নয়, সমাজকে আরো পিছিয়ে দিতে তারা আজ সক্রিয়।

আত্মসমর্পিত বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র মুৎসুদ্ধি চরিত্র। এদের জাতীয় চরিত্র নেই বিধায় এদের দেশপ্রেমও নেই। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এরা নানা কৌশলে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বিদেশী শাসক ও শোষক শ্রেণীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ওদের স্বার্থরক্ষাই এদের প্রধান কাজ। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে এখনো একটি জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান ঘটেনি। এখানকার বুর্জোয়ারা কম্পারেডর বুর্জোয়া অর্থাৎ মুৎসুদ্ধি বুর্জোয়া। এদের অনুসারী তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীরা দেশের সম্পদ পাচারে কিংবা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। এদের মাধ্যমেই শোষণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। আজ তাদের ভূমিকা পরিবর্তন করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তাদের দেশপ্রেম এবং সমাজের প্রতি অঙ্গীকার তরুণ সমাজকে অনুপ্রাণিত করবে; সূচিত হবে মৌলিক পরিবর্তনের নবযুগ।

লেখক : সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত


আরো সংবাদ



premium cement